কবর থেকে চুরি গিয়েছিল মাথার খুলি: শেক্সপিয়রের সেই রহস্যময় করোটির খোঁজ আজও চলছে

সেই রাতে সময় যেন থমকে গিয়েছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিকে। হোলি ট্রিনিটি চার্চের পূর্ব দিকটায় হঠাৎ পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। এক নয়, একাধিক মানুষের পদচারণার শব্দ। পাথুরে দেওয়াল শেষ হতেই রাতের সঙ্গে প্রায় মিশে থাকা ছায়ামূর্তিগুলো নজরের আওতায় এল। হাতে লণ্ঠন। আঁচ অত্যন্ত কমানো। আলো-আঁধারির ষড়যন্ত্রে হাতের অস্ত্রগুলোও খানিক ফুটে উঠেছে। এদিক ওদিক কী একটা খুঁজছে লোকগুলো। কয়েকটা মুহূর্ত। মৃদু আলো পড়ল একটা হেডস্টোনে। এই তো। 'কার্সড্‌ বি হি দ্যট মুভস্‌ মাই বোন'--আমার অস্থি যে স্থানচ্যুত করবে, তার কপালে নেমে আসুক ভয়ঙ্কর অভিশাপ। এই কবরের খোঁজেই এসেছে তারা। কয়েকজন মিলে হাতাহাতি কবরের ওপরের ভারি পাথরটা সরিয়ে ফেলা গেল। এইবার মাটি খোঁড়ার অপেক্ষা। বেশ কিছুটা খোঁড়ার পর অবশেষে ওদের একজন অতি সাবধানে মাটি থেকে তুলে নিল জিনিসটা। বাকিরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল দেখার জন্য। লোকটার হাতে একটা মানুষের মাথার খুলি। খুলিটা বেশ পুরনো। নর-করোটিটা হাতে নিয়ে দলপতির চোখ চকচক করে উঠল। এই সেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাথাদের  একটি এখন তার হাতের মুঠোয়। খুলিটা শেক্সপিয়রের।

হাতে খুলি নিয়ে একটি লোক অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে সবাইকে–ব্যাপারটা নতুন নয়, বেশ পুরনো। বহুবার বহুরকম ভাবে অভিনীত হয়েছে মঞ্চে হ্যামলেট নাটকের এই বিখ্যাত দৃশ্য। কাজেই শেক্সপিয়রের অস্তিত্ব এই দৃশ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তা যদি নাটকের ক্ষেত্র থেকে বাস্তবের রঙ্গমঞ্চে চলে আসে? কবর থেকে মৃতদেহ তুলে কাটাছেঁড়ায় শেক্সপিয়রের নাটকের জুড়ি মেলা ভার, অন্তত তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে। কিন্তু কালচক্রে এমন ঘটনা ঘটেছিল খোদ তাঁর সঙ্গেও।

শেক্সপিয়রকে নিয়ে বা তাঁর কবর নিয়ে নানা কিংবদন্তি চলে আসছে শতকের পর শতক। এমনকী একবার তাঁর গাঁজা খাওয়ার গল্পে উৎসাহিত হয়ে কবরের ভিতরে থাকা কঙ্কাল পরীক্ষা করতে চেয়েছিল এক যুবক। হাড়ে যদি তার চিহ্ন পাওয়া যায়। কিন্তু হোলি ট্রিনিটি চার্চ অনুমতি দেয়নি। চার্চের নিষেধের এই কড়াকড়ি দিনের পর দিন বাড়িয়ে দিয়েছে শেক্সপিয়রপ্রেমীদের আগ্রহ, উৎকণ্ঠা। প্রায় দেড়শো বছর আগে, ১৮৭৯ সালে 'দ্য আর্গোসি' ম্যাগাজিনে ছাপা হয় একটি চমকপ্রদ ঘটনা। যার খানিকটা ইতিমধ্যে পাঠক পড়ে ফেলেছেন শুরুতেই।

আর্গোসি-তে ছাপা ওই প্রবন্ধে লেখক বলেন, তাঁর বন্ধুর (মিঃ এম) কাকা ফ্র্যাঙ্ক চেম্বারস্‌ খোদ ছিলেন সেই গ্রেভ-রবারদের দলপতি। সেকালের বিখ্যাত লেখক এবং পার্লামেণ্টের সদস্য হোরেস ওয়ালপোল ৩০০ গিনির একটা পুরস্কার ঘোষণা করেন। যে বা যারা তাঁকে শেক্সপিয়রের মাথার খুলি এনে দিতে পারবে, পুরস্কার পাবে। অবাক হচ্ছেন? সে সময়ে এ জিনিস আকছার দেখা যেত। বিজ্ঞানের নাম ভাঁড়িয়ে ফ্রেনোলজি তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাথার খুলির মাপজোখেই নাকি যে কোনও ব্যক্তির বুদ্ধির দৌড় বোঝা যায় জলবৎ তরলং—এবং তারই ফল সেই খুলি অভিযান। ফ্র্যাঙ্ক তখন স্ট্র্যাটফোর্ডের ডাক্তার। পুরস্কারের আশায় দলবল নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক চুরি করে আনেন শেক্সপিয়রের করোটি। এরপরই শুরু হয় নানা অদ্ভুত কাণ্ড কারখানা।

