বাংলা কল্পবিজ্ঞান শুরু হয়েছিল তাঁর হাতেই, জগদানন্দকে মূলস্রোত ঠাঁই দেয়নি
বাংলা সাহিত্য জগতে একের পর এক নক্ষত্রপতন হয়েছে এই মহামারীর দিনগুলিতে।কবি শঙ্খ ঘোষের পরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে বাংলা কল্পবিজ্ঞান জগতের একচ্ছত্র অধিপতি অনীশ দেবের। বাংলার কল্পবিজ্ঞানের জগৎকে যেসব সমালোচক 'নেই রাজ্যের দেশ ' বলে আখ্যায়িত করেছেন অনীশ দেব ছিলেন তাদের কাছে এক বিস্ময়। আবহমানকাল ধরে ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে সচেতন দূরত্ব বজায় রেখেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলা কল্পবিজ্ঞান জগতের মহীরুহ।
তবে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ধারাটি যে নেহাত নতুন নয় তা হলফ করে করে বলা চলে। অনীশ দেবের অগ্রজ অদ্রীশ বর্ধনের হাত ধরে কল্পবিজ্ঞানের ধারাটি বাংলা সাহিত্যে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করে।তবে তারও আগে সত্যজিৎ রায় এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র ও হেমেন্দ্র কুমার রায়ের মতো লেখকরাও বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় কল্পবিজ্ঞানের সাক্ষর রেখে গেছেন।বাংলা কল্পবিজ্ঞানের সুচনাপর্বে ' মেঘদূতের মর্ত্যে আগমন ' - এর মতো লেখা যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।
বাংলা কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম লেখক অদ্রীশ বর্ধন কল্পবিজ্ঞান সম্পর্কে বলেছেন - "বাস্তব আর অতীতের সমাজের চেহারা নিয়ে যে লেখা তা সায়েন্স ফিকশন নয়,সায়েন্স ফিকশন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এমন সব কাহিনী বলে যায়,যা বিশ্বাস উৎপাদনকারী বিজ্ঞানতত্ব সুরভিত কৌতুহলোদ্দীপক ভবিষ্যত - কল্পনা - কিন্তু একেবারেই অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন।সময় পর্যটন আলোর গতিবেগ ইত্যাদি এই ধরনের অসম্ভব নয় কল্পনা।"
আরও পড়ুন-ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ঠিক কতটা মান্যতা দিচ্ছে সরকার? জানুন অন্দরের কথা
ঠিক এই দৃষ্টিকোণ থেকেই অনেক সমালোচক শঙ্কুর কাহিনিগুলিকে কল্পবিজ্ঞান বলে মানতে চাননি।বস্তুতপক্ষে শঙ্কুর কাহিনি শুরুর ক্ষেত্রে মানিক বাবুও প্রথমদিকে অতটা সিরিয়াস ছিলেন না।পরবর্তীকালে সম্ভবত শঙ্কু চরিত্রটির অসম্ভব জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই সত্যজিৎ শঙ্কু চরিত্রটির প্রতি আরও যত্নবান হয়ে ওঠেন।শঙ্কুর কাহিনীগুলির একটি ধারাক্রমিক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় সমগ্র কাহিনিগুলির মধ্যে পাঠকদের উত্তেজনা,রহস্য এবং রোমাঞ্চ এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে রোমহর্ষক অভিযানের উপাদান মজুত থাকলেও অনেকক্ষেত্রেই কি সত্যজিৎ খাঁটি বিজ্ঞান চেতনার স্বাদ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন?শঙ্কুর গল্পগুলিতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মূল বিজ্ঞান চেতনাকে কি অস্বীকার করা হয়নি? 'মরুরহস্য ' গল্পে যেভাবে একটি অলৌকিক ওষুধের ফর্মুলা পেয়ে বিজ্ঞানী ডিমেট্রিয়াস অতিমানবে পরিণত হয় তা কি আদৌ বিজ্ঞানসম্মত? অথবা মানিকবাবু যেভাবে ডিমেট্রিয়াস মৃত্যুশয্যায় ছটফট করলে ভূমিকম্প হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন তা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি আছে?নাকি সম্পূর্ণটাই লেখকের কল্পনা? আবার ' স্বপ্নদ্বীপ ' গল্পের ক্ষেত্রে লেখক যেভাবে মানুষের থেকে বিদ্যাবুদ্ধি শুষে নেওয়া ফুলের উদাহরণ দিয়েছেন তাকেও বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা কষ্টকর।
