আজীবন সাদা শাড়ি, গলায় আঁচল, কেন এই পোশাক বেছে নিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর

লতা মঙ্গেশকরের কথা উঠলেই চোখে ভাসে তা হল সাদা শাড়ি, অত্যন্ত সাদাসিধে বেশভূষা এবং সেই কোকিলকণ্ঠী গলা। কিংবদন্তি এই গায়িকার এই যে মূর্তি তা কিন্তু অজান্তেই হয়ে যাওয়া নয়, নিজের পরিধান নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন লতা। ভারতীয় সঙ্গীতের জগতে যখন লতার প্রবেশ, তখন তিনি অত্যন্ত দরিদ্র। মাথার দুপাশে দুটি বেণী করা ছোট্ট মেয়েটির জগতে একরাশ খিদে আর অভুক্ত পরিবার, যাঁদের খাওয়াবার ভার ওই দুটি বেণীর সঙ্গী ছোট্ট কাঁধে। কারণ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান। বাবা মারা গিয়েছেন তখন সদ্য। কোরাসে গাইতে হত প্রথমে। তখন ১৯৪২। গান্ধীজির সাধারণ বেশভূষা দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে চর্চার বিষয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ত্যাগ ও বলিদানের ক্ষত ভারতীয় সমাজে টাটকা। সফেদ তখন পবিত্রতার প্রতীক। এইসব ঘটনা ছাপ ফেলেছিল কিশোরী লতার মনে।

উজ্জ্বল রং থেকে দূরে যুগল বেণীর কুমারী রাজ্যে লতা এক নিজস্ব ব্যক্তিত্ব তৈরি করলেন। চরিত্রের পবিত্রতা ও কণ্ঠের পবিত্রতার মূর্ত রূপ যেন ঐ সাদা রং। নিভৃত। শান্ত। নিজের অতীতকে অতিক্রম করে ফেললেন অনায়াসেই। ১৯৪৯ সালে বছর কুড়ি বয়সের একটি অভূতপূর্ব গলা ‘মহলে’র গান গাইল। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল। কে এই মেয়েটি? শ্রোতাদের কাছ থেকে একের পর এক অনুরোধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর লোকজন। এরই মধ্যে রাজ কাপুর খুঁজে বার করলেন সেই গায়িকাকে। ‘বরসাতে’র যাবতীয় মহিলাকণ্ঠের গান গাওয়ালেন তাঁকে দিয়েই। লতার নামের সঙ্গে এইবার পরিচিত হলেন মানুষজন। গলায় উঁচু করে আঁচল দেওয়া একটি মুখ ভারতীয় সঙ্গীতের সমুদ্রে নিজের নামটি উজ্জ্বল অক্ষরে খোদাই করে ফেলল।

সাদা রঙটির সঙ্গে সুর সম্রাজ্ঞীর মিতালি আরো কম বয়সে। ‘অন স্টেজ উইথ লতা’র ভূমিকায় জানা যায়, নয় বছর বয়সের একটি ঘটনা। তখন বাবার সঙ্গে মঞ্চে গাইছেন লতা। একটা সাদা ফ্রক পরে বাবার হাত ধরে গিয়েছিলেন ছবি তোলাতে স্টুডিয়োয়। কিছুদিন পরে সেই ছবি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখে একটু চমকিত হয়েছিলেন বৈকি। বাবার ছবির পাশে সাদা পোষাকে মেয়ের ছবি। লেখা ‘ক্লাসিকল প্রোগ্রাম বাই ফাদার অ্যাণ্ড ডটার’। সেই মুহূর্তগুলো মনে রেখেছিলেন আজীবন।

অন্য কোনও রঙেই তেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। লতার জীবনী ‘সুর গাথা’য় লেখক যতীন্দ্র মিশ্র গায়িকাকে প্রশ্ন করছেন, সবসময় সাদা শাড়ি কেন? বাদবাকি রং না পরার কি কোনও বিশেষ কারণ রয়েছে? উত্তরে লতা জানাচ্ছেন, “যাবতীয় রং আমার পছন্দ, সেই রঙচঙে শাড়িগুলো দেখতেও মন্দ লাগে না, কিন্তু আমার পরতে অস্বস্তি হয়। কারণ তেমন কিছুই নেই। কিন্তু লাল বা গেরুয়া রঙের শাড়ি পরলে মনে হয় পবিত্র রংগুলিকে অবজ্ঞা করছি। তাই সাদা বা চন্দনরঙ পরি। শাড়ি সাদা যত উজ্জ্বল, আমিও ততটাই খুশি। আপনার হয়তো মনে হতে পারে, তা কিছু রং বাদ দিয়েপরলেই তো হয়, কিন্তু আমি নিরুপায়, কোনও গাঢ় শেডের পোষাকই আমার পছন্দ না।” এছাড়াও জানাচ্ছেন, সাদাই তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায়—অন্তত তেমনটাই মনে করেন তিনি। এবং দীর্ঘদিনের অভ্যাসেএটিই তার পরিচয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একবার প্রচণ্ড বৃষ্টি। কী পরে রেকর্ডিং-এ যাবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। সুতির শাড়ি ভিজে গেলে শুকোতে সময় লাগে প্রচুর। কিন্তু সিল্ক শুকায় সহজেই। কাজেই শেষমেশ একটা হলুদরঙা শিফনের শাড়ি পরে গেলেন স্টুডিয়োয়। কিন্তু ঢুকেই বিপত্তি। সহকর্মীরা অবাক। আরো অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন লতা। রেকর্ডিষ্ট পর্যন্ত বললেন, “এ আবার কী পরেছেন?” লতা সমস্তটাজানালেন। কিন্তু পছন্দ হল না ভদ্রলোকের। “না না। আমার একদন পছন্দ হচ্ছে না। আপনি বরবার যা পরেন তাই পরবেন। এতে আপনাকে একেবারেই মানাচ্ছে না।” সেইদিন সুর সম্রাজ্ঞী অনুভব করলেন, তাঁর পরিধানের ব্যাপারটা আর শুধুমাত্র তাঁর ইচ্ছানির্ভর নেই। দর্শক, শ্রোতা, সহকর্মী–সবার সঙ্গে বোঝাপড়ায় লতা তখন ব্যক্তির ঊর্দ্ধে এক আইকনে পরিণত হয়েছেন। এই ভাবমূর্তির বদল করতে গেলে লোকের চোখে লাগবে। তারা নিতে পারবেন না এই নতুন লতাকে। কাজেই মেনে নিতে হল।

