গেলে কেউ ফিরে আসে না, হিমাচলের এই উপত্যকা যেন মৃত্যুফাঁদ

অপরূপ সব স্থানগুলোর মধ্যে একটি উত্তরের হিমাচল প্রদেশের কাসোল। এই গ্রামের অপূর্ব সৌন্দর্য ছাড়াও আরও অনেককিছুই রয়েছে। বিশেষ করে দুর্গম পথে যাঁরা অভিযানে নামতে চান, তাঁদের জন্য স্বর্গরাজ্য কাসোল।

হিমাচল প্রদেশ প্রকৃতির রূপসাগর। একবার দেখলে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে তার অতলে। হিমাচল প্রদেশ নিঃসন্দেহে একটি অপূর্ব এবং জনপ্রিয় হলিডে ডেস্টিনেশন, এবং প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি অনন্য কারণ রয়েছে। বারবার সৌন্দর্যের জন্য সবাই ছুটে যায় এর কোলে। এদিকে, পার্বতী উপত্যকা হলো এক নৈসর্গিক ল্যান্ডস্কেপ এবং অবসরের হটস্পট। ভারতের আমস্টারডাম নামেও পরিচিত। চরস নামক মাদক দ্রব্য চাষের কারণেও এর অন্য সুনাম আছে, তবে সে যাইই হোক, যতই তাকে ভারতের বিদ্রূপের রাজধানী বলা হোক না কেন, আপনি কি জানেন, এই পার্বতী উপত্যকা ঈশ্বরের দর্শন আর তার ফিরে আসার পৌরাণিক কাহিনিতে ভরপুর। অনেকেই একে ঈশ্বরের দেশ হিসেবে কল্পনা করেন।

কী এই পার্বতী উপত্যকা
হিমাচল প্রদেশের কুল্লু থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত এই উপত্যকা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিয়াস নদী। বছরের দু'টি সময় ভিন্ন রূপ দেখা যায় এই ভ্যালির। পাইন, দেবদারু গাছে ঘেরা এই উপত্যকা গরমে ভরে ওঠে সবুজে। আর শীতে আকাশ থেকে ঝরে পড়া বরফকুচি লেগে থাকে গাছের ডালে, ডালের পাতায়, গাছের নিচে, সবুজ মাঠে, বাড়ির ছাদে। পাহাড়ি পথে বাহারি সাদা বরফের পুরু মোড়কে সাদা আর সবুজের গা মাখামাখি সখ্যর সেই সৌন্দর্যও কম নয়।

পার্বতী উপত্যকা! এখানে জমিয়ে সংসার পেতেছেন মাতা পার্বতী। স্বামী, পুত্র, কন্যা নিয়ে সুখের সংসার তাঁর। দেশ-বিদেশের শিবভক্তের ভিড় এই উপত্যকায়। তবে, সবাইকে ছাপিয়ে এখানে বিরাজ করছেন দেবী পার্বতী স্বয়ং। উপত্যকা ভেদ করে তাঁর বয়ে চলা। এখানে তাঁর মুখোমুখি হওয়া অভিজ্ঞতাই বটে!

আরও পড়ুন: দেওয়ালজুড়ে খোদাই করা রামায়ণ, ফিরে যাওয়া যায় অতীতে, ঘুরে আসুন ইতিহাসে মোড়া হাম্পি-তে

পার্বতী ভ্যালির ইতিহাস যেমন আকর্ষণীয় তেমনি পুরনো। ৫০০-৬০০ বছর নয়, বরং পার্বতী ভ্যালির ইতিহাস ৩ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই উপত্যকায় বসে নাকি ভগবান শিব ৩০০০ বছর ধরে ধ্যান করেছিলেন। তিনি এখানে নাগা সন্ন্যাসী সাধু রূপে ধ্যান করতেন। কথিত আছে, ধ্যান ভাঙার পর চোখ খুলে তিনি এই উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সর্বপ্রথম তার নিজের স্ত্রী পার্বতীর নাম উচ্চারণ করেন। সেই থেকেই এই উপত্যকা ‘পার্বতী উপত্যকা’ নামে খ্যাত।

