বাসনও মাজতেন রানি! ঠিক কী ছিল এলিজাবেথের সুখী দাম্পত‍্যজীবনের গোপন রহস্য

Queen Elizabeth II: কেমন ছিল রানির প্রেমজীবন?

সবকিছুকে যদি ভালবাসা দিয়েই ঘিরে নেওয়া যায়, তাহলে বোধহয় সমস্ত বিতর্ক, কালো নিকষ অন্ধকারও ডুবে যায় সমুদ্রের অতলে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু এবং বিতর্কিত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বিশ্লেষণে তাঁর প্রেমিক সত্তা যেন সৃষ্টি করে দিতে পারে এক অন্য ভাবনারও! ৯ এপ্রিল, ২০২১ আর ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২। মাত্র এক বছর চার মাস কয়েক দিন। এখনও দু'টি বসন্তও কাটেনি প্রিয় সাথীকে ছেড়ে। আর তাতেই যেন ফের মিলিত হওয়ার তাগিদের কাছে হেরে গেলেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। অর্থাৎ, এলিজাবেথ আলেকজেন্দ্রা মেরি উইন্ডসর। দীর্ঘ সত্তর বছরের কার্যকালে ৯৬ বছর বয়সে ব্রিটেনের বালমোরাল ক্যাসেলের বাকিংহাম প্যালেসে প্রয়াত হলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান বিশ্ব। শোকপ্রকাশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ তাবড় রাষ্ট্রনেতাদের। রানির মৃত্যুর পর ব্রিটেনের রাজা হচ্ছেন তাঁর পুত্র ৭৩ বছরের চার্লস।

যদিও ব্রিটেনের রানির জীবন-পথেও রয়েছে ঘটনার ঘনঘটা। বিতর্ক। শাসন, একছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, বিতর্কিত মন্তব্যের কুখ্যাতি, ভারতের কোহিনূর বিতর্ক, বউমা লেডি ডায়নার মৃত্যু-রহস্য বিতর্কের সঙ্গেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং প্রশাসক হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন অনন্য। যদিও ভারতের সঙ্গে এলিজাবেথের সম্পর্ক নিয়েও বিতর্ক রয়েছে বিস্তর। সর্বাধিক সময়, প্রায় ৭০ বছরের বেশি সময় রাজপরিবারের প্রধানের আসনে থাকার রেকর্ড করেছেন তিনি। কিন্তু জীবন নিয়ে বরাবর কাটাছেঁড়ার আবহেই প্রেমিক এলিজাবেথ সত্তার গুরুত্ব প্রকাশিত হয় বারবার। উঠে আসে সমকালীন সময়ে দাঁড়িয়েও প্রতিপত্তিশালী অভিজাত পরিবারে, রাজপরিবারে থেকেও তিনি মনের মানুষ খুঁজেছেন ভালবেসেই! কীভাবে?

ভারতের স্বাধীনতা-প্রাপ্তির বছর, অর্থাৎ, ১৯৪৭ সালে যুবক প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন এলিজাবেথ। সেই বিয়ে ছিল ভালবেসে। কিন্তু এই বিয়ের কয়েকবছর আগে থেকেই দু'জনের আলাপ। ডার্টমাউথ ন‍্যাভাল কলেজে ১৯৩৯ সালে তোলা একটি ছবি দেখে অনুমান করা হয়, রাজকীয় প্রেমের শুরু তখন থেকেই। প্রিন্স ফিলিপের বয়স মাত্র ১৮। সুদর্শন ন‍্যাভাল ক্যাডেট হিসেবে কাজ শুরু করেছেন সবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রিন্স ওই কলেজ সফরে যান। সেখানেই ১৩ বছরের রাজকুমারী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। সেই আকর্ষণ ক্রমেই বন্ধুত্বে রূপ নেয়। শুরু হয় চিঠি লেখালিখি। এই পরিস্থিতিতে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে যান ফিলিপ। রাজকুমারী তাঁর ঘরে ফিলিপের একটি ছবি রাখেন তখন। শুরু হয় ভালবাসার এক অসম রাস্তা।

