খুঁজেও মেলেনি কাজ, হতাশায় চাকরি খোঁজাই ছেড়ে দিয়েছেন কোটি কোটি ভারতীয় মহিলা

করোনা পরিস্থিতি মানুষের রুজিরুটিতে তীব্রভাবে আঘাত করেছে। ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনা পরিস্থিতিতে জীবিকা খুইয়েছেন। দীর্ঘ কয়েকমাসের লকডাউনে ট্রেন, বাস পুরোপুরি বন্ধ থাকায় বহু মানুষ অফিস-কাছারিতে যেতে পারেননি। ব্যবসাপত্রও ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে। আর অনেক ক্ষেত্রেই কর্মীদের মৌখিক নোটিসে পত্রপাঠ চাকরি থেকে বিদায় করার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে।

এরপর করোনা পরিস্থিতি খানিক নিয়ন্ত্রণে আসায় জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় দফার ঢেউ যে সমস্ত কর্মীর চাকরি কেড়ে নিয়েছে, তাঁরা এখন এতটাই হতাশ যে, আরেকটা চাকরি খোঁজার উদ্যম পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন।

মুম্বইয়ের প্রখ্যাত গবেষণা সংস্থা 'সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি' সম্প্রতি এ-সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, লক্ষ লক্ষ কর্মী চাকরির খোঁজ করাই ছেড়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: হু হু করে বাড়ছে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা, অবসরের পরেও চাই কাজ

'সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি' জানিয়েছে, এর কারণ ওই কর্মীরা নতুন করে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে হতাশ ও ক্লান্ত। ফলে চাকরি-বাকরি খোঁজার চেষ্টাটাও আর করছেন না। এঁদের ভেতর আবার সংখ্যাগরিষ্ঠই মহিলা।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার প্রথম পর্বে ২০১৭ সাল থেকে কাজের বাজারে অংশগ্রহণকারী কর্মীসংখ্যার গ্রাফ নামতে শুরু করে। গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সাল থেকেই মেয়েরা কাজকর্ম ছাড়তে শুরু করেন কিংবা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা কাজ খুইয়েছেন।

'সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি'-র করা গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় কর্মক্ষেত্র থেকে সরে গিয়েছেন ২ কোটি ১০ লক্ষ মহিলা কর্মী। এঁদের মোটে ৯ শতাংশ নতুন কাজের খোঁজের ধৈর্য বজায় রাখতে পেরেছেন। ভারতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে বর্তমানে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৩০ লক্ষ।

'সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি'-র সিইও মহেশ ব্যাস বলেছেন, যাতে মহিলারা নিরাপদে কাজ করতে পারেন, এজন্য কাজের সুস্থ পরিবেশ দরকার। এছাড়া মহিলারা যাতে নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে পৌঁছতে পারেন, সেজন্য দরকার যথাযথ পরিবহণ ব্যবস্থা। দু'কোটির বেশি মহিলার কাজের বাজার গত পাঁচ বছরে উধাও হয়ে যাওয়াটা আসলে সরকারের ব্যর্থতা।

২০২২ সালের চার মাস অতিক্রান্ত হতে না হতেই উদ্বেগজনকভাবে ভারতে বেকারত্বের হার আরও কিছুটা বেড়েছে। 'সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি'-র একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের মার্চে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর এপ্রিলে তা বেড়ে ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, বেকারত্বের নিরিখে ভারতে এখন প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য হরিয়ানা। হরিয়ানায় বেকারত্বের হার ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপরই স্থান রাজস্থান, বিহার এবং জম্মু-কাশ্মীরের। এই তিন রাজ্যে বেকারত্বের হার যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ, ২১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ।

আরেকটি সমস্যাও প্রকট হয়েছে। দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মীরা পর্যন্ত ভালো চাকরি পাচ্ছেন না। বহু ক্ষেত্রেই কম বেতনে কাজ করতে হচ্ছে দক্ষ কর্মীদের।