পার্বতী উপত্যকার মনোরম দৃশ্য পর্যটকদের মন জয় করতে বাধ্য। এই উপত্যকাতেই রয়েছে কাসোল, মালানা, তোশ, মণিকরণ, ক্ষীরগঙ্গার মতো পর্যটন কেন্দ্র। এর মধ্যে মণিকরণ আর ক্ষীরগঙ্গা হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জনপ্রিয়। এদের নেপথ্যেও আছে কিছু পৌরাণিক কাহিনি।

মালানা নিয়ে কাহিনি
কুল্লু উপত্যকার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মালানা গ্রামের কথা খুব কম মানুষই জানেন। এই গ্রামটি শুধু প্রাচীনই নয়, খুব সুন্দরও বটে। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িত এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যার সম্পর্কে খুব কম পর্যটকই জানেন। পার্বতী উপত্যকার প্রায় ৯,৯৩৮ ফুট উঁচুতে এই গ্রামের ইতিহাস ও সৌন্দর্য দুটোই বেশ রোমাঞ্চকর। ট্রেন বা বাসে করে এই গ্রামে পৌঁছনোর কোনও সুবিধা নেই। এখানে যেতে গেলে আপনাকে ট্রেক করেই পাড়ি দিতে হবে। তবে এখানে আসা পর্যটকদের বেশিরভাগই বিদেশি।

বলা হয়, মালানা গ্রামের মানুষরা নাকি নিজেদেরকে আলেকজান্ডারের বংশধর বলে মনে করেন। কথিত আছে, আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করতে আসেন তখন তিনি তার সৈন্যদের সঙ্গে এই গ্রামে আশ্রয় নেন। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয়ের পর আলেকজান্ডার এখান থেকে চলে গেলেও অনেক সৈন্যই এখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। এই গ্রামের মন্দিরে আলেকজান্ডারের সময়ের একটি তলোয়ার আছে। শুধু তাই নয়, এখানকার মানুষ না কি ভিন্ন ভাষায় কথা বলে যা ভারতে আর কোথাও শোনা যায় না। এই ভাষার নাম ‘কানাশী’। এবং এই ভাষা বাইরের লোকেদের শেখানো নিষিদ্ধ।

মণিকরণের ইতিহাস

দু’পাশে খাড়াই পাহাড়। মাঝে পার্বতী উপত্যকা। খরস্রোতা পার্বতী নদী পাথরে বাধা পেয়ে ভয়ংকরী হয়ে বয়ে চলেছে সেখানে। ভুন্টারে গিয়ে সে মিশেছে বিপাশার সঙ্গে। হাড় হিম হয়ে আসে তার উচ্ছলতা দেখে। সমুদ্রতল থেকে ১৭৬০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত মণিকরণ। হিন্দু পৌরাণিক মত অনুসারে, একবার শ্রী মহাদেব ও মা পার্বতী এই স্থানে ভ্রমণ করতে আসেন।এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে তাঁরা এখানে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। সময়টা পৃথিবীর হিসেবে প্রায় এগারোশো বছর। কথিত আছে যে, এখানে মা পার্বতী তাঁর অলংকারের একটি দামি মণি হারিয়ে ফেলেন। মণিটি নদীতে তলিয়ে পাতালে শেষনাগের কাছে চলে যায় ও তিনি সেটি কুক্ষিগত করেন। মা পার্বতী শ্রী মহাদেবের কাছে তাঁর মণিটি উদ্ধারের প্রার্থণা করেন। মহাদেব তাঁর সঙ্গীদের প্রেরণ করেন মণি উদ্ধারের জন্য। কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হন। প্রচণ্ড রাগে মহাদেবের তৃতীয় চক্ষু উন্মোচিত হয়। সারা জগৎ সংসার ছারখার হবার উপক্রম হয়। ফুটতে শুরু করে পার্বতী নদীর জল। শেষে কুপিত মহাদেবের সামনে উপস্থিত হন শেষনাগ। মা পার্বতীর মণি ফিরিয়ে দেন। কিন্তু মহাদেবের রাগ কমলেও, নদীর জল আজও ফুটন্ত‍। মানুষের বিশ্বাস মণিকরণের এই উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়, শুধু তাই নয়, শরীরের কোথাও কোনও ব্যথা-বেদনা থাকলে সেটারও উপশম হয়।