আরও পড়ুন: রাজপরিবারে প্রথম রানি এলিজাবেথের অভিষেকই দেখা গিয়েছিল টেলিভিশনে

গ্রিস এবং ডেনমার্কের এই রাজকুমারের ছেলেবেলা কেটেছে যাযাবরের মতো। যেতে হয়েছে এক স্থান থেকে অন্যত্র। প্রিন্স ফিলিপের জন্ম গ্রিসের রাজপরিবারে। তবে একদা বিতর্ক এবং নির্বাসনের কারণে ইউরোপের একদেশ থেকে অন্য দেশে থাকতে হয়েছে প্রিন্সকে। অনেকেই বলেন, প্রিন্স ফিলিপ সেই অর্থে রাজাদের মতো ছিলেন না। অনেকটা রাজাধিরাজ ভূমিকা ছেড়ে সাধারণ থাকতেই ভালবাসতেন তিনি। যদিও রাজকুমারী এলিজাবেথ ছিলেন ফিলিপের বিপরীত অবস্থায়। জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজপ্রাসাদের সুরক্ষিত বেষ্টনীর ভেতর। অন্য জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে এলিজাবেথের আলাপ ছিল সামান্য। লাজুক স্বভাবের ছিলেন তিনি। তবে যে-কোনও বিষয় নিয়ে ভাবতেন। আর এই ভাবনাই যেন দু'জনের প্রেমে হয়ে উঠল সূত্র।

এলিজাবেথ সবেমাত্র ২০ বছরের। ঠিক তখনই তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন ডেনমার্কের যুবরাজ ফিলিপ। ১৯৪৬ সালের সেই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হল তার এক বছর পর। ১৯৪৭ সালে রাজকুমারীর ২১ বছরের জন্মদিনে। প্রকাশিত হলো তাঁদের আংটি বদলের সংবাদ। গ্রিসের রাজকুমারী এলিস, যিনি প্রিন্স ফিলিপের মা। তাঁর মাথার মুকুট থেকে নেওয়া হিরের টুকরো দিয়ে নিজে ওই আংটির নকশা করেন প্রিন্স ফিলিপ। বিয়ের আগেই প্রেমিক ফিলিপ হবু শাশুড়িকে এক চিঠিতে লেখেন রাজকুমারীর 'দ্বিধাহীন প্রেমে নিমজ্জিত আমি।'

ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে গির্জায় প্রায় দু'হাজার অতিথির সামনে মহাসমারোহে বিয়ে হয় এলিজাবেথ এবং প্রিন্স ফিলিপের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার করুণ স্মৃতির আবহে সেই অনুষ্ঠান নিয়েও হয়েছিল বিতর্ক।

১৯৪৮ নাগাদ এলিজাবেথের গর্ভে জন্ম নেন চার্লস। তারপর মেয়ে অ্যান।

ফিলিপ ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে রয়েছেন তখনও। ক্রমশ পদোন্নতি হচ্ছে তাঁর। যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস চেকার্সে কাজ করার সূত্রে বৌ-সন্তান নিয়ে তিনি তখন মল্টায় থাকেন। রাজপ্রাসাদের গণ্ডির বাইরে এই জীবন নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি। রাজা ষষ্ঠ জর্জের আকস্মিক মৃত্যু। রাতারাতি বদলে যায় পরিস্থিতি। মাত্র ২৫ বছরেই রাজ সিংহাসনে বসেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। স্ত্রী-র সিংহাসন-জয় ফিলিপকে নৌবাহিনী ছাড়তে বাধ্য করল। কম্যান্ডার হলেন রাণীর সঙ্গী। এদিকে ২৫ বছরে দুই সন্তানের মা এলিজাবেথ গ্রহণ করলেন কাঁটার মুকুট। তবুও প্রিন্স ছিলেন অবিচল। ১৯৫০-এর একপ্রকার পিতৃতান্ত্রিক আবহে এক নারী হলেন রাষ্ট্রপ্রধান। তা নিয়েও শোরগোল দেখা দেয় বিশ্বজুড়ে।

