আকাশে বোমারু বিমানের হানা, সাধের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঢেকে গেল কালো রঙে

অনুকূলবাবুর সাথে বারোয়ারি মেসবাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বাতচিত চালাচ্ছেন ব্যোমকেশ। রহস্য ঘনীভূত হয়ে এলো। আর কিছুক্ষন পরেই হয়ত অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে আসামীর মূর্তি উন্মোচন করবেন 'সত্যান্বেষী'।   এমন সময় দূর থেকে ভেসে এল বেদম শব্দ, ঝলসে উঠল আগুন। আকাশে জাপানি যুদ্ধবিমানের হানা। তাদের নিক্ষেপ করা বোমায় ততক্ষণে ছারখার হয়ে গেছে খিদিরপুর ডক। এমনটাই ছিল দিবাকর বন্দোপাধ্যায় পরিচালিত 'ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী'র কলকাতার চিত্র। জাপানি বোমার আতঙ্কে 'কল্লোলিনী তিলোত্তমা' যেন হয়ে উঠেছিল গথাম সিটি।  সাইরেনের অমঙ্গলময় সন্ধারতিতে অন্ধকার  নামে। সাঁঝবাতিদের মুখ ঢেকে যায় মোটা কাগজের ঢাকনায়। পথেঘাটে সদা সর্বদা ভয়। এই বুঝি এসে পড়ল। এই আতঙ্ক থেকে রেহাই পায়নি কলকাতার গৌরব ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালও। জাপানি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে ইংরেজ সরকার ১৮৪ ফুট উঁচু এই স্থাপত্যকে বাঁশের সাজে সুসজ্জিত করে তুলেছিল সে সময়, মুড়ে ফেলতে হয়েছিল কালো রঙে। সে গল্প আজও  বিস্ময় জাগায়।

সালটা ছিল ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ। মহারানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ইংরেজ মহল। এ অবস্থায় বাংলার তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ভাবলেন রানীর মৃত্যুতে বড় করে কিছু একটা করা দরকার। শুরু হল ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির পরিকল্পনা। টাকা পয়সার অভাব বিশেষ দেখা দেয়নি। ইংরেজ অফিসার এবং জনাকয়েক ভারতীয়দের সম্মিলিত আর্থিক  অবদানে ১৯২১ সালে সম্পূর্ণ হল কাজ। স্থাপত্যখানা তৈরি করতে সব মিলিয়ে খরচ পড়েছিল প্রায় এক কোটি পাঁচ লক্ষ টাকা। ডেভিড প্রেন এবং লর্ড রেডেসডালের নকশায় তাকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল ফুল পাখির বাগিচা। 'বাংলার তাজমহল'-এর তখন শৈশবকাল। শরীরে টগবগ করে ফুটছে সতেজ রক্ত। শহরবাসী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখত মকরানা মার্বেলে তৈরি এই প্রাসাদের রূপমাধুর্য।

এমনভাবেই চলল আনন্দের দুই দশক। তারপর এলো ইতিহাসের অভিশপ্ত অধ্যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। অক্ষ আর মিত্র শক্তির কোন্দলে তখন বিশ্ববাসীর নাজেহাল অবস্থা। পালাবার পথ নেই। ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার ফলে ভারতবর্ষও পরিণত যুদ্ধের শরিকে। জলে স্থলে ছড়িয়ে পড়ল ত্রাস। চিনের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক কারণে ছিল সুসম্পর্ক। এদিকে হিউএন সাঙয়ের দেশ তখন লাগাতার জাপানি হানায় জর্জরিত। তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ভারতবর্ষ বাংলার রাস্তা ধরেই নিয়মিত ত্রাণ সরবরাহ করে। জাপানিরা ভাবল, খেল এবার খতম হওয়া দরকার। বাংলার মানচিত্রের উপর গোটাকয়েক বোমা ফেলে ধ্বংসকান্ড ঘটিয়ে দিতে পারলেই চিনের ত্রাণপথ যাবে আটকে। সেই মতো কাজ। ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হল কলকাতার উপর জাপানি বিমানের বোমাবর্ষণ। ময়দান, খিদিরপুর ডক, হাতিবাগান প্রভৃতি অঞ্চলে ঘটল ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি। ইংরেজদের  তখন থরহরি কম্পের পরিস্থিতি। শহরের কেন্দ্রস্থলে রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে কলকতাবাসীর চোখের মণি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। বোমার হাত থেকে কীভাবে বাঁচানো যায় একে?

আরও পড়ুন-চা-চরিত আসলে এক কালো কাব্য, কুঁড়ি তোলা ফাটা হাতদুটো কে আর দেখে

এসব ভাবতে ভাবতে একটা উপায় বের করলেন তাঁরা। তারপর এলো বিস্ময়ের পালা। সকলে দেখল, অত বড় একটা প্রাসাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাতারাতি মুড়ে ফেলা হয়েছে বাঁশের ক্যামোফ্লাজে। শুধু তাই নয়, সাদা মার্বেল পাথরের রঙ যাতে আগাগোড়া কুচকুচে কালো দেখায় তার জন্য তার উপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গোবর আর মাটির ঘোলাটে মিশ্রণ। এতে করে অন্ধকারে এরোপ্লেন থেকে ভিক্টোরিয়াকে চিহ্নিত করা যাবে না, ফলত তার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনাও যাবে অনেকটা কমে। সাধের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে রক্ষা করতে সেদিন এমন সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন ইংরেজরা। শোনা যায়, তাজমহলের ক্ষেত্রেও নাকি একই রকমের বাঁশের ছদ্মবেশ ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও শাহজাহান আর মুমতাজের প্রণয়সৌধের সর্বাঙ্গে ছদ্মবেশের প্রয়োজন পড়েনি। কেবল তার চূড়াটুকুতে পড়েছিল বাঁশের রক্ষাকবচ।

২০২১ এর ৩ ডিসেম্বর পালন করা হল ভিক্টোরিয়ার মেমোরিয়াল একশো বছর। তার নুড়ি বিছনো প্রান্তরে দিনভর চলল আগ্রহী দর্শকদের আনাগোনা। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধিকারের যুগ। ভিক্টোরিয়ার গল্পকথা ফুরোয় না। তার মাথার উপর বছরের পর বছর ধরে একা দাঁড়িয়ে থাকা সেই সবজে রঙের পরীকে নিয়ে মাঝে শোনা যেত অলৌকিক কাহিনী। 'কালো ভিক্টোরিয়া'র গল্প তো আছেই।   এই স্থাপত্য  কলকাতার অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটা । ভিক্টোরিয়ায় এসে মিলেছে মুঘল থেকে শুরু করে ইজিপসীয়  সংস্কৃতির নানান চিহ্ন। তারই শরীরে আতঙ্কের কালিমা! শতাব্দী পেরিয়ে এসব যেন কেমন রূপকথার  মতো লাগে আজ।

More Articles