রাজপরিবারে প্রথম রানি এলিজাবেথের অভিষেকই দেখা গিয়েছিল টেলিভিশনে
Queen Elizabeth II Passes Away: স্থানীয় সময় অনুযায়ী ৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
অবশেষে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা অধ্যায়ের সমাপ্তি। প্রয়াত হলেন রানি এলিজাবেথ দ্বিতীয়। ৯৬ বছর বয়সে অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন রানি। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, স্থানীয় সময় অনুযায়ী ৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে লন্ডনে। রানির মৃত্যুতে জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে ব্রিটিশ সরকার। অর্ধ নমিত রাখা হচ্ছে জাতীয় পতাকা। গত ৭০ বছর ধরে ব্রিটেনের সিংহাসনে ছিলেন রানি এলিজাবেথ। তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সময় ধরে সামলেছেন ব্রিটেনের রাজপাট। বলাই বাহুল্য তার মৃত্যুতে ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল। ইতিমধ্যেই রানির জ্যেষ্ঠপুত্র প্রিন্স চার্লসকে ব্রিটেনের রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। রানির ক্লারেন্স হাউস এবং কেনসিংটন প্যালেস অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বালমোরাল ক্যাসেলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে রয়েছেন তার ছেলে এবং উত্তরসূরি প্রিন্স চার্লস, তাঁর স্ত্রী ক্যামিলা এবং নাতি প্রিন্স উইলিয়াম। রানির মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান আর রানীর কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স এডওয়ার্ড-সহ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চার সন্তানই এখন স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসেলে রয়েছেন।
৮ সেপ্টেম্বর সকালেই একটি মেডিক্যাল পরীক্ষার পরে, চিকিৎসকরা রানির স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং তাঁকে বিশেষ তত্ত্বাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এরপরই রাজপরিবারের সদস্যরা ছুটে আসেন বালমোরাল ক্যাসেলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের কাছে। তবে শেষরক্ষা হলো না। দীর্ঘ রোগভোগের পর ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যু হল ব্রিটেনের রাজপরিবারের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু রানির।
১৯২৬ সালে এলিজাবেথ লন্ডনের মেফেয়ারে ইয়র্কের ডিউক এবং ডাচেস-এর (পরে রাজা জর্জ এবং রানি এলিজাবেথ) প্রথম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ১৯৩৬ সালে নিজের ভাই রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের পরে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। আর সেই সময় থেকেই এলিজাবেথ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ স্থলসেনাবাহিনীর নারী বিভাগ অগজিলিয়ারি টেরটোরিয়াল সার্ভিসে কর্মরত থেকে জনসাধারণের দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন এলিজাবেথ। ১৯৪৭ সালে তিনি গ্রিস ও ডেনমার্কের রাজপুত্র ডিউক অফ এডিনবরা, ফিলিপকে বিয়ে করেন। এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতির চারটি সন্তান হয়: ওয়েলসের যুবরাজ চার্লস; রাজকুমারী অ্যান; ইয়র্কের ডিউক যুবরাজ অ্যান্ড্রু; এবং ওয়েসেক্সের আর্ল যুবরাজ এডওয়ার্ড। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি গতবছর ৯ এপ্রিল পরলোক গমন করেছেন রানি এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ।
আরও পড়ুন- ৮ সেপ্টেম্বর দিনটিকে কেন বেছে নেওয়া হলো নেতাজির মূর্তি উন্মোচনের জন্য? তুঙ্গে বিতর্ক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এলিজাবেথ এবং তাঁর বোন মার্গারেট আরও মানুষের কাছে এসে মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করেন। ক্রমে তাঁরা জনমানসে পরিচিতি এবং ভালবাসা লাভ করতে থাকেন। ১৯৫১ সাল থেকেই রাজা ষষ্ঠ জর্জের শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। এই সময় থেকেই অলিখিতভাবে শাসনকাজ নিজের হাতে তুলে নেন এলিজাবেথ। জনসমক্ষে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ভাষণ দেওয়া এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করেন তৎকালীন প্রিন্সেস অফ ওয়েলস, দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এরপর ১৯৫২ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ প্রয়াত হলে ব্রিটেনের মসনদে বসেন 'কুইন' এলিজাবেথ সেকেন্ড। তবে তার রানি হওয়ার পিছনেও একটি মজাদার গল্প আছে।
১৯৫২ সালের গোড়ার দিকে, এলিজাবেথ এবং ফিলিপ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড সফরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। প্রথমে তাঁরা বিশ্রাম করার জন্য কেনিয়াতে কয়েকদিনের হল্ট নেন। সেসময় কেনিয়ায় নিজেদের লজের সঙ্গে লাগোয়া একটি ট্রি-হাউসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এলিজাবেথ এবং ফিলিপ। ৬ ফেব্রুয়ারি ঘুম থেকে উঠে স্বামী ফিলিপের কাছে এলিজাবেথ জানতে পারলেন তাঁর বাবা, অর্থাৎ রাজা ষষ্ঠ জর্জ গতরাতে প্রয়াত হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ব্রিটিশ শিকারি জিম করবেট লিখেছিলেন, “The princess who went up a tree and came down a queen.”
আরও পড়ুন- আন্দামানের ‘রাক্ষস’-দ্বীপের কাছে গেলেই মৃত্যু! কীভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন এক বাঙালি মহিলা?
২৬ বছর বয়সি এলিজাবেথ আবদার করেছিলেন যে, তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানটি যেন সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হয়। রাজপরিবারের এই অনুষ্ঠানটির ঐতিহ্য ৯০০ বছর ধরে চলছে। কিন্তু সেবার এই অনুষ্ঠানটি যত মানুষ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তেমনটি এর আগে কেউই পাননি। বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে থেকে সেদিনের উৎসবমুখর লন্ডনের পরিবেশ বর্ণনা করছিলেন টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার। শুধু প্রাসাদের সামনে নয়, যে পথ ধরে রানি যাবেন, তার দু'পাশেই ছিল উৎসাহী মানুষের ভিড়। সেই পথের নানা জায়গায় মোতায়েন ছিলেন আরও কয়েকজন ধারাভাষ্যকার। সাত ঘণ্টা ধরে সেদিনের অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হয়েছিল টেলিভিশনে। এমনই জাঁকজমকপূর্ণভাবে রাজ্যাভিষেক হয়েছিল এলিজাবেথের। রাজপরিবারের সরাসরি উত্তরাধিকারী হওয়ার সূত্রেই তাঁর মাথায় উঠেছিল রানির মুকুট।
তাঁর শাসনকালে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার পাশাপাশি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল রানির সাজপোশাকও। মাঝে মাঝে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কার্যকলাপের ফলে অস্বস্তিতে পড়তে হলেও রাজপরিবারের হাল ধরেছেন দক্ষ হাতে। তবে এবার সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি। কালকেও রাস্তার দুই ধারে ভিড় থাকবে। অসংখ্য মানুষ শেষবারের জন্য দেখবেন তাঁদের রানিকে। টেলিভিশনের দৌলতে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সাক্ষী থাকবেন ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অধ্যায়ের সমাপ্তির।