মণিকরণ গুরুদ্বারা

শিখ পুরাণ অনুসারে শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক তাঁর ভাই মারদানাকে সঙ্গে নিয়ে এই মণিকরণে এসেছিলেন। এখানে এসে মারদানার খিদে পেয়ে যায় কিন্তু তাদের কাছে কোনও খাবার না থাকায় গুরু নানক তার ভাইকে লঙ্গর থেকে কিছু ময়দা নিয়ে আসতে বলে। মারদানা লঙ্গর থেকে ময়দা এনে তা রুটির আকারে গড়ে নেয়, কিন্তু কোনও আগুন না থাকলে রুটি হবে কী করে। সে তার দাদা গুরু নানকের দিকে চাইলে তিনি মারদানাকে যে কোনও একটা পাথর তুলে নিতে বলেন। সেই পাথর তোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় সেখানে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ তৈরি হয়ে গেছে। এরপর গুরু নানকের কথা অনুযায়ী মারদানা সেই রুটিগুলি ওই উষ্ণ প্রস্রবনে দিলে তা ডুবতে শুরু করে।

অবাক হয়ে মারদানা গুরু নানকের দ্বারস্থ হলে তিনি বলেন, ভগবানের প্রার্থনা করো আর এটা বলো যে, যদি তোমার রুটি ভেসে ওঠে তাহলে তুমি সেই রুটির থেকে একটি রুটি ভগবানকে দান করবে। এইভাবে প্রার্থনা করার পর মারদানা দেখে যে তার সব রুটি ভেসে উঠেছে। অবশেষে গুরু নানক এই শিক্ষা দিলেন যে, এখানে এসে যে কেউ ভগবানকে কিছু দান করবে, সে তাই ফিরে পাবে। তাঁর এই স্থানে আসাকে স্মরণীয় করে রাখতেই মণিকরণে গুরুদ্বারা মণিকরণ সাহিব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ক্ষীরগঙ্গার কাহিনি

কথিত আছে বহু বছর আগে, শিব আর পার্বতীর ছোট ছেলে কার্তিক এই ক্ষীরগঙ্গায় এসে ১০০০ বছর ধরে ধ্যানে বসেন। কার্তিক থাকাকালীন শিব এবং পার্বতী মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসতেন এবং পার্বতী আসার সময় কার্তিকের জন্য সুস্বাদু পায়েস বানিয়ে আনতেন। তাই লোককথা অনুযায়ী, এই এলাকা দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা নদীর রং ধূসর।

তবে এত মনোরম দৃশ্য হওয়া সত্ত্বেও পার্বতী ভ্যালি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। আমেরিকার জাস্টিন আলেকজান্ডার-সহ আরও অনেক পর্যটককে আধ্যাত্মিকতা, মাদকতার নেশায় ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্ধকারে, যেখান থেকে তারা আর ফিরে আসেনি। কেউ কেউ একে ‘ভারতের বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল’ বা ‘ডেথ ভ্যালি’ বলেও মনে করে। ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর দিল্লির এক যুবক ধ্রুব আগরওয়াল এই উপত্যকায় গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ৯ নভেম্বর ওখানে পৌঁছে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে শেষ বারের মতো কথা বলেন তারপর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি। তবে ধ্রুবর ঘটনাই প্রথম নয়। ২০১৬ সালে হাই প্রোফাইল কেস হিসেবে জাস্টিন আলেকজান্ডারের নিখোঁজের কথা পুরো হিমাচল প্রদেশকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। যদিও কোনও সঠিক তথ্য নেই যে, ঠিক কতজন নিখোঁজ, তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট ২১ জন বিদেশি পর্যটক পার্বতী ভ্যালির কোলে হারিয়ে গেছেন চিরতরে।

