দেশভাগ তাড়া করেছে আজীবন, বেঁচে থাকায় কখনও আপস করেননি সুনীল

জীবনে বহু নিন্দা, কুৎসার ঢল নেমেছে, বহু আঘাত সহ‍্য করেও শান্ত থেকেছেন সুনীল।

নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশে স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে?

ঠিক কতটা বড় হলে শৈশবের স্বপ্নগুলো সত্যি হয়! কথা রাখা না-রাখার পৃথিবীতে পাঠকের মনে উঁকি দেয় এক প্রশ্ন, সত্যি কি কেউ কথা রাখে না? আসলে আমাদের স্বভাবধর্ম অনুযায়ী আনন্দর থেকে দুঃখটা বেশি মনে হয়। তাই ৩৩ বছর কেন, তারও বেশি সময় ধরে 'কেউ কথা রাখেনি' বললেই মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাসিমাখা মুখ। ভাদ্রের কাশফুল, পেঁজা তুলোর মেঘ মনে করায় পুজোর বাদ্যির কথা। আর সেই সেপ্টেম্বরেই গোটা বাংলাদেশ পেয়েছে নীললোহিতকে। ৭ সেপ্টেম্বর, তাঁর ৮৮ বছরের জন্মদিন। অধুনা বাংলাদেশের সেই ভিটেবাড়িটা মাটির, ওপরে টিনের ছাদ, বৃষ্টি পড়লে দারুণ সুর হতো। সেই বাড়ির সামনেই অস্থায়ী আঁতুড়ে মীরার কোল আলো করে এসেছিলেন সুনীল। তবে কথা না রেখেই পাঠকে বঞ্চিত করেই বিদায় নেন অচিরেই, ছন্দপতন হয়, সেও এক শারদীয়া আবহেই। একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজোর পাশে 'মেঘমল্লার' অ্যাপার্টমেন্ট থেকে দিকশূন্যপুরে শেষবারের মতো রওনা দিয়েছিলেন তিনি, ২০১২ সালের পুজোর নবমীর দিন।

কথা হোক কথা রাখা নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে। কেউ কেউ তো নিশ্চয়ই কথা রাখে। যে বোষ্টমীর শুক্লা দ্বাদশীর দিন আসার কথা ছিল, সেও আসেনি। আবার নাদের আলি যে তিন প্রহরের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই স্বপ্নও পূরণ হয়নি। কথা না-রাখার প্রতিটা পর্যায়কে তিনি চিনিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সত্যি কি কেউ কথা রাখে না? বরুণা রাখেনি... নীরাও কি তাই? পাঠক-হৃদয়ে সেই ভালবাসার নানা পরতকে কবি দেখিয়েছেন।

আরও পড়ুন: সুনীলকে সেদিন শামসুর রাহমান বলেছিলেন, কেউ কেউ কথা রাখে…

তাঁর এই কবিতার একটা যাত্রা রয়েছে, যা জীবন থেকে নিয়ে যায় অধিক জীবনের দিকে। তাই হয়তো কবি নবীন কিশোরকে দিতে চেয়েছেন ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ, চেয়েছেন আকাশের মতো বিস্তৃতি দিতে। 'ফুসফুস ভরা হাসি' কবি শুধু নবীন কিশোরকেই নয়, উপহার দিতে চেয়েছেন কবি।

গূঢ় অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মতো আর যা কিছুর বুক চিড়ে দেখা...