আরও পড়ুন-লতাপ্রণাম মুহূর্তে শাহরুখের সঙ্গে এক ফ্রেমে, এখন সবার নজরে এই নারী!

সিল্কের শাড়িও পছন্দের ছিল না কোনওদিন। শুধুমাত্র সুতির শাড়ি। চান্দেরি সুতি বা লখনউ চিকন শাড়ি পছন্দ সবথেকে। বাংলা বা মহারাষ্ট্রের শাড়ি পরতেও খুব ভালোবাসতেন। কাঞ্জিবরম মন্দ লাগত না, কিন্তু বেণারসীটা একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না।এত ভারি যে পরে নড়াচড়া করা যায় না।

জীবনীকার আঁচলের স্টাইল নিয়েও কৌতূহলী। কেন এইভাবে আঁচল নেওয়া? কোনও বিশেষ কারণ? জবাবে লতা জানান, কোলাপুরে ছত্রপতি শিবাজীর রাজত্ব ছিল। বরবারই সেখানে মেয়েরা আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে এসেছে। একবার এক বুজুর্গ, যাকে গায়িকা ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন, তাঁকে এই আঁচলের রীতির সম্বন্ধে প্রশ্ন করলে ভদ্রলোক জানান যে ভারতীয় নারীর সম্ভ্রম তাঁর মাথা ঢেকে রাখাতেই। এ গোঁড়ামি নয়, একে আত্মসম্মানের প্রতীক বরং। কথাগুলি লতাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে তিনি গলায় আঁচল দিতে শুরু করেন। কিন্তু গলায় আঁচল দিয়ে রেকর্ডিং করা মোটেও সুবিধের ব্যাপার না। “দীর্ঘ কুড়ি বছর গলায় আঁচল দিয়ে এসেছি। কিন্তু আর পারি না। রেকর্ডিঙ্গে এত অসুবিধা হয় যে গলায় আঁচল দেওয়ার ব্যাপারটা ছাড়তে হয়েছে।” 

ধীরে ধীরে বছরের পর বছর ঐ রঙ্গিন পাড়ের সাদা শাড়ি কোথাও দুটি খড়মের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। বেণীর কোলে জায়গা করে নিয়েছে ভারতবর্ষ, তার সামগ্রিক বিভিন্নতা যেন ঐ দুটি বেণীর পাকে পাকে এক্সুরে গাঁথা হয়ে গিয়েছে। এ এক আশ্চর্য অনুরণন। গত রবিবার আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন সুর সম্রাজ্ঞী। কিন্তু তাঁর ঐ সাদার রেশ বুকে বয়ে ফিরছেন সমগ্র দেশের মানুষ। সেইসব জনতার সমকালে লতার ভাবমূর্তির মৃত্যু হবে না কখনও। নির্মাণ যখন স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যায় তখনই তার অমরত্বের শুরু।

তথ্যঋণ–

In Pictures: How Lata Mangeshkar Became The Definition Of Elegance And Beauty With Her Bindis And Saris [WWW Document], 2022. . News18.

Lata Mangeshkar: Lady in White [WWW Document], n.d.

Lata Mangeshkar: Why do you like white sari and diamond jewelry, said the queen of music frankly. 5 pictures of melody queen in white sarees | pipanews.com, n.d.

Memories of Didi: Lata ji used to wear gold anklets instead of silver, there was some special reason for wearing her white sari, 2022. . Granthshala India.

राजपूतकविता, 2022. दीदी की यादें: चांदी नहीं सोने की पायल पहनती थीं लता जी, उनकी सफेद साड़ी पहनने की भी रही कुछ खास वजह [WWW Document]. Dainik Bhaskar.

लता मंगेशकर क्यों पहनती थीं सफेद रंग की साड़ी? छोटी सी उम्र का फैसला जो आखिरी सांस तक बरकरार रहा [WWW Document], n.d. . Navbharat Times.

More Articles