প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু সাপের ছোবলে! আতঙ্ক বাড়াচ্ছে নতুন গবেষণা

Snakebite in India: ফি-বছর সাপের কামড়ে ভারতে ৫৮ হাজার মানুষের জীবনহানির ঘটনা ঘটছে।

শিবঠাকুরের আপন দেশ ভারত। পশুপতির দেশে সাপের উপদ্রব গুরুতর এক সমস্যা। সাপের কামড় তো আছেই, সেইসঙ্গে আছে সাপের কামড়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। তবে সরকারি হিসেবে সর্পাঘাতে মৃতের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে দেখা হয় বলে্ স্বেচ্ছাসেবীদের অভিযোগ।

সাপে কাটা পড়ে প্রতিবছর ভারতে কত মানুষের মৃত্যু হয় এনিয়েও অবশ্য সমীক্ষা চালানো হয়েছে। যেমন, 'সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ' নামে একটি সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ফিবছর সাপের কামড়ে ভারতে ৫৮ হাজার মানুষের জীবনহানির ঘটনা ঘটছে।

দেশের কয়েকটি রাজ্যে সাপের উপদ্রব অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় অনেকই বেশি। এই রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাত। দক্ষিণ ভারতের একাধিক রাজ্যেও সর্পাঘাতে বহু মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা সেই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।

আরও পড়ুন: কোথাও বেদম প্রহার, কোথাও উদ্দাম চুম্বন || বিয়ের এসব লোকাচার জানলে বিস্মিত হবেন 

যে রাজ্যগুলিতে সাপের কামড়ে বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণনাশের ঘটনা ঘটছে, সেক্ষেত্রে সর্পঘাতের ঘটনাগুলি ঘটছে গ্রামীণ এলাকায়। অন্তত ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি। 'সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ' জানিয়েছে, সর্পঘাতের অর্ধেক ঘটনা ঘটছে বর্ষাকালীন সময়ে। বিশেষত, জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সর্প দংশনে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে, শীতকালে সর্পাঘাতের ঘটনা কমছে।

সমীক্ষালব্ধ তথ্য অনুসারে, ভারতে গ্রামীণ এলাকায় সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা সর্বাধিক। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ পুরুষ আর ৪১ শতাংশ মহিলা। বহুক্ষেত্রেই আক্রান্তদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলছে না। সাপের ছোবল খাওয়া রোগীদের জন্যে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রতিষেধকের ব্যবস্থাও এদেশের হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে নেই। বারংবার এই অভিযোগ উঠলেও কার্যত কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

ভারতের গ্রামীণ এলাকায় সর্পাঘাতের যে ঘটনাগুলি ঘটছে তার বলি হচ্ছে প্রধানত কৃষক সম্প্রদায় অথবা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। অনেকক্ষেত্রেই গভীর রাতে শৌচকর্ম করতে গিয়েও সপ্র দংশনে প্রাণ হারাচ্ছেন গ্রামবাসীরা। এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে হলে চাষাবাদের সময়ে রবারের বুট কিংবা গ্লাভস ব্যবহার করাই নিরাপদ বলে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

সারা পৃথিবীজুড়েই সাপের উপদ্রব চালু ঘটনা। তবে ভারতে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র পরিসংখ্যান অনুসারে, সারা পৃথিবীতে মোট ৫ লক্ষ সর্পাঘাতের ঘটনা ঘটছে। সাপের দংশন অবহেলিত 'ট্রপিক্যাল ডিজিজ'-এর অন্তর্গত। এদিকে বিষধর সাপের ছোবলে প্রতিবছরে সারা পৃথিবীতে যত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সেই তালিকায় ভারত শীর্ষে।

ভারতে মোট ২৭০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর ভিতর কিছু প্রজাতির সাপ অত্যন্ত বিষধর। বিষধর সাপ কামড়ালে প্রাথমিক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেসম্পর্কে প্রচারেরও অভাব রয়েছে।

গত দু'দশকে ভারতে সাপের কামড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। গত দু'দশকে ১০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে কেবল ভারতেই। এই তথ্য জানা গিয়েছে 'সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ' সূত্রে।

এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার সাপের কামড়ে মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে। এপ্রসঙ্গে কেন্দ্র যে পরিসংখ্যান পেশ করছে তাতে ফিবছর ভারতে সর্পঘাতে মৃতের সংখ্যা এক হাজারেরও কম বলে দাবি করা হয়েছে।

এব্যাপারে মুম্বইভিত্তিক সংস্থা 'স্নেকবাইট হিলিং অ্যান্ড এডুকেশন সোসাইটি'র তরফে অভিযোগ করা হয়েছে, অন্যান্য অসুখ-বিসুখ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে। কিন্তু দুভার্গ্যজনক ব্যাপার এই যে সর্প দংশন সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য নেই।

ভারতে সাপের কামড়ে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের বেঘোরে প্রাণনাশ প্রতিরোধ করা সম্ভব হত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই। এব্যাপারে ওয়াকিবহাল মহলের মতে, গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে বর্তমানে সাপে কাটা রোগীদের জন্যে প্রতিষেধকের অভাব এক্ষেত্রে এক বিরাট সমস্যা। অনেকক্ষেত্রেই সর্পঘাতের ঘটনাগুলি ঘটছে রাতের অন্ধকারে গ্রামাঞ্চলের পথে-ঘাটে।

অন্ধ্রপ্রদেশের ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির পেশ করা তথ্যানুসারে, ৬৮ শতাংশ ক্ষেত্রে সাপ দংশন করছে পায়ে। আর ২১ শতাংশ ক্ষেত্রে দংশন হাতে। সাপ এমন এক প্রাণি যে শুনতে পায় না। তবে মানুষের পায়ের শব্দে অস্তিত্ব টের পায় সাপেরা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দারা রাতে পথেঘাটে বেরোলে সঙ্গে আলো রাখলে সর্পদংশনের বিপদ থেকে অনেকটাই রক্ষা মিলবে।

সাপের দংশন থেকে রক্ষার উপায় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে প্রতিবছরই ১৬ জুলাই পালিত হয় 'ওয়ার্ল্ড স্নেক ডে'। আবিশ্ব যে সাপের বংশ ছড়িয়ে রয়েছে সেসম্পর্কে মানুষের জ্ঞানগম্যি জাগানোই 'ওয়ার্ল্ড স্নেক ডে'-এর উদ্দেশ্য। তবে এই উদ্দেশ্য ভারতে এতদিন পর্যন্ত সরকারি ঔদাসীন্যের কারণেই বাস্তবায়িত হয়নি, এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

সম্প্রতি কর্নাটক সরকার বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী বেঙ্গালুরুতে 'অ্যান্টি-ভেনম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট সেন্টার'-এর শিলান্যাস করেছেন। আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই সেন্টারটি পুরোদমে কাজ করবে। ফলে আশা করা যেতে পারে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে খানিক উন্নত হতে চলেছে। বর্তমানে সাপে কাটা রোগীদের প্রতিষেধকের বেশিরভাগটাই তৈরি হয় চেন্নাইতে।

যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এপর্যন্ত সর্প দংশনে মৃত্যু রুখতে সদর্থক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। 'নিউ ইন্ডিয়া'র স্বপ্ন কি কার্যত প্রহসন পরিণত হলো?

সারা ভারতের মধ্যে উড়িষ্যাতে সাপের উপদ্রবে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ। এছাড়া গবেষকরা জানিয়েছেন, আবিশ্ব যে ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ সর্প দংশনে আক্রান্ত হন এর মধ্যে বেশিরভাগ দেশই নিম্ন আয় অথবা মধ্য আয়ের দেশ। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় সাপের কামড়ের ঘটনা অহরহই ঘটছে।

সবচেয়ে বেশি সর্প দংশনের ঘটনা ঘটছে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। প্রসঙ্গত, সারা পৃথিবীতে ৩ হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর ভেতর ৬০০ প্রজাতির সাপ বিষধর।

সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে, ভারতে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে যত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয় তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সাপের কামড়ে।

More Articles