বিরিয়ানির হাঁড়িতে লাল শালু বাঁধা থাকে কেন জানেন ?
Biriyani: লাল কাপড়ে মোড়া বিরিয়ানির হাঁড়ি দেখলেই খিদে বেড়ে যায়, মনে পড়ে যায় শুধু বিরিয়ানির কথা।
ভারতে বিরিয়ানি ব্যাপক জনপ্রিয় একটি খাবার। বিরিয়ানি পছন্দ করেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কখনো কি একটি বিষয় খেয়াল করেছেন যে বিরিয়ানির হাঁড়িতে সবসময় লাল কাপড় পেঁচানো থাকে। হয় তো খেয়াল করেও বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাননি। আসুন তাহলে আজকে এর আসল কারণটা খোঁজার চেষ্টা করি আমরা।
আমরা সকলেই জানি যে বিরিয়ানি মোগলাই খাবার। মুঘলরা ভারতে আসার পর বিরিয়ানির প্রথম প্রচলন হয় দিল্লি এবং লখনউতে। এখন তা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ থেকে শুরু করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। খাদ্য পরিবেশনে এই প্রথা ও রঙের ব্যবহার শহর লখনউয়ের নবাবরাও অনুসরণ করতেন। সমাজ জীবনে তাই অভিজাত্য, বনেদি, উষ্ণতা প্রকাশে লাল বা লাল শালুর ব্যবহার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। ৬ মে, ১৮৫৬ সালে কলকাতায় পৌঁছান নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। এর পর তিনি জীবনের শেষ ৩০ বছর কাটিয়ে দেন কলকাতাতেই। মেটিয়াবুরুজ হয়ে ওঠে নতুন লখনউ। এই ওয়াজিদ আলির জন্যই কলকাতা বিরিয়ানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কলকাতা প্রথম বিরিয়ানির স্বাদ পেয়েছিল লখনউর নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ-র দৌলতেই। অনেকে বলেন, ওয়াজেদ আলি শাহ-ই নাকি আর্থিক টানাটানির কারণে বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন করেছিলেন। যদিও এই তথ্য কতটা সঠিক তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।বিরিয়ানির স্বাদ-গন্ধকে অনেক আগেই এ শহরের মানুষ আপন করে নিয়েছেন। বিরিয়ানির ইতিহাস নিয়ে এখন আর তাঁরা মাথা ঘামাতে চান না। চিকেন বিরিয়ানি, মাটন বিরিয়ানি, ডিম বিরিয়ানি, আলু বিরিয়ানি বা ভেজ বিরিয়ানি রয়েছে পছন্দের তালিকায়।
বর্তমানে ইউটিউবের ফুডব্লগারদের কারণে বিরিয়ানির প্রতি বাঙালিদের টান আর ভালবাসা যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। আজকাল সকলের মুখে মুখে ঘুরছে দাদা-বৌদি বিরিয়ানি, ডি-বাপি বিরিয়ানি, বিরিয়ানি প্লাজা, বম্বে বিরিয়ানি প্রভৃতির নাম। এখন তো শহরের রাস্তাঘাটে আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে এখন বিরিয়ানির দোকান। দোকানের একশো মিটারের মধ্যে এসে পড়লেই নাকে বিরিয়ানির গন্ধ আর লাল কাপড়ে মোড়া ইয়াব্বড় হাঁড়ি৷ ওইটুকই সিগন্যাল হিসেবে যথেষ্ট বিরিয়ানিপ্রেমীদের জন্য৷
আরও পড়ুন-কোথা থেকে বিরিয়ানি এল এই শহরে? কেন কলকাত্তাইয়া বিরিয়ানিতে আলু ‘মাস্ট’
বিরিয়ানির দোকানের একশো মিটারের মধ্যে এসে পড়লেই নাকে বিরিয়ানির গন্ধ আর লাল শালুতে মোড়া বিরিয়ানির বিশাল হাঁড়ি চোখে পড়তে বাধ্য। হাড়ির মুখের জম্পেশ করে এঁটে থাকা ঢাকনাটি খুলতেই সুগন্ধে ভরে চারপাশ৷ লম্বা লম্বা চাল, মোলায়েম মাংসের টুকরো৷ সঙ্গে একটা বড় আলুর টুকরো আর ধবধবে সাদা সিদ্ধ ডিম৷ ব্যাপারটা এক্কেবারে জমে ক্ষীর! থুরি জমে বিরিয়ানি৷ আর লোভনীয় খাবারটির তো কত প্রকারভেদ রয়েছে ৷ চিকেন বিরিয়ানি, মটন বিরিয়ানি, আন্ডা বিরিয়ানি, আলু বিরিয়ানি, ভেজ বিরিয়ানি কিংবা ফিশ বিরিয়ানি৷ পেটে সামান্য জায়গা খালি রয়েছে, অথচ অবলীলায় বিরিয়ানির দোকান পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন... এমন সাধ্যি কার! বিরিয়ানির টান অবহেলা করে দোকান পেরিয়ে চলে যাবেন, এমন শক্ত মনের মানুষ বোধহয় খুব কমই আছেন। লাল শালু দেখে বিরিয়ানিপ্রেমীরা স্পেনীয় ষাঁড়ের মত দৌড়বেন, এমনটাই কি ভাবেন দোকানের মালিকরা ?
