বাঙালির প্রিয় ফুচকায় মজেছে মার্কিনিরা! শূন্য থেকে সোজা শীর্ষে এই ভেলপুরিওয়ালা

ভাঙাচোরা জীবনকে গোছানোর জন্যই একসময় মেহেরওয়ান আমেরিকার বুকে গড়ে তুললেন ভারতীয় স্ট্রিট ফুডের ছোট্ট এক রেস্তোরাঁ, ‘চা’য়ে পানি’। এরপর আর কখনও ফিরে দেখতে হয়নি তাঁকে।

বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন কমবেশি সব ভারতীয়ই দেখে থাকেন। তেমনই আমেরিকায় গিয়ে হায়ার স্টাডির স্বপ্ন দেখেছিলেন মেহেরওয়ান ইরানি। যেমন ভাবা তেমন কাজও সম্পন্ন হলো, কিন্তু আমেরিকায় গিয়ে কিছু বছর কাজ করার পর আর্থিক মন্দায় সাজানো জীবন একেবারে ছারখার হয়ে গিয়েছিল তাঁর। সেই ভাঙাচোরা জীবনকে গোছানোর জন্যই একসময় মেহেরওয়ান আমেরিকার বুকে গড়ে তুললেন ভারতীয় স্ট্রিট ফুডের ছোট্ট এক রেস্তোরাঁ, ‘চা’য়ে পানি’। এরপর আর কখনও ফিরে দেখতে হয়নি তাঁকে। একজন কর্পোরেট চাকুরীজীবীর সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার সুদীর্ঘ যাত্রার কথা শোনাব আজ।

মেহেরওয়ানের ব্যক্তিগত জীবন
১৯৯০ সালে মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের বছর কুড়ির মেহেরওয়ান পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকায়, চোখে তখন বাইরের দেশে গিয়ে এমবিএ করার স্বপ্ন। এমবিএ চলাকালীনই তাঁর জীবনে প্রেম আসে, তাও আবার প্রথম দেখার প্রেম। একদিন সাউথ ক্যারোলিনার মার্টল বিচে মলির পৈতৃক রেস্তোরাঁতেই মেহেরওয়ানের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় তাঁর। অতি অল্প দিনেই তাঁরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই সদ্যবিবাহিত দম্পতির কোল আলো করে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান। এরপর ২০০৫ সালে তাঁরা সপরিবার অ্যাশেভিলে চলে যান, মেহেরওয়ান তখন লেক্সাস এবং মার্সেডিজ-বেঞ্জের মতো দু'টি নামকরা কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট বিভাগে কর্মরত।মেহেরওয়ানের তখন সুখের জীবন, ভালবাসা এবং অর্থ– কোনওটারই অভাব নেই।

বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা, যার সূচনাস্থল ছিল আমেরিকা
কিন্তু এই সুখ খুব বেশিদিন স্থায়ী হলো না মেহেরওয়ান এবং মলির জীবনে। ২০০৮-'০৯ সালে বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা প্রকট রূপ ধারণ করল, যার সূচনাস্থল ছিল আমেরিকা। পরিসংখ্যান বলছে, সেইসময় পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৩ কোটি মানুষ নিজের চাকরি হারিয়েছিলেন এবং ক্ষতির সর্বাধিক আঁচ লেগেছিল আমেরিকার অর্থনীতিতে। সমস্যা দানা বেঁধেছিল আমেরিকা সরকারের গৃহ ঋণদানের নীতি নিয়ে। গৃহঋণকে উৎসাহ দিতে গিয়ে ক্রমে আমেরিকার ব্যাঙ্কগুলি আর্থিক সংকটে পড়ে এবং আমানতকারীদের সুদ কমিয়ে দিতে থাকে। ফলে একটা সময় অবস্থা এমন হয়, যখন আমেরিকার মানুষ ব্যাঙ্কে অর্থ রাখতেই অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। ফলে গৃহ ঋণে সুদ বাড়তে বাধ্য হয় ব্যাঙ্কগুলি এবং অর্থনীতিতে ধ্বস নামে।

আরও পড়ুন: কেউ বেচছেন লেবুর জল, কেউ স্ট্রিট ফুড, যে পথে লাখপতি ওঁরা

অর্থনীতির এই টানাপোড়েনের মুখে মেহেরওয়ান এবং মলির স্থিতিশীল জীবনেও অস্থিরতার ছায়া আসে এবং সেই সময় থেকেই মেহেরওয়ান ইরানি নতুন কিছু করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকেন, যার পরিণতিতে ‘চা’য়ে পানি’ রেস্তোরাঁ স্থাপিত হয়।

ভারতীয় খাবারের প্রতি ভালবাসা থেকেই জন্ম হয় ‘চা’য়ে পানি'-র
মেহেরওয়ান জানান, তিনি চেয়েছিলেন ভারতের বৈচিত্রময় সব খাবারের সঙ্গে বিশ্ববাসীর পরিচয় করাতে। মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়ায় ছোটবেলা থেকে তিনি নিজেই পাওভাজি কিম্বা বড়া পাভের মতো জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুডগুলিতে রীতিমত আসক্ত ছিলেন, এমনকী, আমেরিকায় উড়ান দেওয়ার আগের সন্ধ্যাতেও তাই নিজের পছন্দের স্ট্রিট ফুডগুলির স্বাদ শেষবারের মতো আস্বাদন করার জন্য ঘুরে বেরিয়েছিলেন এলাকার রাস্তায় রাস্তায়। মেহেরওয়ানের কথায়, একদিন মাঝরাতে হঠাৎই তাঁর খেয়াল আসে, আমেরিকার মাটিতে ভারতের নানাবিধ জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুডের একটা ছোট রেস্তোরাঁ খোলা যেতে পারে। তিনি আরও জানান, ব্যবসা সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও, সেই রাত্রেই রেস্তোরাঁটির যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে স্ত্রী মলির সঙ্গে সমস্ত পরিকল্পনাই সেরে ফেলেছিলেন তিনি।