ভালবাসার উত্তরাধিকার তিনি দিয়ে গেছেন আগামী প্রজন্মের হাতে। তাঁর কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে জীবন এবং 'ছুরির ঝলস্' যা অভিমানের বুক চিরে টেনে আনে ভালবাসার নদী, দেশ ও নারী। সেই নবীন কিশোর, তরুণ কবিদের জন্য জন্ম হয় 'কৃত্তিবাস'-এর, ১৯৫৩ সালে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়-সহ একাধিক তরুণ লেখকদের পত্রিকা। তবে এখনও কান পাতলে শোনা যায় শক্তি-সুনীলের হরিহর আত্মার মতো বন্ধুত্বের কথা। শক্তিকে বকা দেওয়ার অধিকার একমাত্র ছিল সুনীলের। কখনও একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ মেনে নিতে পারেননি তিনি। দাদা গোছের লোকের মুখে এক মনে এক প্রবৃত্তিই তাঁকে রাজনীতিবিমুখ করেছিল। নকশাল নিয়েও ভিন্ন সুর ছিল তাঁর গলায়।

দেশভাগের বেদনা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত। অথচ পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে সুনীল ছিলেন মাত্র চার বছর। তাঁর বিশাল উপন্যাস ‘পূর্ব পশ্চিম’ পড়লে সেই হাহাকার টের পাওয়া যায়। এই উপন্যাসের অনেকখানিজুড়ে আছে বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রাম। উপন্যাসের মূল চরিত্র অতীন মালখানগরের। দেশভাগের ফলে সেই গ্রাম ফেলে উদ্বাস্তু হয়ে চলে গিয়েছিল কলকাতায়। মা মৃত্যুশয্যায়, ছেলে মাকে বলছে— ‘তোমার শেষ ইচ্ছে কী?’ মা বললেন, ‘আমাকে মালখানগরে নিয়ে যা।’ এই একটি বাক্যে দেশপ্রেমের গভীর টান উপলব্ধি করা যায়। 'পূর্ব পশ্চিম' জুড়ে তাই বারবার ফিরে ফিরে আসে দেশভাগ। কলকাতার কলোনিজীবন, নেহরুর মৃত্যু, নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে আটের দশকের প্রবাসী বাঙালি অতীন অনুভব করে মাটির অমোঘ টান।

আবার এই সুনীলই লিখছেন 'সেই সময়', উনিশ শতককে চেনাচ্ছেন পরতে পরতে। এই সুনীলই রবীন্দ্রজীবনের অকথিত অধ‍্যায়ে চোখ রাখছেন 'প্রথম আলো'-তে।

উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধে ঘেরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন। তাঁর সৃষ্টি বইয়ের পাতা ছাপিয়ে বড়পর্দাতেও সফল। সত্যজিত রায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি' কিংবা 'প্রতিদ্বন্দ্বী' তো বটেই, এখনও 'কাকাবাবু' সিরিজে সব বয়সের কাছে জীবন্ত হয়ে তিনি ধরা দেন পর্দায়।

১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'একা এবং কয়েকজন' প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ'। এরপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সুনীলের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা, 'আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি', 'হঠাৎ নীরার জন্য', 'রাত্রির রঁদেভু', 'অর্ধেক জীবন', 'অরণ্যের দিনরাত্রি', 'প্রথম আলো', 'সেই সময়', 'পূর্ব পশ্চিম', 'ভানু ও রাণু', 'মনের মানুষ' ইত্যাদি। ১৯৮৫ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন সুনীল।

শঙ্করলাল ভট্টাচার্যকে একটি সাক্ষাৎকারে সুনীল বলেছিলেন, "নিজের ওপর রাগ হয়, নিজের অপদার্থতা, ব‍্যর্থতা নিয়ে। কিন্তু অন‍্যের ওপর রাগ পুষে রাখলে নিজেরই ক্ষতি।" জীবনে বহু নিন্দা, কুৎসার ঢল নেমেছে, বহু আঘাত সহ‍্য করেও শান্ত থেকেছেন। থেকেছেন আনন্দে। ভোর চারটে থেকে লিখতে বসতেন, সন্ধে ছিল সজল আড্ডাখানা। মদ‍্যপান ও ধূমপানের মধ্য দিয়েও জীবনের শাঁসটুকু সঞ্চয় করেছেন ঠিক। বোহেমিয়ান জীবনে কখনও অগোছালো হয়ে যাননি তিনি, কিন্তু মনের মধ্যে বেঁচে থেকেছে তরতাজা নীললোহিত।

More Articles