পার্বতী ভ্যালির রাস্তা থেকে শুরু করে হোটেল, মন্দির সব জায়গায় নিখোঁজ মানুষের পোস্টারের ছড়াছড়ি। প্রশাসকের কথায়, সবাই যখন এখানে আসে, তারা কিছু অজানার নেশায় ছুটে আসে। মালানা গ্রামের তামাক বিশ্ববিখ্যাত, তারা তা একবার টেস্ট করার লোভে ছুটে যায় সেদিকে। ২০০০ সালে, জার্মানির দু'জন হাইকার ক্যাম্পিং করার সময় গুলিবিদ্ধ হন এবং একজন তাঁর জীবন হারিয়েছিলেন। সেই বছরই আরেকটি হামলায়, ক্ষীরগঙ্গা ও মনতালাই লেকের মধ্যে ক্যাম্পিং করার সময় এক দম্পতি এবং মহিলার চোদ্দ বছরের ছেলের ওপর হামলা হয়। তাঁদের মৃতদেহ একটি খাদে ফেলে দেওয়া হয়। নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ পুরুষের বয়স বিশ ও ত্রিশের দিকে, যারা প্রধানত দুঃসাহসিক ভ্রমণকারীর প্রোফাইলে ফিট করে। এই প্রোফাইলটি আরেকটি তত্ত্বের দিকে পরিচালিত করেছে যে, একজন সিরিয়াল কিলার কয়েক দশক ধরে বনের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকে ক্যামেরা এবং পাসপোর্ট, মাদক এবং নগদ অর্থের মতো মূল্যবান জিনিসপত্র বহন করা শিকারির আশায়। কেউ কেউ অনুমান করেন যে, হত্যাকারী একজন হিন্দু পবিত্র মানুষ, আবার অন্যরা বিশ্বাস করেন যে, সে একজন বিদেশি, যিনি সরলভাবে মানুষের সাথে মিশে যেতে পারেন। পার্বতী ভ্যালির পুলিশ যদিও এই সিরিয়াল কিলার নিয়ে ভাবতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, যারা এই কাজ করছে তারা নিঃসন্দেহে এই মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এইভাবে বছরের পর বছর ধরে চলছে হারিয়ে যাওয়ার খেলা।

অবশেষে বলতে হয়, ভারত এমন এক দেশ, যেখানে সব ধরনের স্থানের স্বাদ মেলে। উত্তপ্ত মরুভূমি যেমন আছে, তেমনই আছে বরফে আবৃত অঞ্চল। অপরূপ সব স্থানগুলোর মধ্যে একটি উত্তরের হিমাচল প্রদেশের কাসোল। এই গ্রামের অপূর্ব সৌন্দর্য ছাড়াও আরও অনেককিছুই রয়েছে। বিশেষ করে দুর্গম পথে যাঁরা অভিযানে নামতে চান, তাঁদের জন্য স্বর্গরাজ্য কাসোল।মণিকরণের কাছেই এক ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামের নাম, কাসোল, নিরিবিলিতে পাহাড়কে উপভোগ করার আদর্শ জায়গা।

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে কালকা মেলে করে চণ্ডীগড়। চণ্ডীগড় থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। হিমাচল প্রদেশে বাস সার্ভিস খুব ভালো। মানালিগামী বাসে চড়ে ভুন্টারে নামতে হবে। ভুন্টার থেকে বাসে করে কাসোল। এছাড়া দিল্লি হয়েও যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে দিল্লি গিয়ে, সেখান থেকে মানালির বাসে চড়তে হবে৷ এই বাসগুলো রাতে ছাড়ে দিল্লি থেকে৷ ভোরবেলা পৌঁছে যাবেন ভুন্টার।

পার্বতী ভ্যালি যাওয়ার ভালো সময়
পার্বতী ভ্যালির সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করার সবথেকে ভালো সময় হল এপ্রিল-জুলাইয়ের প্রথম দিক এবং মিড সেপ্টেম্বর-মিড অক্টোবর।

More Articles