সুনীলকে সেদিন শামসুর রাহমান বলেছিলেন, কেউ কেউ কথা রাখে...
মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী বর্ষ, ১৯৯৬ সাল। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ,"এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" এর ডাক দিয়েছিলেন। তখন নাম ছিল রেসকোর্সের মাঠ। সেই মাঠে রজতজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। অন্নদাশঙ্কর রায়, সাইমন ড্রিং, পি এন দার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় রায়ের সঙ্গে আমিও রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সভামঞ্চে আছি। অনুষ্ঠানের পরেই জনারণ্যের ভেতরে আমরা মিশে গেলাম শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে। অন্নদাশঙ্কর ফিরে যাবেন হোটেলে। শাহবাগ থেকে একটু এগিয়ে, ময়মনসিংহ রোডের শেরাটনে। তাঁকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাসের গালিচার উপরে বসে পড়লাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতায় আপ্লুত শামসুর রাহমান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বললেন. 'কেউ কেউ কথা রাখে'। সুনীলের, 'কেউ কথা রাখেনি' আমেজকে অন্য ভাবে উপস্থাপিত করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনঃস্থাপনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকাকে সশ্রদ্ধ চিত্তে শামসুর রাহমান স্মরণ করছেন।
আর সেইদিন সন্ধ্যায় গণভবনে রাষ্ট্রীয় অথিতিদের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে আপ্লুত শামসুর রাহমানকে তাঁর সেই জমজ কবিতা,'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা,' স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান' ঘিরে আবেগের স্মৃতিতে ভাসছেন ।রাষ্ট্রপ্রধানদের আহ্বানকরা এই ধরনের ভোজসভায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপচারিতাতেই নজর থাকে বেশি অতিথিদের। কিন্তু নরম পানীয়ের গেলাস নিয়ে শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন গণভবনের একটি নিভৃত সোফায় বসে কৃত্তিবাস যুগের নানান স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই দুঃসহ স্মৃতিকে ভুলতেই হয়তো শামসুর নিজেকে একটু আলাদা করেছেন ভিড়ের থেকে। মজা করেই তখন দৈনিক বসুমতির সাংবাদিক রণেন মুখার্জির কথা তুললাম। কৃত্তিবাস ওঝা নামে তিনি মুক্তিযুদ্ধ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়কে ঘিরে নানা ধরনের লেখালিখি করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সব রকমের বিধি-বিধানের ঊর্ধ্বে উঠে কবি চিরাচরিত আচরণেই সেখানে সবথেকে বেশি খুশি ছিলেন।তাই নানা মজাদার চুটকিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শামসুর।
শামসুরের বাড়িতে এলেন অন্নদাশংকর। তাঁর সেই শ্যামলীর বাড়ি চিনতে তখন আলো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল আমাদের একটি চিহ্ন। আসলে এই ধরনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নয়ের দশকের ঢাকায় খুব কম ছিল। তাই কবির বাড়ির ল্যান্ডমার্ক হিসেবে কবির নাম, কি কবি, কিন্তু সেখানে উহ্য করেই রাখতেন শামসুর।বারবার ওই আলো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কথাই উল্লেখ করতেন। তা না হলে বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানায় প্রবেশ করে শামসুর রহমানের বাসা কোথায় জানতে চাইলে, চেনাবার মানুষের অভেব হতো না।
