করোনায় আসলে ঠিক কত মৃত্যু হয়েছিল ভারতে?

করোনায় বিশ্ব জুড়ে মৃত্যু সংখ্যা কত? অনেকের মনেই এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সন্দেহ ছিলই। বৃহস্পতিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে তাতে সন্দেহ সত্য বলেই প্রমাণিত হল। সংস্থার এই রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের। এই পরিসংখ্যান বিভিন্ন দেশের সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যের প্রায় তিনগুণ বেশি।
ভারতেও করোনা আক্রান্তদের মৃত্যু লুকোতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার, যার ছবি বিভিন্ন সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে অতীতে। হু-এর রিপোর্টও বলছে, ভারতে করোনা এবং পরবর্তী সমস্যায় ভুগে ৪৭ লক্ষ মানুষ মারা গেছেন। আর তাতেই চক্ষু চড়কগাছে ওঠার জোগাড়। আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে উল্লিখিত মৃত্যুর সংখ্যা ভারত সরকারের দেওয়া অঙ্কের তুলনায় প্রায় দশগুণ বেশি। দেশের সরকারের মতে গত দুবছরে ৪.৮৪ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। বিতর্কিত এই রিপোর্ট অনুযায়ী মৃত্যু সংখ্যার নিরিখে ভারত বিশ্বে প্রথম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট

হু কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, গত বছর পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বিশ্বজুড়ে ১৪.৯ মিলিয়ন অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য,যে বিজ্ঞানীরা এই কাজের দায়িত্বে ছিলেন তারা শুধু করোনার কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা গণনা করেননি, সাথে করোনার প্রভাবে পরবর্তীকালে আক্রান্তদের শরীরে অন্য রোগের কারণে মৃত্যুর সংখ্যাও ধরেছেন। সেজন্যই সরকারি হিসাবের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিপুল ফারাক দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞের দ্বারা তৈরি এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে,ভারতে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৪৭ লক্ষ ভারতীয়ের। করোনার কারণে মৃতদের ৫৭ শতাংশই পূরুষ এবং বাকি ৪৭% শতাংশ মহিলা।২০২০ সালে ভারতে প্রায় ৫.৩ লক্ষ ষাটোর্ধ্ব পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। পরের বছর অর্থাৎ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ লক্ষ। অন্যদিকে, ২০২০ সালে ৩.৫ লক্ষ ষাটোর্ধ্ব মহিলার মৃত্যু হয়েছে যা পরের বছর হয় ১৫ লক্ষ। কিন্তু এই পরিসংখ্যান মানতে নারাজ কেন্দ্রীয় সরকার।

আরও পড়ুন-করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে চিনে, তবে কি শেষ হয়নি অতিমারী?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস বলেছেন, এই তথ্য শুধু যে করোনার প্রভাবে বিশ্বে কী হয়েছে তা বোঝায় তাই নয়, সেই সঙ্গে বুঝিয়ে দেয় যে, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ব্যবস্থাও আরও জোরদার হওয়া দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাড়তি মৃত্যুর ৮৪ শতাংশই হয়েছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও অ্যামেরিকাতে। আর ৬৮ শতাংশ বাড়তি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১০টি দেশে।

ভারতের আপত্তির কারণ

এই রিপোর্টের গবেষণার কাজে যুক্ত বিজ্ঞানীদের অনেকেই বিভিন্ন সংবাদসংস্থাকে জানিয়েছেন, এ বছরের জানুয়ারি মাসেই এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফলাফল সম্পর্কে ভারত অসন্তুষ্ট হওয়ায় ফের একবার পর্যালোচনা করা হয় এই রিপোর্ট। নানাভাবে এই ফলাফলকে প্রকাশ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছিল। হু-এর মুখপাত্র দি নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন যে আমরা এপ্রিলে এই রিপোর্ট প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ  মন্ত্রণালয়ের মতে এই রিপোর্টের তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া সঠিক নয়। পাশপাশি সংখ্যাতত্ত্ব এবং বৈজ্ঞানিক দিক থেকে বিচার করলেও এটি ত্রুটিপূর্ণ। সঠিক পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি এই রিপোর্ট তৈরির জন্য।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে এই বিষয়ে পুরো তথ্য দেয়া হয়েছিল  কিন্তু সেই তথ্য সংস্থার পক্ষ থেকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তারা যে সব সূত্র থেকে তথ্য নিয়েছে, যে গাণিতিক পদ্ধতিতে মৃতের সংখ্যা গণনা করেছে, এবং তাদের গণনার ফল ভারতের মতে ঠিক নয়। রিপোর্ট প্রকাশের পর হু এর মুখপাত্র ডক্টর সামিরা আসমা জানিয়েছেন যে ভারতের সাথে এই বিষয়ে কথাবার্তা চলছে।
তবে ভারতের এই প্রবণতা নতুন নয়। এর আগেও স্বাস্থ্যমন্ত্রক 'সায়েন্স' নামক একটি সংস্থার রিপোর্টকেও ভুল বলে দাগিয়ে দিয়েছে।সেই রিপোর্টেও দাবি করা হয়, ভারতে করোনায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি তথ্যের তুলনায় প্রায় সাত আট গুণ বেশি। মার্চ মাসে  'দ্য ল্যানসেট' পত্রিকার রিপোর্টের জন্য ব্যবহৃত পরীক্ষা পদ্ধতিও সঠিক নয় বলেই জানায় কেন্দ্রীয় সরকার। ল্যানসেটের ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল ভারতে প্রায় ৪০ লক্ষ করোনা আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে।

আরও পড়ুন-করোনার XE সাব-ভ্যারিয়েন্ট কী? কতটা ক্ষতিকর ভাইরাসের এই নতুন রূপ?

মিশিগানের স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ভ্রমর মুখার্জি নিউইয়র্ক টাইমস-কে জানিয়েছে, ' আমি মনে করি বিজ্ঞানকে বিজ্ঞান দ্বারাই প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।আপনাদের কাছে বিকল্প কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি থাকলে তা নিয়ে আলোচনা করুন।কিন্তু  আমরা মেনে নেব না, একথা বলা একেবারেই ঠিক নয়'।

তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দাবি ভারতকে বার বার অনুরোধ করার পরও তারা মৃত্যুর পরিসংখ্যান জমা দেয়নি।তাই সংস্থার গবেষকরা ভারতের ১২ টি রাজ্যের বিভিন্ন সূত্রকে কাজে লাগিয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। রিপোর্টের কাজে যুক্ত সংখ্যাতত্ত্বের অধ্যাপক ওই সংবাদপত্রকে জানিয়েছে,'ভারত এই রিপোর্টের ফলাফলে খুশী না হওয়ায় আমরা সবদিক থেকেই পুনরায় একে পর্যালোচনা করেছি এবং আমরা সব দিক থেকেই প্রস্তুত'। তবে প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা সংক্রান্ত তথ্যের অভাব দেখা গেছে রাশিয়া, চিন, ইজিপ্ট বাংলাদেশের মোট দেশের ক্ষেত্রেও।

দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের আনন্দ কৃষ্ণাননের মতে, ' রিপোর্ট প্রকাশ করতে না দেওয়ার সবরকম প্রচেষ্টা থেকেই প্রমাণিত অতিমারীর তথ্য আদতে কতখানি স্পর্শকাতর বিষয় মোদি সরকারের কাছে'।

শুধু হু নয়, ভারতের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গলাতেও শোনা গেছে সরকার প্রদত্ত মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃত্যু অনেক বেশি,যা চেপে যাচ্ছে ভারত সরকার। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?

More Articles