হু হু করে বাড়ছে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা, অবসরের পরেও চাই কাজ

মানুষ একদিন না একদিন বৃদ্ধ হবেই। প্রতিটি মানুষই জানেন প্রকৃতির এই সত্য। আর এও জানেন, বৃদ্ধ বয়সে যদি নিজস্ব আর্থিক নিরাপত্তা থাকে তাহলে নিজের খাওয়াপরার ভার নিজেই বহন করতে পারবেন।সেক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।

কিন্তু বিধি বাম। ভারতের বাসিন্দা ৬০ কিংবা এর চেয়ে বছরের বেশি বয়সের প্রবীণ নাগরিকরা খাওয়াপরা কিংবা ওষুধপত্রের খরচ নিজেরা বইতে পারেন না। এজন্যে পরিবারের সদস্য কিংবা ছেলেমেয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেকক্ষেত্রে অপমান সইতে হয়। বলা বাহুল্য, এও এক বিষম জ্বালা বৃদ্ধ বয়সে।

আগামী দিনগুলোতে এই সমস্যা আরও বাড়তে চলেছে। বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জীবনসমস্যা আরও জটিল হচ্ছে এমন এক বয়সে পৌঁছে যখন শরীর-মন  বিশ্রাম চায়। এদিকে বিশ্রাম তো দূরের কথা দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ বাড়ছে ভাতের জোগান কিংবা রোগের চিকিৎসার খরচ জোটানো নিয়ে।

বর্তমানে ভারতে ১৩ কোটি ৮০ লক্ষের বেশি নাগরিক আছেন যাদের বয়স ৬০ কিংবা তার চেয়ে বেশি। ২০৩১ সালে এই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়াবে ১৯ কোটির বেশি। ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসের সমীক্ষার এই তথ্য কিছু কারণে উদ্বেগজনক।

সমাজে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়লেও তা আদর্শের দিক থেকে যে কোনও সমাজের পক্ষে ভালোই। কারণ এক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে পথ দেখানোর মতো অভিভাবকের সংখ্যা বাড়ায় সমাজ আখেরে উপকৃত হবে।

কিন্তু এদেশে সে আশা পূরণ হওয়ার নয়। কারণ বর্তমানে পরিবার খুব ছোট হয়ে যাওয়ার ফলে বয়স্ক মানুষের তেমন দাম নেই। যদি সঞ্চয় থাকে তাহলে পরিবারের অন্দরে মর্যাদা কিছুটা বজায় থাকে। না হলে ভাত জুটছে বহুক্ষেত্রেই গঞ্জনার বিনিময়ে। এদিকে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে ওষুধপত্রের দাম ক্রমে বেড়েই চলেছে।

'সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের ন্যায়'। সেই হিসেবে ২০৩১ সাল খুব দূরবর্তী নয়। কিন্তু বর্তমানে ভারতের যা পরিস্থিতি তাতে স্বল্প সংখ্যক মানুষই ৬০ বছরের পরবর্তী বছরগুলোর কথা চিন্তা করে সংসার চালিয়ে উদ্বৃত্ত টাকা সঞ্চয় করতে পারছেন। ৬০ বছরের পর পেনশন পাবেন যাঁরা সেই স্বল্প সংখ্যক মানুষকে ভাগ্যবানই বলা যায়।

২০১১ সাল থেকে যদি ধরা যায়, সেক্ষেত্রে ওই বছর প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা ছিল ভারতের জনসংখ্যার ৮.৬ শতাংশ। ২০২১ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.১ শতাংশ। এরপর ২০৩১ সালের মধ্যে জনসংখ্যার ১৩.১ শতাংশই প্রবীণ নাগরিক অথবা ৬০ বছর কিংবা ৬০ এর বেশি বয়সের নাগরিকের সংখ্যা বাড়বে ৬ কোটির বেশি।

এই মুহূর্তে সারা দেশের নিরিখে কেরলে সবচেয়ে বেশি প্রবীণ মানুষ বসবাস করেন। কেরলের জনসংখ্যার ১৬.৫ শতাংশ প্রবীণ নাগরিক। আর এরপরেই স্থান তামিলনাড়ু, হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাব এবং অন্ধ্রপ্রদেশের। এই রাজ্যগুলিতে প্রবীণ নাগরিকের শতকরা হয় যথাক্রমে ১৩.৬ শতাংশ, ১৩.১ শতাংশ, ১২.৬ শতাংশ এবং ১২.৪ শতাংশ। ২০৩১ সালেও ভারতের এই পাঁচ রাজ্যে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যায় দেশের অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় এগিয়ে যাবে।