শুধু সাহিত্য সমালোচক নয় হুমায়ূন আহমেদ থেকে লীলা মজুমদারের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিকরাও শঙ্কুর কাহিনিগুলিকে ' সায়েন্স ফিকশন ' বলে মেনে নিতে রাজি হননি।তাঁদের মতে এগুলি ' সায়েন্স ফ্যান্টাসি।'
অবশ্য বাংলা কল্পবিজ্ঞানের প্রকৃত সূত্রধর কে সেই নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে। জগদানন্দ রায় এবং হেমলাল দত্ত উভয়েই এই কৃতিত্বের দাবিদার।' প্রাকৃতিকী ' পত্রিকায় জগদানন্দ রায় ' শুক্র ভ্রমণ ' নামক একটি কাহিনি লেখেন।যেখানে ভিনগ্রহীদের মূল উপজীব্য করে তুলেছিলেন তিনি।বেশিরভাগ সাহিত্য সমালোচক মনে করেন বাংলা সাহিত্য জগতে জগদানন্দ রায়ের লেখা ' শুক্র ভ্রমণ ' - ই প্রথম কল্পবিজ্ঞানমূলক কাহিনি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য জগদানন্দ এই কাহিনিটি লেখেন ' The war of the world's' প্রকাশিত হবার আগেই। জগদানন্দ একসময় কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথের নিজের ভূ - সম্পত্তিতে।কবিগুরু তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন - " জ্ঞানের ভোজে এদেশে তিনিই সর্বপ্রথমে কাঁচা বয়সেদের পিপাসুদের কাছে বিজ্ঞানের সহজ পথ পরিবেশন করেছিলেন।"পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ এই জগদানন্দকেই শান্তিনিকেতনের শিক্ষক রূপে নিয়ে যান।
অন্যদিকে হেমলাল দত্ত ১৮৮২ সালে ' বিজ্ঞান দর্পণ ' পত্রিকায় ' রহস্য ' নামে একটি কাহিনি লেখেন। এই কাহিনিতে হেমলাল যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন।কাহিনীটি এগিয়েছে লন্ডন প্রবাসী নগেন্দ্র এবং তার বন্ধু হার্বিকে কেন্দ্র করে।গল্পের পরতে পরতে আছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়।আপনি বাড়ির গেট খুলে যাওয়া,জানলার পর্দা পড়ে যাওয়া অথবা নগেন্দ্র যে ব্রুসের কল দেখে অবাক হয়েছিল এমনকি হার্বির বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে নগেন্দ্র যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে তাতে লেখকের বিজ্ঞানবোধের পরিচয়ই বারংবার প্রকাশ পেয়েছে।
১৮৯৬ সালে জগদীশচন্দ্র কলম ধরলেন। তৈরি হলো কল্পবিজ্ঞান গল্প ' নিরুদ্দেশের কাহিনী।' এর প্রায় পঁচিশ বছর পর গল্পটি ' পলাতক তুফান ' নামে ' অব্যক্ত ' গ্রন্থে স্থান পেয়েছিল। তৎকালীন সময়ে গল্পটি ' কুন্তলীন পুরস্কার ' - এ ভূষিত হয়।
না, মহিলারাও যে কল্পবিজ্ঞান রচনার ক্ষেত্রে খুব পিছিয়ে ছিলেন সেরকম ভাবার কিন্তু খুব একটা কারণ নেই।বেগম রোকেয়ার ' সুলতানার স্বপ্ন ' মাদ্রাজের একটি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে।এর ঠিক তিন বছর পরে 'সুলতানার স্বপ্ন ' বই আকারে প্রকাশ পায়।
ইংরেজ আমল থেকেই বাংলার বুকে সায়েন্স ফিকশনের লেখকরা তাদের কলমকে সচল রেখেছিলেন এখন একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।সুতরাং একথা বলার কোনো অবকাশই নেই যে বাংলা কল্পবিজ্ঞান একেবারেই নবজাতক। হেমলাল, বেগম রোকেয়া প্রমুখ সাহিত্যিকরা বহুকাল আগেই বাংলা সাহিত্যের বুকে কল্পবিজ্ঞানের বিজয়কেতন উড়িয়েছিলেন যা বহন করে নিয়ে গেছেন সত্যজিৎ অদ্রীশ বর্ধন অথবা অনীশ দেবরা। তবে অদ্রীশ বর্ধন বা অনীশ দেবের মৃত্যুতে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগতে যে ভাঁটার টান তৈরি হবে তাও চিরন্তন সত্য।
তথ্যসূত্রঃ - প্রথম আলো
বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান - বিপ্রতীপ