কলকাতা থেকে অন্নদাশংকর বলে রেখেছিলেন, শামসুর জননীর হাতে মেটের বিভিন্ন ধরনের পদ খেতে তিনি অবশ্যই কবির বাড়িতে যাবেন। কবি জননী মেটের নানা ধরনের সুখাদ্য তৈরিতে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। কবি নিজের বসার ঘরে, নিজের টেবিলটা অন্নদাশংকরকে বসিয়েছেন। অন্নদাশংকর বারবার বলছেন, 'এই টেবিল চেয়ারে তোমারই বসা উচিত।' 'আপনার সামনে আমি না এই চেয়ারে বসতে পারি না। আপনি আগে, আমি অনেক পরে', আবেগভরা গলায় বললেন কবি। সেদিনের শ্যামলী কিন্তু আজকের মত এত জনবহুল ছিল না ।একটু ফাঁকা ফাঁকাই ছিল। শামসুরের প্রতিবেশী শামসুজ্জামান খানেরাও এসেছেন অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে। এক অসাধারণ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থনের আসর হয়ে উঠল কবির বৈঠকখানা সেদিন।
কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ম্যুলারোঁজ রেস্তোরাঁ, শামসুরের ইচ্ছে একটু মদ্যপানের। রয়েছেন প্রখ্যাত চিকিৎসক, লেখক ডাক্তার অভিজিৎ তরফদার। তিনি একটু পিউরিটান মানুষ। পান সম্বন্ধে তাঁর একটু নাক সিঁটকানো ভাব আছে। অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছি তাঁর সামনে 'পান ' শব্দটি উচ্চারণ করতে ।সবটা বুঝতে পেরেই শামসুর রাহমান এককথায় বানিয়ে ফেললেন একটি অনবদ্য ছড়া। 'মন্দ লোকেরা মদ খায়, আমরা থাকি ভদকায়।' তারপর আর অভিজিৎ তরফদারের পক্ষে কবিকে পানাহারের অনুমতি থেকে বঞ্চিত করা সম্ভব ছিল না। আর ডাক্তার তরফদারেরও এরপর নিজের নরম পানীয় চুমুক দেওয়ার অসুবিধা হয়নি।
কবিকৃতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে শামসুর রাহমানের যে দক্ষতা এবং গভীরতা, সেটি তাঁকে ঘিরে আলোচনার একটা ভিন্ন দিক। সময়ের মধ্যে বাস করে, সময়কে ধরে, মানুষের কবি হয়ে ওঠার যে অনবদ্য উদাহরণ শামসুর রাহমান দেখিয়ে গিয়েছেন, তেমনটা তাঁর সমকালে কয়জন দেখাতে পেরেছেন, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু তার পাশাপাশি একটা কথা খুব জোরের সঙ্গে বলতে হয় যে, সমকালীন মানুষ হিসেবে শামসুর রাহমান যে উচ্চমাপের কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে উপস্থাপিত করতে পেরেছিলেন, ছলনাহীন, সহজ-সরল একটা জীবন যাপন নিজে বহন করতে পেরেছিলেন, তেমনটা কিন্তু বাংলাতে, বাংলাভাষী কবিদের মধ্যে তাঁর সমকালে খুব বেশি আমরা দেখতে পাই না।
শামসুর রাহমান তাঁর সময়কালে তিনি যে কত কবির ভিতরে কবিত্বের বীজ পুঁতে, সেইসব কবিদের ভিতরে সেই বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছেন, তার হিসেব মেলাতে বসলেই একটা গ্রন্থ তৈরি হয়ে যায়। দুই বাংলার বাংলা ভাষা চর্চাকারী মানুষদের কাছে, তরুণ প্রজন্মের কাছে, যেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন শামসুর রাহমান, যেভাবে তাদের হিতসাধনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরেছিলেন তিনি ,তাঁর সমসাময়িক কালে অন্নদাশঙ্কর, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরীর মত হাতেগোনা দুই চার জন মানুষ ছাড়া আর খুব একটা দেখা যায় না।
এত আটপৌরে শব্দ কেন শামসুর রাহমানের কবিতায় , তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'আমি বাপু তোমাদের বুদ্ধিজীবী কবিদের মতো ,অভিধান খুলে, সবথেকে দুরূহ শব্দটি নিয়ে, ছন্দের আঁকিবুকি তে কবিতা নির্মাণ করতে পারিনা। আমি সোজা কথা, সোজা করে, সোজা ভাবে বলতে ভালোবাসি ।সেভাবেই আমি আমার জীবনটাকে কাটিয়েছি। যে কটা দিন বাঁচব ,সেভাবেই জীবনটা কাটিয়ে যাব।'
