হঠাৎ কেন জেলেনস্কির জ্যাকেট বিক্রি হল লন্ডনে?

পোশাক কিছু ক্ষেত্রে স্মৃতিবাহকও হয়ে ওঠে, ঠিক যেমন ঘটেছে জেলেনস্কির ক্ষেত্রে।

 

গায়ে খাকি টি-শার্ট,আবার কখনও তার ওপর খাকিরঙা ফুলহাতা জ্যাকেট বা সোয়েটার। কোনও সেনাপ্রধান বা পুলিশ নয়, এই পোশাকে দেশের রাস্তায় দেখা মিলেছে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানের। তাও আবার দেশ যখন রাশিয়ার আগ্রাসনের সম্মুখীন। গত কয়েক মাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গাগুলো ঘুরে দেখা হোক বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভা- সর্বত্রই এই রঙের পোশাকে উপস্থিত ছিলেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভালদিমির জেলেনস্কি। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে জেলেনস্কি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বদলে রাস্তায় নেমে দেশবাসী ও সেনাবাহিনীর মনোবল বাড়িয়েছেন। গায়ের খাকি পোশাক সাহস জুগিয়েছে হার না-মানার। এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে দেশবাসী ও সেনাবাহিনী। জেলেনস্কির পরনের খাকি রংয়ের সোয়েটার ইউক্রেনবাসীর কাছে আজ সাহসিকতা, লড়াইয়ের প্রতীক। তবে শুধু দেশবাসী নয়, তাঁর খাকি সোয়েটার যে মন কেড়েছে বিশ্ববাসীর, তা প্রমাণ হল লন্ডনের এক নিলামে। বহু মূল্যে বিক্রি হয়েছে রাষ্ট্রনেতার এই সাধারণ পোশাক।


নিলামের খুঁটিনাটি


'দ্য টেলিগ্রাফ'-এর খবর অনুযায়ী, ইংল্যান্ডের এক নিলামে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সই-সহ জনপ্রিয় খাকি সোয়েটারটি ৯০ হাজার পাউন্ড অর্থে নিলামে বিক্রি হয়েছে। ডলারের হিসেবে যার মূল্য প্রায় ১ লক্ষ ১১ হাজার ডলার। দেশের দুঃসময়ে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সংগঠিত এই নিলাম অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনের টেট মর্ডান গ্যালারিতে। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন স্বয়ং 'সাহসী ইউক্রেন' নামক এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। প্রথমে ৫০ হাজার পাউন্ড থেকে দর হাঁকা শুরু হয় এই সোয়েটারের জন্য। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ইউক্রেনকে সাহায্যার্থে এই অর্থমূল্য খুবই সামান্য প্রেসিডেন্টের পোশাকের তুলনায়। তাঁরা যেন গভীরভাবে বিচার করে তবেই অর্থমূল্য নির্ধারণ করেন। এরপরই এর দাম দাঁড়ায় ৯০ হাজার পাউন্ড। শুধু প্রেসিডেন্টের পোশাক নয় নিলামের জন্য রাখা ছিল একাধিক জিনিস, সঙ্গে ছিল কিভের মেয়র ভিতালি ক্লিটস্কোর তত্ত্বাবধানে দেশের রাজধানী ঘুরে দেখার সুযোগ।

 


ইংল্যান্ডের ইউক্রেন দূতাবাসের তরফ থেকে ট্যুইটারে একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখা হয়েছে, যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন বিশ্বের কেউ ভাবতেই পারেনি যে ইউক্রেন এবং সেই দেশের সরকার তিন দিনের বেশি টিকে থাকতে পারবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়েছে। ভিডিওতে শোনা যায়, "আজ সারা দুনিয়া সাধারণ এক খাকি সোয়েটার পরা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে। এবং এখন রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির সই করা এই সোয়েটার আপনাদের জন্য এসে গেছে।" যুদ্ধের সময় দেশের লড়াইয়ের কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা এবং এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই এই নিলামের আয়োজন করা হয়েছে বলেও জানানো হয় দূতাবাসের পক্ষ থেকে।

আরও পড়ুন: যুদ্ধের দিনগুলোতে প্রেম, ইউক্রেনের এই যুগলদের গল্প চোখে জল এনে দেবে


এই অনুষ্ঠানে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট রাশিয়ার আক্রমণের সময় যুক্তরাজ্যের সাহায্যের জন্য প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। তিনি বলেন, "রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কখনই নিজের লক্ষ্য পূরণে সমর্থ হবেন না। তিনি প্রতিটি ইউক্রেনবাসীর শক্তিকে কখনওই ভাঙতে পারবেন না।"


'দ্য টেলিগ্রাফ'-এর মতে, এই নিলামের প্রধান লক্ষ্যই হল রুশ আক্রমণের মুখে ইউক্রেনকে মানবিকভাবে সব দিক থেকে সাহায্য করা।


পোশাকের রাজনীতি


একসময়ের কৌতুক অভিনেতা জেলেনস্কি ভালোভাবেই বোঝেন, পোশাক কতখানি মানুষের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। শুধু মুখে নয়, রাশিয়ার বোমা-মিসাইলের সামনে জেলেনস্কির পোশাকও নিঃশব্দে দেশবাসীকে লড়াইয়ের এবং পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে। তাঁর পরনের সাধারণ খাকি টি-শার্ট ও সোয়েটার বা জ্যাকেট যুদ্ধের সময়ও তাঁকে জনসাধারণের নেতা করে তুলেছে। জেলেনস্কিই দেশের সেনা ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নাগরিকের হাতে বন্দুক তুলে নেওয়ার মধ্যে যোগসূত্র।

 

ইউরোপীয় ইউনিয়নে বক্তৃতার সময় তাঁর পরনে টি-শার্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদ পিটার স্কিফ। তিনি ট্যুইট করে লেখেন, "বুঝতে পারছি কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে দেশ কিন্তু ইউক্রেন রাষ্ট্রপ্রধানের কি একটা স্যুটও নেই?" তিনি আরও লেখেন, জেলেনস্কি অপমান করেছেন আমেরিকার আইন-প্রণেতাদের। এর উত্তরে অনেকেই বলেছেন, জেলেনস্কির টি-শার্ট অপমানের নয়। বরং তিনি যে মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁদের প্রতীক। সেইসব মানুষগুলোর লড়াইকে সম্মান জানাতেই এই সাধারণ পোশাক।


তবে জেলেনস্কি একা নন, ইতিহাসের প্রভাবশালী নেতারাও এই অস্ত্র ব্যবহার করেছেন একাধিক সময়ে। ফিদেল কাস্ত্রোর সবুজ সামরিক পোশাক ও টুপি এবং চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখ মাও সে তুং উভয়ই জনসাধারণকে একজোট করতে বেছে নিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর পোশাক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাক যুদ্ধে বিজয় ঘোষণার সময় সেনাবাহিনীর পোশাক পড়েছিলেন।


পোশাক কিছু ক্ষেত্রে স্মৃতিবাহকও হয়ে ওঠে, ঠিক যেমন ঘটেছে জেলেনস্কির ক্ষেত্রে। তাঁর পরনের পোশাক রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের স্মৃতি জাগিয়ে দেয়। তাই বীরত্বের চিহ্ন-বহনকারী খাকি এই পোশাক বহুমূল্যের হবে সেটাই স্বাভাবিক।

More Articles