হু হু করে ভারতে বাড়ছে ক্ষেতমজুরদের আত্মহত্যা, সরকারি তথ‍্য বাড়াচ্ছে আশঙ্কা

দৈনিক প্রতি দু'ঘণ্টায় অন্তত একজন কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যা করছেন।

ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। লাখ লাখ মানুষ কৃষিজীবী। এঁদের ভিতর সম্পন্ন কৃষকের তুলনায় দরিদ্র কৃষকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এই দরিদ্র কৃষকদের হাতে নিজস্ব জমি নেই। অন্যের জমিতে কৃষিমজুর হিসেবে কাজ করে কোনওমতে দিন গুজরান করতে হয় ওঁদের। ভারতে জিডিপি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কৃষির উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পেশ করা পরিসংখ্যান অনুসারে, দৈনিক প্রতি দু'ঘণ্টায় অন্তত একজন কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যা করছেন। ২০২১ সালে আত্মঘাতী কৃষিশ্রমিকের সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ৫,৫৬৩জনে।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট অনুসারে, ২০২১ সালে সারা দেশে মোট যে ৫,৫৬৩জন কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন তাঁদের মধ্যে ৫,১২১জনই পুরুষ। আর আত্মঘাতী মহিলা কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা এসে ঠেকেছে ৪৪২ জনে।

আরও পড়ুন: সন্তানের অত‍্যাচার সহ‍্য করেই বেঁচে রয়েছেন বেশিরভাগ ভারতীয় বাবা-মা! শিউরে ওঠার মতো তথ্য সামনে

দেশের যে রাজ্যগুলিতে কৃষিশ্রমিকের মৃত্যুর হার অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় বেশি, সেই রাজ্যগুলির মধ্যে তালিকার ওপরের দিকে রয়েছে মহারাষ্ট্র, কর্নাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশ। ২০২১ সালে কেবলমাত্র মহারাষ্ট্রেই আত্মহত্যা করেছেন ১,৪২৪ জন কৃষিশ্রমিক। এছাড়া কর্নাটকে ৯৯৯ জন এবং অন্ধ্রপ্রদেশে ৫৮৪ জন কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন।

দলে দলে আত্মঘাতী হওয়ার কারণও জানা গিয়েছে। প্রধানত তা দারিদ্র্যের অসহনীয় চাপ সহ্য করতে না পারা। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে-র রিপোর্ট অনুসারে, কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে একজন কৃষিশ্রমিকের মাসিক রোজগার সাকুল্যে ৪,০৬৩ টাকা। এদিকে রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। ফলে দরিদ্র মানুষের কপাল আরও পুড়েছে।

আত্মঘাতী হচ্ছেন কৃষকরাও। তবে কৃষক আত্মহত্যার হার কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যার চেয়ে কম বলে দাবি করছে সম্প্রতি প্রকাশিত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট। রিপোর্টে এই দাবি করা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে কৃষিশ্রমিকদের আত্মহত্যার হার খানিকটা বেশি।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্টে আরও দেখা যাচ্ছে, কৃষিকাজে নিযুক্তদের মধ্যে ২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছেন ১০,৮৮১জন। এই সময়সীমায় সারা দেশে আত্মঘাতী মানুষের সংখ্যা ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ৩৩ জন। মোট যত সংখ্যক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ৬ দশমিক ৬ শতাংশের বেশিই কৃষিজীবী মানুষ।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২১ সালে মোট যতজন দিনমজুর আত্মঘাতী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে প্রতি চারজন পিছু একজনই দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। কৃষিশ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে মহারাষ্ট্র দেশের মধ্যে প্রখম স্থানাধিকারী। মহারাষ্ট্রে মোট আত্মঘাতীর সংখ্যা ২২,২০৭ জন। আত্মহত্যার নিরিখে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্য তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশ। ২০২১ সালে তামিলনাড়ুতে ১৮,৯২৫ জন এবং মধ্যপ্রদেশে আত্মঘাতী নাগরিকের সংখ্যা ১৩,৫০০ জন।

দেশের যে রাজ্যগুলিতে কৃষক কিংবা কৃষিশ্রমিকের আত্মহত্যার হার শূন্য, সেই রাজ্যগুলির মধ্যে রয়েছে বাংলাও। এছাড়া বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, মণিপুর, উত্তরাখণ্ডের মতো কয়েকটি রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার হার শূন্য বলে দাবি করছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট। রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, শুধুমাত্র কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত দিনমজুররাই নন, অন্যান্য ক্ষেত্রে যাঁরা দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন, ২০২১ সালে তাঁদের মধ্যে অনেকেই আত্মঘাতী হয়েছেন।

দিনমজুরদের হাতে করোনা পরিস্থিতিতে কাজ না থাকায় ওঁদের অনেকেই শহর থেকে গ্রামে ফিরে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন খিদের তাগিদে। এসত্ত্বেও ন্যূনতম পারিশ্রমিক না জোটায় চরম অবসাদ এঁদের একাংশকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে বলে স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন।

২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে সারা ভারতেই আত্মঘাতী নাগরিকের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে। এব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবীদের পেশ করা তথ্যানুসারে, সারা দেশে ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতিতে আত্মঘাতী হয়েছেন ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ৫২ জন। এঁদের মধ্যে দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৭,৬৬৬ জন। পরিস্থিতি পরবর্তী বছরে আরও করুণ হয়েছে এও বলার অপেক্ষা রাখে না। চলতি বছরে হিসেব এখনও পাওয়া যায়নি। এজন্যে অপেক্ষা করতে হবে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরবর্তী রিপোর্টের ওপর।

কেন এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে? বিষয়টি খতিয়ে দেখে গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২০ সালে মার্চে বিনা বলা-কওয়ায় লকডাউন ঘোষণা করার পরে পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছেন। দূরদূরান্ত থেকে গ্রামে ফিরে এসে দিনের পর দিন বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মরণের অন্তিম পথই জীবন সংগ্রাম থেকে মুক্তির উপায় বলে মনে করেছেন ওঁরা। এর জেরে আত্মঘাতীর সংখ্যা বেশ কিছুটা বাড়তে শুরু করে ২০২০ সালের মার্চের পর থেকেই। আর এই আত্মঘাতীদের তালিকায় রয়েছেন মহিলারাও।

কৃষকরাই সমাজের অন্নদাতা। এদিকে দেশ স্বাধীনের ৭৫ বছর পরে কৃষিজীবীদের জীবনে যে দুর্বিপাক নেমে এসেছে তা স্বাধীনতা নামে শব্দটিরই অপমান!

গত মাসে এক পরিযায়ী শ্রমিকের গোটা পরিবার আত্মহত্যা করেছে। একই পরিবারের তিন সদস্য আত্মঘাতী হয়েছেন। এদের মধ্যে দু’বছরের এক শিশুকন্যাও রয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে তেলেঙ্গানায়। পরিযায়ী এই শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা মধ্যপ্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানায় কাজ করতে এসেছিলেন। কী কারণে শ্রমিক পরিবারের তিন সদস্য আত্মঘাতী হল সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।

দক্ষিণের আরেক রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশেও আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ২০২১ সালে ২০২০ সালের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেড়েছে বলে জানা গিয়েছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্টে। জানা গিয়েছে, ২০২১ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে ১,০৬৫ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। এর আগে ২০২০ সালে এই রাজ্যে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ছিল ৮৮৯ জন।

দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে দেশের আরেকটি রাজ্য হরিয়ানায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ সাল থেকেই হরিয়ানায় দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষদের ভিতর আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষদের ভিতর সারা দেশে আত্মহত্যার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়েছে।

More Articles