করোটির অভিশাপ

নিজের কবরফলকে নিজেরই সনেট লেখা খোদাইয়ের চল কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখাই যায়। শেক্সপিয়র থেকে কিটস কেউই তার ব্যতিক্রম নন। তবে এপিটাফের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে শেক্সপিয়রকে ব্যতিক্রমী বলতেই হয়। এপিটাফে অভিশাপও সে কালে খুব প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই সব কবরফলক মূলত পাপীতাপী অবিশ্বাসীদের স্বর্গীয় অভিশাপ দিত। সেখানে শেক্সপিয়র অভিশাপ দিলেন চার্চেরই একটি পদকে, যাদের লোকে সেক্সটন বলে চেনে। এরা সাধারণত পুরনো কবর খুঁড়ে নতুন কবরের জন্য জায়গা তৈরি করত। 

সে যাই হোক, করোটি হাতিয়ে চেম্বারস্‌ চিঠি দিলেন ওয়ালপোলকে। কিন্তু ওয়ালপোল পুরস্কার দিতে অস্বীকার করলেন। এই শুরু হল বিশ্বাসঘাতকতার পালা। হতাশ হয়ে ক্রেতার খোঁজ করতে শুরু করলেন ফ্র্যাঙ্ক। তালেগোলে এক বন্ধু ব্যাপারটা জেনে ফেলেন তাঁর। সেই বন্ধু বারংবার চেম্বারস্‌কে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন যে খুলিটি চেম্বারস্‌ যথাস্থানে রেখে আসবে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চেম্বারস্‌ তার ডাকাতির সহকারী টম ডায়ারের হাতে খুলিটা আবার ফেরত পাঠালেন। হপ্তা খানেক পরে চার্চে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন কবর ঢাকার জন্য ব্যবহৃত স্ল্যাবটিতে কিঞ্চিৎ চিড় ধরেছে। ব্যাপার কী? ডায়ারকে চাপাচাপি করতে সে জানায় স্ল্যাবটা কতটা ভারি সে ঠিক আন্দাজ করতে পারেনি। খুলিখানা সে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু চেম্বারস্‌ ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারেন না।

কবির খুলি নিয়ে আধুনিক পরীক্ষানিরীক্ষা

স্ট্যাফোর্ডশয়র ইউনিভার্সিটির যে পুরাতত্ত্ববিদ গোটা ব্যাপারটা দেখাশোনা করছিলেন, তিনি কেভিন কলস্‌। বিবিসির একটি সাক্ষাৎকারে কেভিন জানান, রেডার স্ক্যানের ফলাফল ইত্যাদি সমস্ত তথ্য ইঙ্গিত করছে ১৮৭৯-র সেই রিপোর্টেরই দিকে। নিছক গল্প নয়, বরং সত্যিই। এমনকী কবরের স্ল্যাবটা মেরামত করার চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে। কবরটিও অগভীর। মাত্র তিন ফুট গর্ত সেখানে। কেভিন নিশ্চিত করোটি সে কবরে নেই।

আরও পড়ুন-‘সা রে গা মা পা ধা নি, বোম ফেলেছে জাপানি’, কী ঘটেছিল ৭৮ বছর আগের সেই দিনটায়

তবে একটি খুলি বাজারে শেক্সপিয়রের খুলি বলে ঘুরছিল। ওরকেস্টার থেকে মাইল ১৫ দূরে পাওয়া গিয়েছিল সেটা। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে খুলিটা ৭০ বছর বয়সি এক মহিলার মাথার খুলি।

শেক্সপিয়রকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। বিশেষত এত ধরনের গল্প তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছে যে বাস্তবে তাঁর করোটি কোথায় রয়েছে জানার উপায় নেই। পবিত্র সে কবর খুঁড়তেও দেবে না হোলি ট্রিনিটি চার্চ। অন্তত এমনটাই জানিয়েছেন রেভারেণ্ড প্যাট্রিক টেইলর। ফলে আগামীর আরও নানা তত্ত্বের গর্ভে নিহিত থাকুক সে অভিশপ্ত খোঁজ। ততদিন কবরের নীচে শুয়ে একটু শান্তি উপভোগ করুন বরং শেক্সপিয়র। বলা যায় না, আবার কে কখন তাঁকে মাটি খুঁড়ে টেনে আনে।

 

চিত্রঋণ—চ্যানেল 4

তথ্যঋণ—

BBC News. 2016. “Shakespeare’s Skull: New Chapter in Hunt for Missing Head,” March 27, 2016, sec. Coventry & Warwickshire.

Geggel,LiveScience, Laura. n.d. “Shakespeare’s Skull May Have Been Stolen by Grave Robbers.” Scientific American. Accessed December 27, 2021.

Schwyzer, Philip. n.d. “Shakespeare, Skulls and Tombstone Curses – Thoughts on the Bard’s Deathday.” The Conversation. Accessed December 27, 2021.

“Shakespeare’s Skull Probably Isn’t in His Grave - The Washington Post.” n.d. Accessed December 27, 2021.

“What Happened to Shakespeare’s Skull?” n.d. ThoughtCo. Accessed December 27, 2021.

More Articles