শীতের অপরিহার্য আশ্রয়! কেন লেপের রং লাল হয়

Red Coating: পৃথিবীর এত রঙের মধ্যে লেপের তুলো কেন শুধুমাত্র লাল রঙের আভায় মোড়া থাকে?

রাত বাড়লেই হিমেল হাওয়া জানান দেয় শীত আসছে। আর শীতকাল শুরু হলেই প্রত্যেক বাঙালির আলমারি থেকে যেমন বের করতে শুরু করে সোয়েটার, জ্যাকেট, মাফলার তেমনই হেমন্তের আগমনের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রত্যেক বাড়ির ছাদেই দেখা যায় লেপ, কম্বল রোদে দেওয়ার ধুম। দোকানে দোকানেও উঁকি মারতে থাকে এই শীত। বিভিন্ন দোকানপাট ছেয়ে যায় তুলোয় মোড়া লাল কাপড়ে। শীতকাতুরে বাঙালির হৃদয়ে লেপের স্থানই আলাদা। যতই আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি লেপ বাজারে আসুক না কেন, তা লাল লেপের ঐতিহ্যকে কিন্তু এখনও ছাপিয়ে যেতে পারেনি।

কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, পৃথিবীর এত রঙের মধ্যে লেপের তুলো কেন শুধুমাত্র লাল রঙের আভায় মোড়া থাকে? তাহলে ঘেঁটে দেখা যাক কিছুটা অতীত-বর্তমান।

কথিত আছে যে, লাল কাপড় দিয়ে লেপ বা কম্বল তৈরি শুরু হয় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন জায়গায়।

আরও পড়ুন: বিরিয়ানির হাঁড়িতে লাল শালু বাঁধা থাকে কেন জানেন?

১৭১৭ থেকে ১৭২৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। বলা যেতে পারে, তাঁর আমল থেকে শুরু হয়েছিল লাল কাপড় দিয়ে লেপ তৈরির চল। মুর্শিদাবাদ সেই সময়ে নরম লাল মখমলের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিল। তৎকালীন সময়ে শীতের হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে রাজার জন্য যে বিশেষ লেপ তৈরি করা হতো, তাতে এই মখমল কাপড়েরই ব্যবহার ছিল বেশি। একসময় মুর্শিদাবাদ কার্পাস তুলো চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেই কার্পাস তুলো থেকেই তৈরি হতো রাজার লেপ। প্রথমে তুলো কার্ডিং অর্থাৎ ধুনাই করার পরে কিছুক্ষণ তা লাল রঙে ডুবিয়ে রাখা হতো। তারপর তা শুকিয়ে গেলে তাতে সুগন্ধি আতর মিশিয়ে ভরা হতো মোলায়েম মখমল কাপড়ের ভেতর।

তবে এই মখমল কাপড় তো আর সবার পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। তা ছিল সাধারণ মানুষের একেবারেই সাধ্যের বাইরে। আর সেই কারণেই সাধারণ মানুষ লাল কাপড়ের মধ্যেই তুলো ভরে লেপ তৈরি করতে শুরু করেন। আবার অনেকেই বলেন, লেপ যেহেতু ভারি জিনিস এবং সহজে কাচা যায় না তাই এতে লাল বা গাঢ় রঙ ব্যবহার করা হয়। কারণ লালের ওপর নোংরা বসলেও তা চট করে বোঝা যায় না। আবার অনেকে বলে, এইসব কেবলই গালগল্প। লাল যেহেতু উজ্জ্বল রং, তাই সহজেই ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সেই কারণেই ব্যবসায়ীরা লাল কাপড় দিয়ে লেপ সেলাই করে।

একটি লেপের তুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জমাট বেঁধে যায়, যা সাধারণত লেপকে পাতলা করে ফলে তখন সেই লেপ শীতকাতুড়ে বাঙালিকে আর উষ্ণতা দিতে পারেনা। এই কারণেই, শীত শুরু হওয়ার আগে বাড়ির ছাদে উঠলেই দেখা যায় লাল লেপের হাট। আবার কখনও কখনও বদলানো হয় লেপের তুলো।

তবে এই বর্ণনা বাংলার কিন্তু জয়পুরী রাজায়ের ইতিহাসটা একটু অন্যরকম। সময়টা ১৭৫০-'৬৮-এর মধ্যে। জয়পুরে তখন মহারাজা প্রথম মাধো সিং জাঁকিয়ে রাজত্ব করছেন। সেই সময় একদল মানসুরি, অর্থাৎ, লেপ-কম্বল নির্মাতা আম্বার থেকে জয়পুরে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে তাদেরই মধ্যে কদর বক্স নামের এক ব্যক্তি রাজাকে খুশি করার জন্য তাঁকে একটি ২৫০ গ্রাম ওজনের উন্নত মানের তুলো দিয়ে তৈরি লেপ উপহার দেন। স্বভাবতই মহারাজা উপহার পেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি কদর বক্স-কে প্যাটেল উপাধি দেন, এমনকী, জয়পুরের সওয়াই মানসিং হলের বিপরীতে দু'টি দোকানও উপহার দিয়েছিলেন।

বর্তমানে জয়পুরে কদর বক্সের বংশধরদের বেশ ছোট ছোট অনেকগুলি দোকান রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, রাজার ঐতিহ্যের অনেক অংশই জড়িয়ে রয়েছে এই দোকানগুলির সঙ্গে।

জয়পুরি লেপ তৈরির রহস্য কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এখানের লেপ তৈরির আসল জাদু লুকিয়ে আছে কার্ডিং, অর্থাৎ লেপের তুলো ধুনাই করার মধ্যে। এখানে ধুনাই পদ্ধতি প্রধানত হাতের মাধ্যমেই করা হয়, যাতে লেপের তুলো অনেক বেশি হালকা ও গরম থাকে। জয়পুরে মূলত তিন ধরনের লেপের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সুতি, মখমল এবং সিল্ক। মখমলের তৈরি লেপ সবথেকে বেশি ব্যয়বহুল। আসলে একটি লেপের দাম নির্ধরিত হয় প্রধানত তার কাপড়, তুলো, কার্ডিং পদ্ধতি এবং সেলাইয়ের ধরনের ওপর। জয়পুরী লেপ স্থানীয় কারিগররা হতেই তৈরি করে থাকেন, যা, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে। জয়পুরী রজাইয়ের বিশেষত্ব হলো, এটির নান্দনিকতা এবং সুন্দর নকশা। যার মধ্যে প্রায়শই পুরাতনী রাজপুতানার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়।

তবে ইতিহাস যাই হোক, কুয়াশাভরা হেমন্তের ভোরে কিংবা নিশ্চুপ রাতে রক্তিম আভার লেপই যে প্রিয় বন্ধু, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

More Articles