এখন ভারতের জনসংখ্যার যে ১৩ কোটির বেশি মানুষ বৃদ্ধবৃদ্ধা তাঁদের ভিতর একটা বড় অংশই নিজের নাম পর্যন্ত সই করতে পারেন না। কেন্দ্রীয় সরকারি তথ্য অনুসারে, প্রবীণ নাগরিকদের ভিতর ৫৯ শতাংশ বৃদ্ধ এবং ২৮ শতাংশ বৃদ্ধা নিজের নাম সই করতে জানেন না। বৃদ্ধদের তুলনায় বৃদ্ধারা সাক্ষরতায় অনেকটা পিছিয়ে পড়ার কারণ ভারতীয় সমাজে দেগে বসা লিঙ্গবৈষম্য।

৬০ বছর অথবা এর চেয়ে বেশি বয়সের ভারতীয় নাগরিকদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে এপর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবীরা যে কটি সমীক্ষা চালিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, মোটে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ প্রবীণ নাগরিকের আর্থিক সুস্থিতি রয়েছে। বাকিরা পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যের উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল।

'হেল্প এজ ইন্ডিয়া'র একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পরিবারের অন্দরে যে নিগ্রহের ঘটনাগুলি ঘটছে তার মধ্যে ৫৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ছেলের হাতে নিগৃহীত বৃদ্ধবৃদ্ধারা। আর ৬১ শতাংশ ক্ষেত্রে নিগৃহীত হতে হচ্ছে পুত্রবধূদের হাতে। মৌখিকভাবে নিগ্রহ করা থেকে শুরু করে ওঁদের মারধর পর্যন্ত করা হচ্ছে। বিষয়টি যে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সারা ভারতে প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে ৮৭.৮ শতাংশ তাঁদের ছেলেমেয়ের সঙ্গে বসবাস করেন। ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধবৃদ্ধা স্বামী একত্রে বসবাস করেন। আর একা বসবাস করেন ২.২ শতাংশ বৃদ্ধবৃদ্ধা।

মানুষ সাধারণত বুড়ো বয়সে হাত-পা ছড়িয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। পৃথিবীতে দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে লব্ধ যে অভিজ্ঞতা সেসবের স্মৃতিচারণা করাটাও বৃদ্ধ বয়সের সুখ। এছাড়া কথায় বলে, মানুষ বৃদ্ধ হলে নাকি শিশুর মতো হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-বলা হত ‘হিউম্যান কম্পিউটার’, লিখেছিলেন সমকামিতা নিয়ে বই || আজও বিস্ময় এই মহিলা গণিতজ্ঞ

২০৩১ সালে ভারতে আরও ৬ কোটির বেশি মানুষ প্রবীণ নাগরিকের তালিকাভুক্ত হবেন এই পূর্বাভাসের পরে স্বেচ্ছাসেবীরা দাবি করছেন, এখন থেকেই রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে যে বিপুল সংখ্যক প্রবীণ নাগরিক পেনশনের সুযোগ পাবেন না অথবা বৃদ্ধ বয়সের সঞ্চয় যাঁদের নেই ওঁরা কীভাবে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারেন সে বিষয়ে।

প্রবীণ নাগরিকদের নিয়ে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'এজওয়েল ফাউন্ডেশন', 'হেল্প এজ ইন্ডিয়া'র মতে, বৃদ্ধ বয়সে মানুষটির আর্থিক নিরাপত্তা অত্যন্ত জরুরি। তাই অবসর গ্রহণের পরে প্রবীণ নাগরিকদের জন্যে কাজ সৃষ্টি করাটা এখন এই সময়ের দাবি। অবসরের পর হাতে টাকা না থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রবীণ নাগরিকরা যে অপমানের জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন তাতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করার কাজটাও এখনই শুরু করা দরকার।

এদিকে অশক্ত বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ওপর দুষ্কৃতী হামলার ঘটনাও বাড়ছে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার পরে সেই ভয়াবহ সময়েও দুষ্কৃতীদের হামলার টার্গেট ছিলেন বৃদ্ধবৃদ্ধারা।  গত ৫ বছরে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ওপর অপরাধমূলক ঘটনা বেড়েছে। সারা দেশের মধ্যে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের ওপর সবচেয়ে বেশি দুষ্কৃতী হামলার ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। এছাড়া মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক।

স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, বৃদ্ধদের চেয়ে বৃদ্ধাদের ওপরই বেশি করে সমাজবিরোধী হামলার ঘটনা ঘটঽছে। প্রতারণা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য রাজপথে হাত থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দেওয়া থেকে শুরু করে খুনের শিকার প্রবীণ নাগরিকদের একাংশ।

বিপদ ঘোরতর আর সমস্যাও নিবিড় রাত্রিসম। তবু এরই ভিতর খুঁজে নিতে হবে মোকাবিলা, উত্তরণের পথটাও।  

More Articles