লক্ষ লক্ষ মানুষ থাকবেন অনাহারে! সোমালিয়ায় কেন ঘনিয়ে এল দুর্ভিক্ষের কালো মেঘ

famine in somalia : সে দেশে আজ শুধুই অনাহার, দুর্ভিক্ষ, এবং খরার মতো প্রতিকূলতা

বিধ্বস্ত সোমালিয়া। গত কয়েক শতাব্দী ধরেই প্রবল দুর্ভিক্ষে ভারাক্রান্ত হলেও এই বছর এর প্রভাব সব থেকে বেশি। সারা বিশ্বব্যাপী খাদ্যের যে পরিমাণে দাম বেড়েছে তাতে ভুক্তভোগী এখানকার সাধারণ মানুষ। অনুমান করা যায়, শুধুমাত্র খাবারের অভাবে সবথেকে বেশি পরিমাণে মানুষ মারা যাবে এই দেশে। বাদ পড়বে না সদ্যোজাতরাও। পূর্ব আফ্রিকার প্রায় শেষ প্রান্তের দেশ সোমালিয়া । যা পাহাড় এবং মরুভূমি ছাড়াও ১৬ কোটি মানুষের আবাসনস্থল। রোমান সাম্রাজ্যের আগে পর্যন্ত এই দেশের একটি সমৃদ্ধশালী ইতিহাস ছিল। তবে এখন সেসব আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে দেশে আজ শুধুই অনাহার, দুর্ভিক্ষ, এবং খরার মতো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রয়াস করে চলেছেন সাধারণ মানুষ।

২০১১ সালে খাদ্যাভাবের কারণে সোমালিয়ায় এক চতুর্থাংশেরও বেশি লোকের মৃত্যু হয় , যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু। ২০১১ সালের এই ঘটনার পর সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল যাতে আগামী দিনগুলিতে এর পুনরাবৃত্তি আর না হয়। যদিও তাতে আটকানো যায়নি সমস্যা। সম্প্রতি জাতিসংঘের সমীক্ষায় জানানো হয়েছে যে, সোমালিয়ায় এ বছর প্রায় তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হতে পারেন। আর আগে ২০১৭ সালে প্রথমবারের জন্য দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল সোমালিয়ায়। তবে কোনও দেশের সরকার এককভাবে কখনওই একটি জায়গাকে দুর্ভিক্ষপীড়িত ঘোষণা করতে পারে না, তার জন্য প্রয়োজন হয় সেই দেশের সরকার এবং জাতিসংঘের যৌথ সম্মতির। তবে এছাড়াও যে বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয় সেগুলি হল;

আরও পড়ুন : হু হু করে পতন জনসংখ্যায়, কেন এই অবস্থা চিনের?

একটি দেশে দুর্ভিক্ষ কখন ঘোষণা করা হয়?

বিপুল পরিমাণে খাদ্য সংকট, অনাহারে মৃত্যু এবং পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে যখন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখনই সাধারণ মানুষ এটিকে দুর্ভিক্ষ আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে জাতিসংঘের মতে, ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল যদি তিনটি শর্ত পূরণ করে তবেই সেই জায়গা দুর্ভিক্ষপীড়িত বলে ঘোষণা করা হবে ।

১. মোট জনসংখ্যার অন্তত ২০% মানুষ চরম খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হলে।
২. যদি কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শিশু তীব্র পরিমাণে অপুষ্টিতে ভোগে।
৩. নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রতি ১০০০০ জন বাসিন্দার মধ্যে যদি অন্তত দুজন প্রতিদিন অনাহারে বা মারাত্মক খাদ্যাভাবে মারা যান।

ক্রমাগত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তবু সরকার থেকে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হলো না কেন ?

