মৃতদেহ এসেছিল শোভাযাত্রা করে, বন্দি সম্রাট দেখতেন জানলা দিয়ে || তাজমহলের যে ইতিহাস অজানা আজও

শাজাহানের আমল নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই মানুষের। তৈরি হয়েছে একের পর এক সিনেমা, লেখা হয়েছে সাহিত্য। সব মিলিয়ে ভারতের সাংস্কৃতিক জগতে শাজাহান এক বহুচর্চিত নাম। এবং ঔরঙ্গজেবের হাতে শেষ বয়সে বন্দি হওয়ার আখ্যান মানুষকে তাঁর জীবনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একটা সুযোগ দেয়। শাজাহানের প্রেমের গল্প এখনও এক প্রজন্মের মানুষ চারিয়ে দিয়ে থাকে অপর প্রজন্মের কাছে। ইতিহাসের বিকৃতি সেই প্রেমের গল্পের কাছে ম্লান হয়ে যায়। শাজাহান মোটেও মিতব্যয়ী ছিলেন না। তাঁর আমলে রাজকোষ গিয়েছিল প্রায় শূন্য হয়ে। এই কারণে ঔরঙ্গজেবকে অনেকটাই শক্ত হাতে লাগাম ধরতে হয়েছিল খরচের। হিসেবের ব্যপারটা শাজাহানের একেবারেই ছিল না। ফলে তাঁর স্থাপত্যসৌধ পৃথিবীর আশ্চর্যর মধ্যে স্থান করে নিল। আজ এত বছর পরে শ্রমের অত্যাচার বা পৌরুষের আস্ফালন দিয়ে অবশ্যই তাকে দেখা সম্ভব, এবং দেখা উচিতও, কিন্তু সেই যাবতীয় সমালোচনার কেন্দ্রে ‘তাজমহল’ নামের একটি অপূর্ব সৃষ্টির অস্তিত্ব থেকেই যায়। তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

 

এই তাজমহল গড়ে উঠল কীভাবে? রানি মুমতাজ মহলের প্রতি শাজাহানের প্রেমের নিদর্শন হিসেবে তাজমহল পরিচিত। আদতে কিন্তু মুমতাজের স্মৃতিসৌধ হিসেবেই তৈরি করা হয় তাজমহল। কিন্তু মুমতাজ মহল মারা গিয়েছিলেন ঠিক কোথায়? এই তথ্য অত্যন্ত কম মানুষই জানেন। মুমতাজ কিন্তু আগ্রায় মারা যাননি। আগ্রা থেকে ন'শো কিমি দূরে মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুর অঞ্চলে মারা যান মুমতাজ। শাজাহানের শাসনকালে এই বুরহানপুর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। খান্দেশ সুবাটির রাজধানীও বটে। দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে উত্তর ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য যে পথ ধরে হত, সেই পথের ওপরে এর অবস্থান হওয়ায় শহরটির বাণিজ্যিক গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। ১৬২৯ নাগাদ খান জাহান লোদি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং আহমেদনগরের নিজাম শাহের পক্ষে যোগ দেন। এই বিদ্রোহ দমনে শাজাহান বুরহানপুর আসেন। সঙ্গে আসেন মুমতাজ মহল। শাজাহানের ১৩তম সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না তাঁর। কিন্তু এ অবস্থাতেও ফের গর্ভবতী হন মুমতাজ। ১৬৩১ সালের ১৭ জুন গর্ভজনিত নানা সমস্যার কারণে ১৪তম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। মুমতাজের বয়েস তখন মাত্র ৪০। মুমতাজকে দাফন করার জন্য একটি ভালো জায়গা দেখার দায়িত্ব শাজাহান দেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শাহ সুজাকে।

আরও পড়ুন: গ্রীষ্মে প্রজাদের জলকষ্ট ছিল না || ইতিহাসে উপেক্ষিত রয়ে গেল বাংলার এই রাজবংশ

জৈনাবাদ নামে একটি বাগানে মুমতাজ মহলকে প্রাথমিকভাবে দাফন করা হয়। তবে মনে করা হয়, বুরহানপুরকে প্রাথমিকভাবে দাফনের জায়গা হিসেবেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। পরে অন্যত্র সেই কবর সরানোর পরিকল্পনা সম্রাটের ছিল। সেই কারণে মুমতাজের শরীর ইউনানি জাতীয় ঔষধে জড়িয়ে রাখা হয়ে হয়েছিল। যাতে দেহটি পচে না যায়, সেই কারণেই এই ব্যবস্থা। ১৬৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি শোভাযাত্রা করে মুমতাজের দেহ সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে পাওয়া যায়, বছর পনেরোর শাহ সুজা এবং পারিবারিক চিকিৎসক ওজির খান এই শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিইয়েছিলেন। হাজারখানেক সৈন্য নিশান নিয়ে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে চলেছিল। দশজন সৈন্য একটি সোনালি কফিনে মুমতাজের দেহ বহন করছিলেন। সেই শোভাযাত্রা দেখতে পথের দু'ধারে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় জমিয়েছিল। ১৬৩২ সালের ৫ জানুয়ারি ৯০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তা আগ্রায় পৌঁছয়।

অম্বররাজ রাজা জয় সিংহের কাছ থেকে যমুনার তীরে একটি বাগান খরিদ করা হয়। আপাতত সেখানেই মুমতাজ মহলের দেহ দাফন করা হয়। এই দ্বিতীয় দাফন সংক্রান্ত দুই ধরনের ব্যাখ্যা শোনা যায়। কারও মতে তাজমহল নির্মাণ শেষ হওয়ার পরেই মুমতাজের দেহ সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। আবার অনেকের মতে সেই আপাতভাবে নির্মিত কবরের উপরেই তাজমহল নির্মিত হয়। মুমতাজ মহল তাঁর নিজস্ব সম্পত্তির এক বিরাট অংশ নিজের প্রিয় কন্যা জাহানারাকে দিয়ে যান। সেই সময়ের নিরিখেই সেই সম্পত্তির পরিমাণ ছিল এক কোটি টাকা। বাকি সম্পত্তি তাঁর বাকি সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে চতুর্দশতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এরপর আর প্রেমের নিদর্শনের যুক্তি তেমন খাটে কি তাজমহলের ক্ষেত্রে? শেষ বয়সে চোখের জল ফেলতে ফেলতে দৃষ্টি নাকি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল শাজাহানের। চশমার ইতিহাসে ভারতের যে ক'জন ব্যক্তির নাম প্রথম সারিতে, শাজাহান তাঁদের মধ্যে নাকি অন্যতম। ঔরঙ্গজেব তাঁকে বন্দি করে রেখেছিলেন আগ্রা ফোর্টেরই এক কামরায়। বলা হয়, যে কামরায় তাঁকে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে নাকি তাজমহল দেখা যেত, দয়া বলতে এটুকুই করেছিল তাঁর সন্তান। স্মৃতিসৌধ, নিজের প্রেমের নিদর্শন নাকি নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য— কীভাবে দেখতেন তাজমহলকে সেই বৃদ্ধ? 

১৬৬৬ সালে মারা যান শাজাহান। তাঁকেও দাফন করা হয় মুমতাজের কবরের পাশেই। তাজমহলের অন্দরে।

More Articles