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের হামলার পর থেকে ভারতের কাজের বাজার খারাপ হচ্ছিল। মোদি জমানায় ২০১৭ সাল থেকেই বেকারত্বর নিরিখে ভারত রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছে। করোনা বেকারত্বকে আরও আগ্রাসী করেছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।

গবেষকরা আরও জানিয়েছেন, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা। যেমন, কৃষিক্ষেত্রে কাজ করেন যেসমস্ত কর্মী, অথবা যাঁরা নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, কাজের বাজারে আদৌ ওঁরা আদৌ কাজ পাবেন কি না, তার কোনও নিশ্চয়তাই নেই। এমনকী নিশ্চয়তা নেই ন্যূনতম পারিশ্রমিক জুটবে কি না, তারও।

ভারতে সরকারি চাকরি-বাকরি পাওয়াও দূর অস্ত। সম্প্রতি রেল ৩৫ হাজার ক্লার্কের পদের জন্য নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়ার পরে ১২ লক্ষ কর্মপ্রার্থী আবেদন করেছেন। সুতরাং, পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়।

'সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি'-র পৃথক একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ভারতে প্রতি পাঁচজন গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে একজনই কর্মহীন। 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম'-ও ভারতে গ্র্যাজুয়েটদের বেকারত্বের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর পরিণামে যুব সম্প্রদায়ের মোহভঙ্গ হতে চলেছে বলে পূর্বাভাস 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম'-এর। বেকারদের মধ্যে অনেকেই আবার মানসিক অবসাদের শিকার।

করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারানো ভারতের কর্মজীবীদের মধ্যে একটা বড় অংশ, বিশেষত মহিলারা হতাশ হয়ে চাকরি খোঁজাটাই ছেড়ে দেবেন, এ-সম্পর্কে কোনও পূর্বাভাসও ছিল না। তবে 'ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন' আগেভাগেই জানিয়েছিল, ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের হাল বেহাল হতে চলেছে। এর ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত ৪০ কোটি শ্রমিক দারিদ্রের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসেছেন।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সরকারি চাকরি পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠায় যে সমস্ত কর্মপ্রার্থী বেসরকারি সংস্থাগুলোতে কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন, চাকরিকালীন প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিতে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এ-ব্যাপারে দিল্লি আইআইটি-র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ঋতিকা খেরা বলেছেন, এর মূল কারণ ভারতের শ্রম আইনই দুর্বল।

দেশের বেকারত্ব এবং চাকরির বাজারের করুণ দশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনও অভিযোগই মানতে নারাজ। বরং মোদি দাবি করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার লাগাতরভাবে নতুন নতুন কাজ সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। এমএসএমই এবং কৃষিক্ষেত্রে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের পাশে থাকতে বিশেষভাবে উদ্যোগী কেন্দ্র।

মোদির দাবি, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও উৎপাদন শিল্পের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ হয়েছে মোবাইল উৎপাদনে। এছাড়া অটোমোবাইল এবং ব্যাটারি শিল্পে রফতানি বেড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উৎপাদন শিল্পের বিকাশের কথা বললেও গত চার বছরে উৎপাদন শিল্পে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা অন্তত অর্ধেক কমেছে বলে একাধিক সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আরও অভিযোগ, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে কাজ করে খাটনির টাকাও হাতে পাননি বহু দরিদ্র গ্রামবাসী। এ-বাবদ মোট ৩ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা এখনও বকেয়া রয়েছে।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বছরে দু'কোটি চাকরি সৃষ্টি করা হবে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, মোদি এও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে ১০ কোটি চাকরি সৃষ্টি করা হবে। তার কী হল?

এই অভিযোগের কোনও জবাব দেননি প্রধানমন্ত্রী। উল্টে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নতুন করে কথা দিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ৬০ লক্ষ চাকরি সৃষ্টি করা হবে।

More Articles