রাষ্ট্রপ্রধান স্ত্রী-র সঙ্গে মানিয়ে নিতে, তাঁর সঙ্গী হিসেবে নিজেকে সামলাতে খানিকটা সময় লেগেছিল প্রিন্স ফিলিপের। তিনি চেষ্টা করেছিলেন বারবার। বরাবর ভিন্ন স্বভাবের প্রিন্স ১৯৫৬ সাল নাগাদ কমন‌ওয়েলথের একাধিক দেশে ঘুরে বেড়ান। তখন সমলোচনার মুখে পড়তে হয় তাঁকে। তবে তারপর আর তাঁদের সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। মানিয়ে নিয়েছেন প্রিন্স। সংসারে রানি থেকেছেন সাধারণ হিসেবেই একজন মা, স্ত্রী হিসেবে বারবিকিউ-র পর বাসন মেজেছেন। ১৯৬০-এ রাজপরিবারের ওপর করা এক তথ্যচিত্রে জানা হয় নানা তথ্য। সম্প্রতি ৭০ বছরের, অর্থাৎ সাত দশকের কার্যকাল সম্পূর্ণ করেন এলিজাবেথ। ঠিক তার একবছর আগেই প্রিয় সঙ্গীকে হারান তিনি। তারপর থেকে শোকে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন একদা প্রিন্সের প্রেমিকা কুইন।

প্রিন্স ফিলিপ রানির সঙ্গে থাকতেন সর্বদা। ডিউক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের সঙ্গে সাধারণ আড্ডায় মশগুল থাকলেও আপত্তি ছিল না রানির। তাঁদের দাম্পত্য সম্পর্ক নির্বিবাদ থাকার অন্য আরেকটি কারণ ছিল, মাঝে মাঝেই নিজের নিজের পছন্দমতো আলাদা সময় কাটাতেন দু'জন। ডিউক একবার বলেন, "আমাদের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ থাকা সুখী দাম্পত্যজীবনের গোপন রহস্য।'' এলিজাবেথ কুকুর, ঘোড়া পছন্দ করতেন। অবসর সময়ে নাকি ঘোড়দৌড় প্রশিক্ষকের সঙ্গে আলাপ পরামর্শ করতেন রানি। ডিউক ফিলিপের পছন্দ ছিল খেলা। রাজপরিবারের সম্পত্তি দেখভাল করতেন তিনি। জীবনের শেষ পর্বে তাঁকে প্রায়ই দেখা যেত উইন্ডসর পার্কে বা সানড্রিংহাম প্রাসাদের কাছের এস্টেটে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে ঘুরছেন। তাঁদের নাতিরাও জানতেন তাঁদের অমোঘ টানের কথা, প্রিন্স হ্যারি একবার বলেন, আমার ঠাকুরদা আমার ঠাকুমাকে ছাড়া এক সেকেন্ডও থাকতে পারে না।

২০১৭ সালে সমস্ত রাজকীয় কাজ থেকে অবসর নেন প্রিন্স ফিলিপ। একা হন রানি। করোনাকালে সমস্যায় পড়েন বৃদ্ধ দম্পত্তি। চিকিৎসকদের পরামর্শে উইন্ডসর প্রাসাদে একসঙ্গে থাকেন তাঁরা। খানিকটা সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন। যে বিচ্ছিন্নতা বাড়ে প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুর পর। একাকিত্ব বাড়ে রানির। চিরকালের একসঙ্গে থাকার সঙ্গী, প্রেমিক হারান তিনি। বেশিদিন আর একা থাকলেন না কুইন, ব্যাগ গুছিয়ে ফের চলে গেলেন প্রিন্সের কাছেই!

More Articles