একে একে নিভিছে দেউটি, কেন বন্ধ হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ওয়েস্টল্যান্ড?

করোনার দিনগুলিতে বহু ছোট ব্যবসাই যখন প্রায় ধুঁকছে তখনই বইপ্রেমীদের জন্য আরেক দুঃসংবাদ। এবার বই ব্যবসায় ইতি টানল ভারতের অন্যতম বৃহৎ বই প্রকাশক ওয়েস্টল্যান্ড বুকস। ওয়েস্টল্যান্ডের মালিক ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘নানা দিক খতিয়ে দেখে আলোচনা করে আমরা ওয়েস্টল্যান্ড প্রকাশনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল তবু সব দিক মাথায় রেখেই আমরা এই ওয়েস্টল্যান্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা এই মুহূর্তে কর্মচারী, লেখক, এজেন্ট, ডিস্ট্রিবিউশন এবং অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখছি’।

ওয়েস্টল্যান্ডের বেড়ে ওঠা

১৯৬২ তে যখন পথ চলা শুরু করে ওয়েস্টল্যান্ড, তখন তার নাম ছিল ইস্ট- ওয়েস্ট বুকস। মালিক ছিল টাটার আয়ত্তাধীন সংস্থা ট্রেন্ট লিমিটেড। ২০১৭ সালে অ্যামাজনের ভারতীয় শাখা দায়িত্ব নেয় ইস্ট ওয়েস্ট বুকসের। বদল হয় নাম। তারপর থেকে ৫ বছরে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের আঁতুড়ঘর হিসেবে কাজ করেছে ওয়েস্ট ল্যান্ড। বেস্টসেলার থেকে প্রান্তিক লেখক প্রায় সকলের লেখাকেই পাঠকের কাছে অবাধে পৌঁছে দিয়েছে।

প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কাছে স্বাভাবিক ভাবেই কর্পোরেট পুঁজির আলাদা কদর আছে। অ্যামাজনের মত একটি সংস্থার হাত ধরে নিজের ব্যবসায়িক বৃদ্ধির পথকেই প্রশস্ত করতে চেয়েছিল ওয়েস্টল্যান্ড। আবার অন্যদিকে হারপার কলিন্স, পেঙ্গুইনের মত আন্তর্জাতিক প্রকাশকদের টক্কর দিতে শুরু করেছিল ওয়েস্টল্যান্ড।

২০১৮ সালে এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম বেস্ট সেলার লেখক চেতন ভগতের বই প্রকাশনার দায়িত্ব নেয় ওয়েস্টল্যান্ড। ‘ফোর হানড্রেড ডেজ’ থেকে শুরু করে ‘ওয়ান অ্যারেঞ্জড মার্ডার’, ‘দ্য গার্ল ইন রুম ১০৫’ এর মতন অসংখ্য বিখ্যাত বইয়ের প্রকাশনার দায়িত্ব নেয় ওয়েস্টল্যান্ড। প্রকাশনা বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার পরে নেওয়ার পর পাঠক মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এই বইগুলির ভবিষ্যৎ কী! ২০০৪ সালে চেতন যখন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন প্রাথমিকভাবে রূপা পাবলিকেশনের মাধ্যমেই তার বইগুলি বাজারে আসতে শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে অ্যামাজনের মত একটি বৃহৎ সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন চেতন ভগত। এক বিপুল আর্থিক অঙ্কের বিনিময়ে চেতনের যাবতীয় বইয়ের দায়িত্ব নেয় অ্যামাজন। এই বিষয়ে চেতনকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, যেভাবে ভারতের প্রতিটি কোণে কোণে যোগাযোগের সেতু বেঁধে দিয়েছে অ্যামাজন তাই নিজের বইকে পাঠকের দরজায় দরজায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে অ্যামাজনের মালিকানাধীন ওয়েস্টল্যান্ডের কোনও বিকল্প হতেই পারে না। তাই অ্যামাজনের এই সিদ্ধান্ত আঘাত দিয়েছে লেখক থেকে বইপ্রেমী সকলকেই।

আরও পড়ুন-বাংলা কল্পবিজ্ঞান শুরু হয়েছিল তাঁর হাতেই, জগদানন্দকে মূলস্রোত ঠাঁই দেয়নি

