গর্ভপাত কি নারীর অধিকার? যে প্রশ্নে তোলপাড় আমেরিকা

আমিই সেই মেয়েটি যে ছোটবেলা থেকে শুনেছে
জোরে জোরে কথা বলতে নেই
ছুটতে নেই -চেঁচাতে নেই- হাসতে নেই
এমন কি কাঁদলেও তা লুকিয়ে লুকিয়ে...

এই শব্দগুলো শুধু ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার কেড়ে নিতে গা ঘামাচ্ছে আমেরিকা। মুক্ত চিন্তার আমেরিকা! গণতান্ত্রিক আমেরিকা! মার্কিন মুলুকে গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নিতে সম্প্রতি যে ঘটনা সামনে এসেছে, তাতে বলাই যায় এগুলো  লোক দেখানো তকমা ছাড়া কিছু নয়। কেন এই কথা উঠল তা বলি।

গর্ভপাত নিষিদ্ধ হতে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে! সম্প্রতি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের একটি খসড়া প্রস্তাব লিক হয়েছে। যেখানে এই বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। ওই খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত হিসেবে মনোনীত হলে আগামিদিনে আমেরিকায় ১৯৭৩ সালের পুরনো গর্ভপাত আইন বদলে যেতে পারে। বেআইনি ঘোষণা করা হতে পারে গর্ভপাত। এই রায় যুগান্তকারী হবে বলেই অনুমান অনেকের। তবে এই নিয়ে দ্বিমত আছে খোদ আমেরিকায়। নারীর অধিকার রক্ষার জন্য মার্কিন মুলুকে পথে নেমেছেন সেদেশের নাগরিকরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছে।

হু-এর বিরুদ্ধ মত

গর্ভপাত নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করার বিষয়ে মুখ খুলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম ঘেব্রেইসাস। তিনি সতর্ক করেছেন যে গর্ভপাতের অধিকার সীমাবদ্ধ করা অস্বাস্থ্যকর এবং অনিরাপদ পদ্ধতির দিকে নিয়ে যাবে। টেড্রোস একটি ট্যুইট বার্তায় বলেছেন, "মহিলাদের সর্বদা তাঁদের শরীর এবং তাঁদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত।" বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের মতে, "শুধুমাত্র আইনি রক্ষাকবচ পরিয়ে গর্ভপাতকে বন্ধ করা সম্ভব নয়। যারা অসৎ উদ্দেশ্যে গর্ভপাতকে হাতিয়ার করতে চাইবে প্রয়োজনে তারা সেটা আইন ভেঙে হলেও করবে। তাই শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েই গর্ভপাত বন্ধ করা সম্ভব নয়। গর্ভপাতের অধিকার সীমাবদ্ধ করা হলে তা গর্ভপাতের সংখ্যা কম করে না। এটি মহিলাদের এবং মেয়েদের অনিরাপদ দিকে নিয়ে যায়। নিরাপদ গর্ভপাত জীবন বাঁচায়।"

গর্ভপাত কী

গর্ভপাত হল কোনও ফিটাস বা ভ্রূণ নিজে নিজে বেঁচে থাকতে সক্ষম হওয়ার আগেই এটিকে অপসারণ করে অথবা মাতৃগর্ভ থেকে জোরপূর্বক বের করে দিয়ে গর্ভধারণের অবসান ঘটানো৷ গর্ভপাত ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হতে পারে।  সেক্ষেত্রে এটিকে বলা হয় প্ররোচিত গর্ভপাত। গর্ভপাত পরিভাষাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও মানবীয় গর্ভধারণের প্ররোচিত গর্ভপাতকে বোঝায়। ভ্রূণ নিজে নিজে বেঁচে থাকতে সক্ষম হওয়ার পর এই একই প্রক্রিয়া ঘটানো হলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সেটিকে বলা হয় `গর্ভাবস্থার বিলম্বিত অবসান’। 

কী আছে ড্রাফটে

গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে কোন কোন বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছে? সুপ্রিম কোর্টের ওই ফাঁস হওয়া খসড়া জানাচ্ছে, ১৯৭৩ সালে রো বনাম ওয়েড মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া রায় সঠিক ছিল না। এই রায় দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি স্যামুয়েল আলিটো। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন।

উল্লেখ্য, ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেন হেলথ অর্গানাইজেশনের একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ সপ্তাহ পর গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল মিসিসিপির কোর্ট। সেই মামলার রায়ও উল্লেখ করা হয়েছে ফাঁস হয়ে যাওয়া ওই ড্রাফটে। তবে গর্ভপাত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে প্রদেশগুলিই। এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে ওই ড্রাফটে।

গর্ভপাত বিরোধী আইন কার্যকর হলে গর্ভপাতকে একটি গুরুতর অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে। যার শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। এই আইনটি অগাস্ট মাসে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে, তবে এটি আদালত দ্বারা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ রো বনাম ওয়েড মামলায় আদালত গর্ভপাতকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে রো বনাম ওয়েড মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গর্ভপাতকে আইনসিদ্ধ করে রায় দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট। আদালত জানিয়েছিল, দেশের সংবিধানে গর্ভবতী মহিলাদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রয়েছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার চোখরাঙানি এড়িয়ে নিজের ইচ্ছায় গর্ভপাত করাতে পারেন তাঁরা। এদিকে, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের একটি গোপন খসড়া নথি ফাঁস হয়ে গিয়েছে। তাতেই মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করার কথা বলা রয়েছে বলে দাবি কয়েকটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমের।

আরও পড়ুন-ভারতের প্রথম ডাকঘর রয়েছে বাংলার এই জেলায়, আজ ধ্বংসস্তূপ সেই ইতিহাসের স্মারক

গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে আওয়াজ

আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের একটি গোপন খসড়া নথি ফাঁস হওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আওয়াজ উঠেছে মার্কিন মুলুকে। পথে নেমেছেন অগণিত মানুষ। মঙ্গলবার রাতে দেশজুড়ে বিক্ষোভে নেমে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ওয়াশিংটন, সান ফ্রান্সিসকো, নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, আটলান্টা, হিউসটোনে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে পদযাত্রা করে স্লোগান দেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়েছে লুইভিল, কেনটাকি-সহ অন্যান্য আরও শহরেও। জায়গায় জায়গায় মানুষ আদালত চত্বরের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। গর্ভপাতের অধিকারের সমর্থনে চলা বিক্ষোভে সামিল হওয়া বিক্ষোভকারীরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ করেছে। তাতে লেখা, 'জোর করে মাতৃত্ব নারীর দাসত্ববন্ধনের সামিল'।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও মার্কিন ভোটারদের গর্ভপাতের অধিকার রক্ষা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের একটি খসড়া নথিকে মৌলবাদী হিসাবে বর্ণনা করেছেন তিনি। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই খসড়ার প্রভাব আমেরিকান আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। মার্কিন জনগণের বিক্ষোভের আঁচ বুঝে কি ঢোক গিলতে বাধ্য হলেন বাইডেন?

গর্ভপাতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেকগুলো ফ্যাক্টর। একজন নারীর মা হয়ে ওঠার পেছনে থাকে অনেকগুলো শর্ত। যেমন সমাজ, সুস্থ সন্তান জন্মের নিশ্চয়তা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক দিক। আইন, আদালত এবং সমাজ জোর করে কি একজন মেয়েকে মা হওয়ার দায় চাপিয়ে দিতে পারে? আমেরিকার নাগরিকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তাই বলতেই হয়, এই আইন কার্যকর হলে তা হবে `নারীর দাসত্ববন্ধনের সামিল’।

More Articles