একজন কর্পোরেট চাকুরিজীবী থেকে রাতারাতি একজন ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার পথ খুব একটা সহজ ছিল না। তাঁদের রেস্তোরাঁর পরিকল্পনা নিয়ে প্রথমে এই দম্পতি আমেরিকার বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং অর্থ বিনিয়োগকারী সংস্থার মুখাপেক্ষী হলেও, দেশে মন্দা চলার কারণে কোনও সংস্থাই নতুন উদ্যোগে অর্থ বিনিয়োগ করতে রাজি হয়নি। মেহেরওয়ান বলেন, সেই সময় তাঁরা নিজেদের পরিচিত, বন্ধু এবং পরিবারের লোকেদের কাছে তাঁদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ও আর্থিক সাহায্য চেয়ে একটি খোলা চিঠি রাখেন। সেই চিঠিতে তাঁরা এই কথাও উল্লেখ করেন যে, তাঁরা চমকপ্রদ বা অভিনব বিশেষ কিছুই না করলেও, নিজেদের পরিকল্পনা এবং স্বপ্নের ওপর তাঁদের সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে। মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিনের মাথায় তাঁদের খোলা চিঠির ডাকে সাড়া দিয়ে পরিচিত-অপরিচিত সকলের সাহায্যে ৭৫,০০০ ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন মেহেরওয়ান এবং মলি। অতঃপর ২০০৯ সালের কোনও এক শুভদিনে আমেরিকার মাটিতে স্থাপিত হল ভারতীয় রকমারি স্ট্রিট ফুডের দোকান ‘চা’য়ে পানি’।

‘চা’য়ে পানি’র জনপ্রিয়তা
আমেরিকার তৎকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে, রেস্তোরাঁর খাবারের দাম যতটা সম্ভব কম রাখা যায়, সেই চেষ্টাই করেছিলেন ইরানি দম্পতি এবং সেইমতো ‘চা’য়ে পানি’ যাত্রা শুরু করেছিল, ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড ‘চাট’-এর হাত ধরেই। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অ্যাশভিলে বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জায়গা থেকেও ভারতীয় ‘চাট’ উপভোগ করার জন্য রেস্তোরাঁতে ভিড় জমাতে থাকে অগুনতি আমেরিকাবাসী। রেস্তোরাঁ এবং সর্বোপরি ভারতীয় স্ট্রিট ফুডের প্রতি, দেশের বাইরের মানুষদের এতো ভালো লাগা দেখে প্রথমটায় মেহেরওয়ান নিজেও খানিকটা অবাক হয়ে গেছিলেন। মাত্র চার বছরের মধ্যেই এই রেস্তোরাঁয় ভারতীয় খাবারের জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ‘চা’য়ে পানি’র অন্য একটা শাখাও খোলা হয় আটলান্টায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই স্ট্রিট ফুডের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে রেস্তোরাঁর মেনু কার্ডে, চাট-এর পাশাপাশি যোগ করা হয় একাধিক স্ট্রিট ফুড আইটেমগুলি। বর্তমানে মেহেরওয়ানের রেস্তোরাতে যেমন ভেলপুরি, দইপুরি, পানিপুরি কিংবা বিভিন্ন ধরনের ‘চাট’-এর দেখা মিলবে, তেমনই সন্ধান মিলবে চিকেন টিক্কা, পাওভাজি, বড়াপাভ কি‌ংবা কিমা পাভের।

জানলে হয়তো অবাক হবেন, এত খাবারের মধ্যেও রেস্তোরাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানে রয়েছে পানিপুরি বা যাকে বাঙালিরা বলে থাকি ফুচকা। ভারতের পথে-ঘাটে ঠিক যেভাবে ফুচকা খেতে লাইন দেয় মানুষজন, ঠিক সেইভাবেই কিন্তু পানিপুরির স্বাদ গ্রহণের জন্য লম্বা লাইন পরে মেহেরওয়ানের ‘চা’য়ে পানি’ রেস্তোরাঁতে। হিসাব বলছে, দিনে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি পানিপুরি বিক্রি হয় এই রেস্তোরাঁতে এবং প্রায় এক হাজার জন খরিদ্দারের রসনা-তৃপ্তি মেটাতে সবসময় হাসিমুখে হাজির থাকেন বাহান্ন বছরের মেহেরওয়ান।এই রেস্তোরাঁতে প্রায় সমস্ত খাবারের দামই পরে নয় ডলার থেকে আঠারো ডলারের মধ্যেই। অনেকে আবার বলে থাকেন, ‘চা’য়ে পানি’-তে চেয়ারে বসে স্বস্তিতে স্টিট ফুডগুলির স্বাদ আস্বাদন করতে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে পৌঁছে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

মেহেরওয়ান রেস্তোরাঁর জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, প্রথম দিন থেকেই তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন প্রত্যেকটি খাবারকে, একেবারে ভারতের রাস্তায় বিক্রিত স্ট্রিট ফুডের মতো করেই তৈরি করতে। অনেক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সেই একই মন্ত্রে ‘চা’য়ে পানি’ আজও অসংখ্য খাদ্যরসিক মানুষের একইভাবে মন জুগিয়ে চলেছে। ২০২২ সালেই মেহেরওয়ান এবং মলির এই রেস্তোরাঁ আমেরিকার ‘আউটস্ট্যান্ডিং রেস্টুরেন্ট’ হিসেবে ‘জেমনস বেয়ার্ড অ্যাওয়ার্ড’-ও লাভ করেছে।

More Articles