চা-চরিত আসলে এক কালো কাব্য, কুঁড়ি তোলা ফাটা হাতদুটো কে আর দেখে

চা খেতে কে না ভালোবাসে? বাঙালি স্বভাবে তর্কপ্রিয়। বাসে ট্রামে অফিসে কলেজে তিন মাথা এক হলেই অফুরান তর্ক। আর এ হেন তর্কের সঙ্গে চা-পানই বিধেয়। সেই কোন যুগ থেকে চা সেই আড্ডায় যোগ্য সঙ্গত করে এসেছে।  চা ই সেই পানীয় যা ধর্মমত নির্বিশেষে জুড়ে দেয় কোটি ভারতবাসীর হৃদয়। এলিট থেকে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে যার নিত্য আসা যাওয়া সেই চায়ের ইতিহাস কিন্তু মোটেই কুসুম কুসুম নয়। চায়ের প্রতিটি কুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে আছে শ্রমিকের কান্না, হাতের তালুফাটা রক্তদাগ। চায়ের মৌতাতে ডুবে থাকা ক'জন জানেন সেই শোষক ও শোষিতের শ্রেণি সংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাস! আমাদের চা-চরিত বড্ড রোম্যান্টিক।

যেভাবে চা এল ভারতে

চায়ের জন্ম চিনে, আনুমানিক ২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। ১৬৫০ সালে চিনেই শুরু হয় চায়ের বানিজ্যিক উৎপাদন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের পরিচিতি ব্রিটিশদের হাত ধরে। পরবর্তীকালে আফিম যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ- চিন সম্পর্কের অবনতি ভাবিয়ে তোলে ব্রিটিশদের। সেইখান থেকে ভারতের বুকে চা চাষের শুরু। সস্তা শ্রমিক, বিশ্ববাজারে চায়ের চাহিদার যোগান দেওয়ার জন্য ভারতের থেকে ভালো বিকল্প আর ছিল না। সেই ভাবনা থেকেই সিলেটে চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে ইংরেজ সরকার। তারপর উত্তর পূর্ব ভারতের মানচিত্র জুড়ে শুরু হয় চা- বাগান নির্মাণ। শোষণ ও বঞ্চনার সেই শুরু। দশকের পর দশক কেটে গিয়েছে। অবস্থা বদলায়নি চা- শ্রমিকদের।

১৮৭৫ এ প্রথম চা বাগান তৈরি হয় ডুয়ার্সে। তারপর আস্তে আস্তে তৈরি হয় বাকি বাগানগুলি। চা বাগানগুলির বেশিরভাগ মালিক ছিল ইউরোপীয়রা। দেশি ভারতীয় শ্রমিকদের শোষণের ওপরেই দাঁড়িয়ে ছিল চা বাগানগুলির ব্যবসায়িক সাফল্য। চা বাগানের মালিকরা বিনা ওয়ারেন্টে যে কোনও শ্রমিককে গ্রেফতার করতে পারতেন। এমনকি পাশাপাশি চাবাগানগুলির শ্রমিকরা এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিরোধের রাস্তা যাতে গড়ে তুলতে না পারে তার জন্য প্রতিটি চা-বাগানে আলাদা আলাদা হাট বসতো। বেয়াড়া শ্রমিক শাসনের জন্য তৈরি হয়েছিল নর্থ বেঙ্গল মাউন্টেড রাইফেলস। আসলে ইংল্যান্ডে যে দাসব্য়বস্থা বহু আগেই উঠে গিয়েছিল, ভারতে এই চা শ্রমিকদের শোষণের মধ্যে দিয়ে সেই ব্যবস্থাকেই জারি রেখেছিল ব্রিটিশরা।

কীভাবে চলত শোষণ ও অত্যাচার? প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোর তাঁর ‘চা- বাগিচার কড়চায়’ লিখছেন, ‘কোনও এক বাগানের শক্ত সমর্থ জোয়ান কুলি ম্যানেজারকে বলেছিল, বাবু জ্বর হয়েছে, আজ কোদালি চালাতে পারব না। জবাবে পেয়েছিল বেদম প্রহার, পরে মৃত্যু। তারা আরও জানে বস্তিতে সুন্দর মেয়ে জন্মাতে নেই। সুন্দর মেয়ের উপর তাদের কোনও দাবি থাকে না; বড় হলেই তাকে পাঠিয়ে দিতে হয় ম্যানেজারের কুঠিতে। ম্যানেজারের লালসার হাজারো বাহু অক্টোপাসের মতো কুলি লাইন তছনছ করে বেড়ায়’।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মালিকানার এক বিপুল রদবদল হয়। ইংরেজদের বদলে অনেক ভারতীয় চা- বাগান কিনে নেন। মালিকানা বদল হয় বটে, বদলায় না শোষণের নিয়ম। তখন পুরুষ মজুরদের দৈনিক মজুরি ছিল আট আনা আর মেয়েদের ছ- আনা। এরপর এল পঞ্চাশের মন্বন্তর। সোমনাথ হোড় লিখছেন, ‘ মজুরি বাড়ল না, শ্রম ও কমল না। সকালবেলায় নুন মেশানো এক গামলা চায়ের জল খেয়ে কাজ করতে যাওয়া সন্ধেবেলায় হাঁপাতে হাঁপাতে লাইনে ফেরা। ৬৪ নল= ১ নল (১ নল= ৮ হাত) জমিতে কোদালি দেয়ার মজুরি চার আনা। অথচ চার আনায় খাবার যা মেলে তাতে কঠিন পরিশ্রম করা চলে না। তাই অশক্ত শ্রমিক যখন অত জমিতে কোদালি চালাতে পারল না, তার মজুরি ও গেল কমে’।

