'সা রে গা মা পা ধা নি, বোম ফেলেছে জাপানি', কী ঘটেছিল ৭৮ বছর আগের সেই দিনটায়
‘সা রে গা মা পা ধা নি/বোম ফেলেছে জাপানি’। চলতি প্রবাদ। বাঙালি মাত্রেই এই প্রবাদের সঙ্গে পরিচিত। সে অনেককাল আগের কথা। দেশে দেশে তখন লড়াই, দাঙ্গা। রাজায় রাজায় যুদ্ধ। হঠাৎ করে আকাশ থেকে একদল উড়োজাহাজ কলকাতার উপর ফেলল গোটাকতক বোমা। বাকিটা সময়ের গর্ভে। আর সময় তো বহতা নদীর স্রোত। এই বহমানতার নিয়ম মেনেই এককালে যে ঘটনা শহর কলকাতার বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল, তা বিবর্তিত হয়েছে বেদম ইয়ার্কির চটুল কবিতায়। এভাবেই তো মানুষ এগিয়ে চলে, চ্যাপলিনের সিনেমার মতো জীবন যাপনের সকল বেদনার দিকে বাঁকা হাসির ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিয়ে। নবারুণ ভট্টাচার্যের মতে, আমাদের বিগত শতাব্দী ছিল মানবতার ইতিহাসের হিংস্রতম শতক। খুব ভুল কিছু বোধহয় বলেননি প্রয়াত নবারুণ। এ শতাব্দীর উপর দিয়েই তো ঝড়ের মতো বয়ে গিয়েছিল, দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, মন্বন্তর, একাধিক দাঙ্গা, আর, কলকাতার আকাশে জাপানি বোমার আতঙ্ক, 'সে বড় সুখের সময় নয়'। অন্ধকার ঘনালেই শহরের 'সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি' বাতিস্তম্ভগুলোর চোখে নেমে আসে শীতল ঢাকনা। নৈঃশব্দ্য চিড়ে 'মিলিটারি লরির ঘর্ঘর...ধাবমান মোটরের ক্ল্যাকসন হর্ন, আর মেঘে মেঘে এরোপ্লেনের' শব্দ ঘোষণা করে কলকাতার কঠিন অসুখ। ঠিক কী ঘটেছিল সে সময়ে? কেনই বা এক ভয়াবহ আতঙ্কে দিন গুজরান করতে বাধ্য় হয়েছিল কলকাতাবাসী? সে গল্পই বুনতে চাইছি।
আজ থেকে ঠিক আটাত্তর বছর আগে, ডিসেম্বরের এক মধ্যরাতে, কলকাতা কেঁপে উঠেছিল জাপানি বোমার বিস্ফোরণে । ক্যালেন্ডারে সালটা ১৯৪২। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। সর্বত্র চলছে মিত্র আর অক্ষশক্তির ধুন্ধুমার কোন্দল। এমতাবস্থায় ঔপনিবেশিক আগ্রাসনে জর্জরিত ভারতবর্ষকে ব্রিটেনের হয়েই নামতে হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। তার বিরুদ্ধে তখন জার্মানি, ইতালি এবং জাপানের মতো শক্তিরা। বলে রাখা ভালো, এ সময় খোদ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিসরটাও ছিল অসম্ভব ঘোরালো, ঘোর তর্ক-বিতর্ক চলছিল শিবিরে শিবিরে। একদল ইংরেজদের বিরুদ্ধে রণকৌশলগত অবস্থান থেকে মদত দিতে চাইছিল জার্মানিকে। বিপ্রতীপ অবস্থানে ছিল বামপন্থীরা।
এমন সময়ে ভারতের ভৌগোলিক মধ্যমণি কলকাতা পড়ল জাপান দেশের নজরে। ইংরেজ অধ্যুষিত ভারতবর্ষ আর তার প্রতিবেশী দেশ চিনের তখন ছিল মৈত্রেয়ীর সম্পর্ক। জাপান বিরোধী যুদ্ধে, ইংরেজদের নেতৃত্বে, চিনের কাছে স্থলপথে এবং আকাশপথে সমস্ত রকম মদত পৌঁছে যেত ভারতবর্ষ থেকে। এ অবস্থায় জাপানীর বুঝেছিল, এই মদতচুক্তির প্রাণকেন্দ্র কলকাতাকে ধ্বসিয়ে দিতে পারলেই তাদের যুদ্ধজয়ের পথে একটা বাধা কমবে। মোদ্দা ব্যাপার, ভারতের সাথে চিনের সমস্তরকম যোগাযোগ ছেঁটে ফেলতে চাইছিল তারা। অতএব, 'লাগাও হুজ্জুত, চালাও চাকতি'।