কত ধরনের তো বিরিয়ানি হয়, কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন কী বিরিয়ানির হাঁড়ির গায়ে জড়ানো কাপড়টির রং বদলায় না কেন ? সবসময়ই কেন বিরিয়ানির হাড়িতে জড়ানো হয় লাল শালু ? মুঘল আমলের রীতি অনুযায়ী খাবার পরিবেশনে লাল কাপড় ব্যবহারের কারণে এখনো বিরিয়ানির হাঁড়িতে লাল কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং বলা যায় আভিজাত্য বা ঐতিহ্য রক্ষার জন্যই বিরিয়ানির হাঁড়িতে লাল কাপড় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইতিহাসের ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, সম্রাট হুমায়ুনের খাদ্য পরিবেশনে ‘দরবারি রীতি’ অনুযায়ী, রুপোলি পাত্রের খাবারগুলির জন্য লাল কাপড় আর অন্য ধাতব বা চিনামাটির পাত্রগুলিকে সাদা কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আসা হত। মুঘলরা পারস্য সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কথিত আছে যে মোগল সম্রাট হুমায়ুন যখন ইরানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন পারস্য সম্রাট হুমায়ুনের অভ্যর্থনায় লাল গালিচা পেতে দিয়েছিলেন। এছাড়া খাদ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রায় সমস্ত বাসন ও থালাবাটিই লাল কাপড়ে ঢাকা থাকতো। খাদ্য পরিবেশনের এই রীতি ও রঙের ব্যবহার লখনউয়ের নবাবরাও অনুসরণ করতেন। সেই থেকেই বিরিয়ানির পাত্র লাল কাপড়ে ঢাকার রীতি চলে আসছে।
প্রত্যেকটি রঙেরই এক একটা আলাদা অর্থ থাকে। যেমন সাদা রং শান্তির প্রতীক, গেরুয়া রং ত্যাগের প্রতীক ঠিক সেই রকমই লাল রংয়েরও একটা আলাদা অর্থ আছে। লাল রং বিদ্রোহের প্রতীক। একই সাথে এই লাল রং বিপদের অর্থও বহন করে। খেলার মাঠে লাল কার্ডের অর্থ ‘বেরিয়ে যাও’ আবার প্রেমিক প্রেমিকার ক্ষেত্রে লাল ভালোবাসার রং। এ ছাড়া শৌর্য,আক্রমণ ও বোঝানো হয়ে থাকে লাল রং এর দ্বারা। অনেকেই মজা করে বলে থাকেন ভালোবাসার রং লাল হওয়ায় বিরিয়ানিতে লাল কাপড় মোড়া থাকে। কারণ বিরিয়ানিও তো খাদ্যরসিকদের কাছে ভালোবাসারই এক নাম। তবে বিরিয়ানিতে লাল কাপড়ের ব্যবহার আসলে কোনো অর্থ বোঝানোর জন্য নয় এই ব্যবহার মুঘলদের সৌজন্যে।
তবে এক্ষেত্রেও মতান্তর রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ইতিহাস বা ঐতিহ্যের রীতি মেনে নয়, ব্যবসার খাতিরে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বিরিয়ানির পাত্র লাল কাপড়ে মুড়ে রাখা হয়। এর ফলে দূর থেকেই তা ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। ক্লাস টেনের ভৌতবিজ্ঞানে আমরা সকলেই পড়েছি লাল রংয়ের আলোক-তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় তা অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। খানিকটা সেই কারণেই লাল কাপড় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে কারণ যাইই হোক না কেন, লাল কাপড়ে মোড়া বিরিয়ানির হাঁড়ির সঙ্গে আমার মত অসংখ্য ভোজন রসিক মানুষের একটা সম্পর্ক দীর্ঘ বেশ কয়েক দশকে তৈরি হয়েছে। লাল কাপড়ে মোড়া বিরিয়ানির হাঁড়ি দেখলেই খিদে বেড়ে যায়, মনে পড়ে যায় শুধু বিরিয়ানির কথা।