স্বাধীন ভারতে চা শ্রমিকের জীবন

১৯৪৭ এর ১৫ ই আগস্ট। স্বাধীন হল ভারত। চা বাগানের শ্রমিকদের পাঁজর ভাঙা খাটুনি, শোষণ এর জ্বালা লাঘব করতে ১৯৫১ য় লেবার প্ল্যান্তেশন অ্যাক্ট আনল নেহেরুর সরকার। শ্রমিকদের ঘর, জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিশ্চিত করতে মালিকদের জন্য নির্দেশিকা জারি হল। কিন্তু আইন যেমন আছে, তেমন আইনের ফাঁক ও আছে। ফলে ভারতের সর্বত্র নির্দেশিকা মোতাবেক কাজ হল না। ১৯৬০ সালে চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য সরকার তৈরি করল ওয়েজ বোর্ড। বোর্ড নির্দেশ দিল একটি পরিবার পিছু ৩ একক মজুরি দিতে হবে। আপত্তি তুলল মালিক সংগঠন। তাদের বক্তব্য ছিল স্বামী স্ত্রী দুজনেই যেহেতু চা বাগানের শ্রমিক তাই প্রত্যেক পরিবার পিছু ৩ এককের পরিবর্তে ১.৫ একক মজুরি দিলেই চলবে। আশ্চর্যের বিষয়, ‘জনহিতকর’ সরকার এক বাক্যে মেনে নেয় বাগান মালিকদের দাবি। ওই সময়ে পুরুষ শ্রমিকের মজুরি ছিল ১.৯৮ পয়সা, স্ত্রী শ্রমিকের মজুরি ছিল ১.৮৪ পয়সা এবং শিশু শ্রমিকের মজুরি ছিল ১.০৭ পয়সা। কিছু বাগানে শ্রমিক অসন্তোষের পরে ১৯৬৬ সালে সামান্য বাড়ে মজুরি। কিন্তু প্রশ্ন হল, একই বাগানে স্বামী, স্ত্রী, সন্তান পৃথক ভাবে শ্রম দিলে তাদের শ্রমের মূল্য কী ভাবে একসঙ্গে নির্ধারিত হয়? প্রশ্ন অনেক। কিন্তু উত্তর মেলে না।

চা- বাগান এখন

 ২০২২ এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী মজুরি বাড়ে পশ্চিমবঙ্গের চা- শ্রমিকদের। দৈনিক মজুরি ১৭৬ টাকা থেকে বেড়ে হয় ২০২ টাকা। কিন্তু নুন্যতম মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে ভাবে না সরকার বিরোধী কোনও পক্ষই। অথচ সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং সরকারি হিসেব বলছে চা- শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরি হওয়ার কথা ৩২৪ টাকা। ডুয়ার্সের প্রায় ২৭৬ টি চা বাগানের মধ্যে ২৭৩ টি তে সমীক্ষা করে যে ছবি উঠে আসে তা ভয়াবহ। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ও শোষণের ইতিহাসের চিত্র বদলায়নি ছিটেফোঁটা। কেবল তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক আড়াল। সমীক্ষা অনুযায়ী আড়াই লক্ষ শ্রমিকের মধ্যে এখন ও গৃহহীন ৯৫,৮৩৫ জন। ত্রিশ হাজারের ও বেশি বাড়িতে অমিল বিদ্যুৎ সংযোগ। মাত্র ৬১ টি চা বাগানে রয়েছে পানীয় জলের ব্যবস্থা। এই বঞ্চনার ইতিহাসের গায়ে ক্ষতের মত লেগে আছে অনাহার অপুষ্টিজনিত মৃত্যু। ২০০০ থেকে ২০১৫ এই পনেরো বছরে অনাহারে মরেছে প্রায় ১৪০০ শ্রমিক।

 একা কেবল উত্তরবঙ্গ নয়, আসামের অবস্থা ও প্রায় একই। সাম্প্রতিক কালে বেরোনো অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে আসামের চা বাগানের কর্মীদের মধ্যে মাত্র ৩৯ শতাংশ স্থায়ী কর্মী।বাকি ৬১ শতাংশ ঠিকে কর্মী দিয়ে চলে চা বাগান গুলি। সুপ্রিম কোর্ট ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের সুপারিশে এখানকার শ্রমিকদের প্রাপ্য দৈনিক মজুরি ৩৪২ টাকা অথচ এদের প্রাপ্তি মাত্র ১৬০ টাকা। করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিকের অবস্থা আরও খারাপের দিকে এগিয়েছে। মাত্র ৭ শতাংশ মহিলাকর্মীকে মাতৃত্ব কালীন ছুটি দিয়েছে মালিকপক্ষ। বাকিদের অবস্থা কী তা সহজেই অনুমান সাপেক্ষ।

ভুবনবিখ্যাত চায়ের প্রতি পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে শ্রমিকের কান্না , শ্রমিক সন্তানের খিদের হাহাকার, অপুষ্টি, অনাহার এবং মৃত্যু। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে কেউ কি দু'দণ্ড ভাববেন?

 গ্রন্থঋণ- তেভাগার ডায়েরি ও চা বাগিচার কড়চা, সোমনাথ হোড় , সুবর্ণরেখা

More Articles