আরও পড়ুন-বাঙালির ইয়েতি অভিযান, সিনেমা নয়, এই গল্পটা সত্যিই…
শহরের বুকে আকাশপথে প্রথম বোমাবর্ষণ হল ২০ ডিসেম্বর, ১৯৪২। বিস্ফোরণ ঘটাল ‘ইম্পেরিয়াল আর্মি জাপানিজ এয়ারফোর্স’, বা ইজেএএফ। প্রথমে তাদের লক্ষ্য ছিল হাওড়া ব্রিজ এবং নৌ-বন্দরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে করে কলকাতাকে পরিণত করা যায় সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটা শহরে। পুরোপুরি সফল তারা হয়নি, কিন্তু কলকাতাবাসীর জীবনে নেমে এসছিল ঘোরতর বিপর্যয়। আকাশে তখন বিমানের হানাদারি। একদিকে জাপান, অন্যদিকে ব্রিটেন। সন্ধে হলেই কমে আসে আলোর ওজন। ঘরের বাতিতে লেগে যায় কাগজের ঢাকনা। রাস্তাঘাটে ব্ল্যাক আউট। ভৌতিক অন্ধকারে ডুবে থাকে আনন্দনগরী। ফস্কা গেরো রুখতেই ইংরেজ প্রশাসনকে সেদিন এই বজ্রআঁটুনির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
এরোপ্লেন থেকে অন্ধকার শহরের রাস্তাঘাট চিহ্নিত করা সম্ভব নয় জাপানি পাইলটদের পক্ষে, এভাবেই হয়ত রোখা যাবে বিস্ফোরণ। এমনটাই হয়ত ভেবেছিল তারা। এমনকী জাপানি বিমানকে প্রতিহত করতে আকাশে হিলিয়াম বেলুন ওড়ানোর ব্যবস্থাও তারা করেছিল। শোনা যায় কিন্তু শেষরক্ষা সব ক্ষেত্রে হয়নি। বোমার আঘাতে ধ্বসে পড়েছিল খিদিরপুর ডক, ময়দান, প্রাণ যায় বহু মানুষের। ১৯৪২ সালের ৫ ডিসেম্বর দিন দুপুরে ঢালাও বোমাবর্ষণ হয়েছিল হাতিবাগানে। ৪২ জনের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত হয়েছে সেই সময়ের নানা জার্নালে।
এভাবেই চলেছে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। তারপর, মৃতদেহের স্তুপের উপর শান্তির বার্তা নিয়ে ছেদ পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, বোমাবর্ষণ থামল । শহরের বুকের ক্ষতচিহ্নটা আজ বিস্মৃতপ্রায়। প্রবাদ প্রবচনের অনেক গভীরে জেগে আছে এই ত্রস্তদিনগুলির দলিল। সা রে গা মা পা ধা নি মানে যেন প্রতিদিনের ভয়, বোমা পড়ার ভয় ভয়।
আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতির অতল কোঠাঘরে লুকিয়ে থাকা সেই ভয়ের প্রচ্ছায়া হানা দিয়েছিল বছর তিনেক আগে, কলকাতা বন্দর থেকে যখন উদ্ধার করা হয়েছিল ৪৫০ কেজির একটি বোমা। বিশেষজ্ঞরা রায় দিয়েছিলেন, এ বোমা খোদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার। তার অকেজো খোলসে নাকি রয়েছে ব্রিটেন, জাপান, আমেরিকার যুদ্ধকথার সম্মিলিত স্মৃতি। এভাবেই তো ইতিহাস ফসিল নির্মাণ করে। কালের অলাতচক্রে তার ক্ষতচিহ্নের উপর লেগে থাকে বিস্মৃতির প্রলেপ। এক সভ্যতা ফুরিয়ে আসে, তার জঠর থেকে জন্ম নেয় আরেক সভ্যতা।
'তবুও মানব থেকে যায়।'