যে কোন দেশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণার সিদ্ধান্ত সাধারণত সরকার এবং জাতিসংঘ যৌথভাবে নিয়ে থাকে। তবে একটি দেশে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হলে তা নিয়ে তৈরি হয় নানারকম রাজনৈতিক বিতর্ক। কারণে সেক্ষেত্রে বিরোধী দল শাসক দলের অক্ষমতার দিকগুলি তুলে ধরে, তার জেরেই তৈরি হয় নতুন বিতর্ক। ঠিক এই কারণেই সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসান শেখ মোহামুদের নবনির্বাচিত সরকার দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করতে ইচ্ছুক নন কারণ তাদের মতে এটি জনসমর্পণকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এছাড়াও তাদের ধারণা দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করলে যে সমস্ত বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন তারা পুনরায় বিনিয়োগ করতে পিছিয়ে যাবেন এবং বৈদেশিক দেশগুলির সঙ্গে যে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের প্রকল্প রয়েছে সোমালিয়ার তাতেও প্রভাব পড়তে পারে। তবে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট মোহামুদ স্বীকার করেছেন যে, ডিসেম্বরের মধ্যে সোমালিয়ার কিছু অংশে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা গুরুতর। ওয়াশিংটনে থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ -এর একটি অনুষ্ঠানে মোহামুদ বলেন , “ কিছু ঘটনা সত্যি হলেও যেমন সব সময় স্বীকার করা যায় না, তেমনই দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে এই কথা স্বীকার করা একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ । যা শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্তদের প্রভাবিত করবে তাই নয়, উপরন্তু দেশের উন্নয়নেও অনেক বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি হবে"।

আরও পড়ুন : এই মুহূর্তে বিশ্বে অনাহারে ভুগছেন কত মানুষ! পৃথিবী জুড়ে খাদ্য সংকট নিয়ে মিলল বিস্ফোরক তথ্য


সোমালিয়া কেন আরেকটি দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হলো ?

বলা যেতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনই হল এই দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ। সোমালিয়ার পাশের দুই দেশ ইথিওপিয়া এবং কেনিয়াতে বিগত পাঁচ বছরে বর্ষার ছিটেফোঁটাও হয়নি ফলে উৎপাদন হয়নি পর্যাপ্ত ফসল। এছাড়াও টানা দুবছর করোনা মহামারীর কারণে বন্ধ ছিল সমস্ত কিছুই। এমতাবস্থায় দাড়িয়ে আবারও দেশে তীব্র আকার ধারণ করছে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। অন্যদিকে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসনের পর শস্য, জ্বালানি ও সারের দাম বেড়ে হয়েছে আকাশছোঁয়া। যার ফলে সোমালিয়ার মানুষের অনাহার বেড়ে দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে কারণ এই দেশ প্রায় ৯০% গমের জন্যই রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ওপর নির্ভশীল। সাধারণ মানুষের মুখে শুধু একটাই কথা। খাবার নেই, জল নেই... জীবন বাঁচানোই একমাত্র দায় হয়ে ঠেকেছে। 

situation at somalia

দুর্ভিক্ষ আসন্ন সোমালিয়ায়

বিগত তিন দশক ধরেই রাজনৈতিক অরাজকতার সম্মুখীন সোমালিয়া, ফলে ধ্বংস হয়েছে  উত্তরাংশের সবুজ। ইতিমধ্যেই প্রায় চারবার এখানকার মানুষ নানারকম ভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে খরার কারণে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে পঞ্চমবারও খরার সম্মুখীন হতে চলেছে সোমালিয়া। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে যে দুটি দেশ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম সোমালিয়া। দ্বিতীয় নাইজের। তবে খাদ্য সংকটের প্রসঙ্গ এলে বাদ পড়ে না ভারতও। করোনা মহামারীর কারণে যখন ধনকুবেররা আরও ধনী হয়েছে তখন তার ঠিক উল্টোদিকেই হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতের স্থান হয়েছে ১০৭। যদিও সোমালিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু বেশিই ভয়ংকর কারণ এখানে একটা সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয় আরেকটা।এমতাবস্থায় সমগ্র দেশের যৌথ প্রচেষ্টাই একমাত্র পারে এই সোমালিয়াকে মৃত্যুপুরী হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে।

More Articles