এই যে তাঁর নিরহংবাদী, সহজ সরল স্বীকারোক্তি, সেই স্বীকারোক্তির মধ্যে ফুটে উঠছে, আসাদের শার্ট থেকে শুরু করে, সুপ্রিয়া গৌরীর জন্য কবিতার কালক্ষেপণটি। প্রেমিক শিরোমণি শামসুর রাহমান তাঁর নিজের জীবনের সত্য কখনো গোপন করতেন না। অন্নদাশংকর যেমন বলেছিলেন, 'প্রেম ছাড়া কি শিল্প হয়', সেই ভাবনাকে আত্মস্থ করেই নিজের সংসার জীবনের দায়িত্ববোধের প্রতি এতটুকু নিয়ে অবহেলা না করেও, কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি পাতিয়েছিলেন তিনি। একটি বারের জন্য নিজের সঙ্গে নিজে কোনো রকম প্রতারণা করেননি। সেটা করেননি বলেই তিনি শামসুর রাহমান। সেটা করেননি বলেই তিনি বাংলা ভাষা ,বাংলা কবিতা যত দিন টিকে থাকবেন। ততদিন অমর হয়ে থাকবেন।
শামসুর রাহমান কখনো বাংলা বা বাঙালিকে খন্ডিত চিন্তায় ভাবতে শেখেন নি। বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকোনো উঠোনে, ছেলের শার্টে শোভিত বোতাম --সেই মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান হয়ে, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ঘাতক দালালদের শাস্তির দাবিতে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্বের নেতৃত্ব দান , শামসুর রহমান কখনো কিন্তু পলায়নবাদী কবি নন। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার সঙ্গে মিতালী পাতিয়ে বিপ্লব করার মত চতুর কবি নন। শামসুর রাহমান যখন যেটা বলতে চাইছেন, সেটা শুধু বলছেন তাই ই নয় ,তার জন্য পথে নামছেন। নিজের জীবনকে বিপন্ন করছেন। তবু যাকে তিনি সত্য বলে মনে করছেন, সেই 'সত্য' থেকে একটিবারের জন্য সরে আসছেন না।
শেখ হাসিনা প্রথম দফায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইসলামীয় মৌলবাদীরা কবির শ্যামলীর বাড়িতেই কবিকে হত্যা করার জন্য গিয়েছিল। কবির পুত্রবধু টিয়া রাহমানের বিচক্ষণতায় কবি সেইবার রক্ষা পান। না হলে তাঁর মৃত্যু সেই সময় অবধারিত ছিল। তা সত্বেও কবি কিন্তু মৌলবাদের বিরুদ্ধে ,ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে নিজের কলমকে একটিবারের জন্যও গুটিয়ে রাখেননি। সাবধানে আড়ালে-আবডালে কথা বলা, এগুলো সবই ছিলো তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। আবার উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাতেও তিনি বিশ্বাস করতেন না। ব্যক্তিজীবনে ধর্ম তাকে কখনো আচ্ছন্ন করেনি। কিন্তু মানুষকে ভালোবাসা যদি ধর্ম হয়, সেক্ষেত্রে শামসুর রহমানকে একজন পরম ধার্মিক বলতে হয় ।
কোনো দিন কো নোরকম প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ না করেও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য শামসুর রাহমানের যে ভালোবাসা ,তাঁর কবিতার যে উচ্চারণ, তেমনটা কিন্তু এপার বাংলার কয়জন কবি, এপারের সংখ্যালঘুদের জন্য করতে পেরেছেন ,ভাবতে হয়।
কবি চলে গিয়েছেন একটা যুগ হয়ে গেছে। একটা প্রজন্মের বদল ঘটেছে। একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে দুই বাংলাতেই ।বাংলা ভাষাকে যাঁরা ভালবাসেন, কবিতাকে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের কাছে শামসুর রাহমান চিরতরুণ, চিরযুবা এক চিরন্তন বাঙালি।