বাংলার একমাত্র ওয়েস্টল্যান্ড প্রকাশিত বইয়ের লেখক সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী। ১০টির বেশি বই রয়েছে তাঁর ওয়েস্টল্যান্ড থেকে। এই প্রসঙ্গে তিনি  বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এই খবর অত্যন্ত দুঃখের। এতজন লেখক, কর্মীর ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে এর সাথে।যদি ও আমি এই অবধি কোনও অফিসিয়াল চিঠি হাতে পাইনি। আমার সঙ্গে ওদের চুক্তির মেয়াদ পূরণের আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আমার বইয়ের প্রকাশনার বিষয়ে বিকল্প ভাবনা  আমি এখনও ভাবিনি। চিঠি হাতে পেলে এই বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব’।

শেডস অফ স্যাফ্রন: ফ্রম বাজপেয়ী টু মোদী গ্রন্থের লেখক সাংবাদিক সাবা নকভি টুইটে লিখেছেন, ‘ আমি ওয়েস্টল্যান্ড সংস্থার তরফে চিঠি পেয়েছি। সেখানে ফেব্রুয়ারির শেষের মধ্যে আমার বইয়ের যাবতীয় সত্ত্ব আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না ঠিক কী কারণে ওয়েস্টল্যান্ডের মতো একটি প্রকাশনা  সংস্থাকে তুলে নেওয়ার কথা ভাবল অ্যামাজন কর্তৃপক্ষ তবে আমি আশাবাদী শেষ মুহূর্তে হলে ও যদি কোনোভাবে অ্যামাজন তাদের সিদ্ধান্ত বদলায়’। মনে রাখতে হবে ওয়েস্টল্যান্ডের লেখক তালিকায় আছে আমিশ ত্রিপাঠী, দেবদত্ত পট্টনায়ক, রুজুতা দিবাকর, হর্ষ ভোগলের মত নামও।

 

কেন বন্ধ হচ্ছে ওয়েস্টল্যান্ড?

ওয়েস্টল্যান্ড বন্ধের সঠিক কারণের কোনও উল্লেখ নেই অ্যামাজনের সরকারি বিবৃতিতে। এমনকী এই বন্ধের ফলে পুরনো সংস্করণগুলির কী হবে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ওয়েস্টল্যান্ডের মত একটি লাভজনক প্রকাশনীকে হঠাৎ কেন বন্ধ করার পথে হাঁটল অ্যামাজন তাই নিয়ে লেখক- পাঠক মহলে ও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। অনেকে মনে করেন কোভিডের দুবছরের ধাক্কার পরে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে এই বিবেচনাতেই ঝাঁপ বন্ধ করছে ওয়েস্টল্যান্ড। যেখানে পেঙ্গুইনের বাৎসরিক আয় প্রায়  ২০০ কোটি টাকা, সেখানে ওয়েস্টল্যান্ড টেনেটুনে ৩০ কোটিতে পৌঁছেছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভারতের ক্রেতাবাজারের সিংহভাগ দখল করে রয়েছে চার থেকে পাঁচটি প্রকাশনা। এই মুহূর্তে ওয়েস্টল্যান্ডের মতো প্রকাশনার চলে যাওয়া মানে বৈচিত্র্যের যে সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল, তার অপমৃত্যু।

লেখকদের একাংশের ধারণা, এর পিছনে স্পষ্ট কাজ করছে রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব। ফেসবুক, টুইটারের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপির প্রতি আনুগত্য আগেই বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত। সেই তালিকায় সম্ভবত নতুন সংযোজন অ্যামাজন। সাংবাদিক লেখক অমিত ভার্মা টুইটে সেই রাজনৈতিক ইন্ধনের প্রশ্নকেই উসকে দিয়েছেন। শেষ কয়েক বছরে ওয়েস্টল্যান্ড থেকে বেরিয়েছে ক্রিস্টোফার জ্যাফ্রেলটের ‘মোদী’স ইন্ডিয়া’, আকর পটেলের ‘আওয়ার হিন্দু রাষ্ট্র’, অরবিন্দ নারায়ণের ‘ইন্ডিয়া’স আনডিক্লেয়ারড এমারজেন্সির’ মত বই।প্রতিটি বইয়েই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধ স্পষ্ট। তবে কি বিরুদ্ধ স্বরেরই মাসুল গুনতে হল ওয়েস্টল্যান্ড কে?  

 

More Articles