চার বছর বয়স থেকে যৌন শিক্ষা, পথপ্রদর্শক হতে পারে এই দেশ

ভারতে যৌনতা নিয়ে নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা আছে। যৌনতা নিয়ে ছুঁৎমার্গিতাও ভারতীয় সমাজের নতুন কোনও বৈশিষ্ট্য নয়। বাবা-মায়েরা সন্তানের সামনে সচরাচর যৌনতা সম্পর্কে আলোচনা করতে চান না। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর শুরু হয় ১২ বছর বয়সে পা রাখলে। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের যৌন শিক্ষা দেওয়ার নানা উপকারিতা রয়েছে। কিশোর-কিশোরীরা 'আমি কীভাবে এলাম', তা জানার পাশাপাশি যৌনতা সম্পর্কে স্কুলজীবনেই যদি চেতনা লাভ করে, তা সারা জীবনের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। স্কুলে যৌনশিক্ষা লাভ ছেলে-মেয়েদের পক্ষে কেন উপকারী, সেকথাও গবেষণায় জানা গিয়েছে।

কৈশোরে ছেলে-মেয়ে দু'পক্ষেরই নানা শারীরিক পরিবর্তন হয়। এই শারীরিক পরিবর্তন বয়সোচিত কারণে প্রাকৃতিক নিয়মে হলেও, ছেলে-মেয়েরা অনেক সময়ে ভয়ার্ত হয়ে পড়ে এই সম্পর্কে আগাম জ্ঞান না থাকায়। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের যৌনশিক্ষা স্কুলের সিলেবাসের অন্তর্গত হলে ভবিষ্যতের প্রাপ্তবয়স্ত নাগরিক হিসেবে ছেলেমেয়েদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ ও সচেতন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

কিশোর-কিশোরীরা হামেশাই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের সঠিক বয়সে যৌন শিক্ষা দেওয়া হলে সেক্ষেত্রে জীবন সম্পর্কেও সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হত। পাশাপাশি নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতিও তৈরি হত।

আরও পড়ুন: কন্যাসন্তানকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করায় এই সম্প্রদায়!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে সমস্ত স্কুলপড়ুয়া লেখাপড়ায় ভালো ফল করেছে যৌনতা সম্পর্কে তারা অবগত হলেও নিজেরা কখনও যৌন সম্পর্কে জড়ায়নি। আর সেই স্কুলপড়ুয়ারা পরীক্ষায় তুলনায় খারাপ ফল করেছে, ইতিমধ্যে যারা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এই ধরনের সমীক্ষা আদতে নির্দিষ্ট বয়সে, অর্থাৎ ১৮ বছর বয়সে পৌঁছনোর আগে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া বিষয়ে প্রকারান্তরে সচেতন করে। 

কৈশোরে যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, যৌন শিক্ষার ক্লাস প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু করা উচিত। এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হতে পারে নেদারল্যান্ডস। নেদারল্যান্ডসের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে শিশুদের চার বছর বয়স থেকেই যৌন শিক্ষা দেওয়া হয়। যার প্রথম পাঠ হল, শিশুকে তার শরীর সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন করা।

ভারতে কৈশোরে যৌন শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা তো নেই-ই, বরং ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েদের শেখানো হয় যৌনতা আদ্যন্ত গোপনীয় বস্তু, অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে যে বিষয়ে আলোচনাও করেন না। এতে জীবন সম্পর্কে অপূর্ণ ধারণা তৈরি হয় কিশোর-কিশোরীদের, এও দেখা গিয়েছে।

দেখা যাক, নেদারল্যান্ডসে চার বছর বয়স থেকে শিশুকে যৌনশিক্ষা দেওয়ার সুফল কী? যেমন, শৈশব থেকে যৌন শিক্ষা লাভের ফলে নেদারল্যান্ডসে কিশোরীদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার হার অত্যন্ত কম।

ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুসারে, ভারতের গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা কিশোরীদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার হার শহরের বাসিন্দারের তুলনায় বেশি। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সে ভারতে প্রতি বছর এক কোটি ৬০ লক্ষেরও বেশি কিশোরী অন্ত্বঃসত্তা হয়ে পড়ছে। ফি বছর পৃথিবীতে এই বয়সের যত সংখ্যক কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে, এর মধ্যে ১১ শতাংশ ঘটনাই ঘটছে ভারতে।

যৌন শিক্ষা আদতে কী? এব্যাপারে অগ্রণী দেশ নেদারল্যান্ডসের যৌন শিক্ষা বিষয়ক সিলেবাসের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নেদারল্যান্ডসে শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের যৌনক্রিয়া সম্পর্কে অবগত করানোই কিন্তু যৌনশিক্ষার প্রধান বিষয় নয়। বরং ওদের শেখানো হয়, যৌন স্বাস্থ্য কীভাবে স্বাভাবিক রাখা যায়। পাঠদান করা হয় ভালবাসা, ঘনিষ্ঠতা থেকে নারী-পুরুষের পারস্পরিক মর্যাদার সম্পর্কের সুফল প্রসঙ্গে। এছাড়া দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি নিয়ে ধারণাও ধারাবাহিকভাবে গড়ে তোলা হয়। শিক্ষার্থী ছাড়াও অভিভাবক এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা- তিন পক্ষের সমন্বয়ের জরুরি কাজটাও একই সঙ্গে করা হয়।

শৈশব, কৈশোর থেকে যৌন শিক্ষা দেওয়ার সঠিক ব্যবস্থা নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও। এর ফলে প্রতি বছরই মার্কিন মুলুকে কিশোরীদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার হার বাড়ছে। যদিও মার্কিন মুলুকে যৌন শিক্ষা একটি স্বীকৃত বিষয়।

যৌন শিক্ষা দেওয়ার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোকে কাজে লাগাতে আগ্রহী। তবে সেদেশে যৌন শিক্ষাখাতে বাজেটে আর্থিক বরাদ্দ কম থাকায় কাজটা সুচারুভাবে করা যাচ্ছে না।

এই যুগে সকলের হাতে হাতে মোবাইল। আর ইন্টারনেটের জালও দুনিয়াজুড়ে্ বিস্তৃত। যথাযথ যৌন শিক্ষার অভাবে কৌতূহল মেটাতে কিশোর-কিশোরীরা অনেকসময়েই অভিভাবকের চোখের আড়ালে পর্ন সাইটগুলি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। এর ফলে যৌনতা সম্পর্কে কিশোর মনে নানা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে। লিঙ্গবৈষম্যের বীজ নির্মূল না করতে পারার পথের কাঁটা এও।

যদিও ১৯৯৪ সালেই ভারতে স্কুল-স্তরে যৌন শিক্ষা চালু হতে পারত। ১৯৯৪ সালে জনসংখ্যা এবং উন্নয়ন বিষয়ে রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে কিশোর-কিশোরীদের সুস্থ জীবনের কথা মাথায় রেখে ভারতও 'সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ রাইটস' নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই কাজের সূত্রপাত এখনও হয়নি।

অনেক ক্ষেত্রেই মান্ধাতার ধ্যানধারণা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে অনেকেই। যৌনতা নিয়ে লুকোছাপাও তেমনই এক ব্যাপার।

এর সপক্ষে উদাহরণও আছে। ২০০৭ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার স্কুলে যৌনশিক্ষার পাঠ‍্যক্রম অন্তর্গত করার উদ্যোগ নিয়েও তুমুল বিরোধিতার মুখে পড়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে প্রতিবাদকারীরা ছিলেন তথাকথিত নীতিপুলিশবৃন্দ। ফলে 'অ্যাডোলেসেন্ট এডুকেশন প্রোগ্রাম' মুখ থুবড়ে পড়ে- যার অন্তর্গত ছিল যৌন শিক্ষা। হিংসা ও নিগ্রহ সম্পর্কে সচেতন করানোর পাঠও যৌন শিক্ষার অন্তর্গত। এই কার্যক্রম চালু করতে বিভিন্ন রাজ্যের কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি স্কুলকে প্রথম দফায় বেছে নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অভিমত, শৈশব অথবা কৈশোরের গোড়াতে যথাযথ যৌন শিক্ষা ভবিষ্যতের নাগরিকদের শরীর-মন-আবেগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাকে মানুষ হিসেবেও দায়িত্বশীল ও সামাজিক করে তুলবে।

কৈশোরে যৌন শিক্ষার অন্তর্গত বয়ঃসন্ধির শারীরিক পরিবর্তনগুলি সম্পর্কে আগাম জানাশোনাও। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেসব অবহেলিতই থেকে গিয়েছে। এর পরিণামও করুণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া খতিয়ান অনুসারে, আবিশ্ব এইচআইভি আক্রান্তদের মধ্যে ৩৪ শতাংশের বয়স ১২ থেকে ১৯ বছরের ভেতর।

ভারতে যৌন শিক্ষা ২০১৬ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষানীতির অন্তর্গত। কিন্তু প্রয়োগ কোথায়? কেনই বা যৌন শিক্ষার পাঠ‍্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না, এই বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আজকের পৃথিবীতে মানবাধিকারের মধ্যে পড়ছে শৈশব-কৈশোরে যৌন শিক্ষা লাভ করাটাও।

More Articles