যুদ্ধের দিনগুলোতে প্রেম, ইউক্রেনের এই যুগলদের গল্প চোখে জল এনে দেবে

যুদ্ধের মধ্যেও ইউক্রেনের আকাশে-বাতাসে ভালবাসার মরশুম

 


বাতাসে বারুদের গন্ধ। আকাশে ক্ষণে ক্ষণে উড়ে যাচ্ছে যুদ্ধবিমান। চারিদিকে বোমা-মিসাইলের আছড়ে পড়ার শব্দ। এমন যুদ্ধের আবহে ভালবাসার মানুষের হাত ছেড়ে পড়শি দেশের সীমানায় আশ্রয়ের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। তবে বিরহের এই সময়েও পরস্পরের কাছে ফিরে আসার তীব্র জেদ। যুদ্ধ-পরবর্তী ভগ্ন শহরের বুকেই নিজের ভালবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে মানুষ।

 

উল্লিখিত এই দৃশ্যকল্প কিন্তু কোনও সিনেমার অংশ নয়, বরং কঠিন বাস্তব। যুদ্ধ শুরু হলে ইউক্রেনের শহরগুলোতে এমন কত যুগল আলাদা হয়েছে, কত মানুষ তাঁর ভালবাসার মানুষকে ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। দিন কাটিয়েছেন চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে। যুদ্ধ-শেষে ভালবাসার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করার। অনেকে আবার ভালবাসার মানুষকে নিয়েই থেকে গেছে দেশে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউক্রেনে এমন টুকরো টুকরো ভালবাসার গল্প চোখের কোণে জল এনেছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে বসে থাকা মানুষটিরও। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই ভালবাসার একাধিক গল্প নেট নাগরিকদের মন জয় করে নিয়েছে এবং মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়েছে সেগুলি।

 


ওকসানা এবং ভ্যাসিলভ
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ইউক্রেনের লভিভের একটি হাসপাতালের ওয়ার্ডে এক যুগল অকসানা বালান্ডিনা এবং ভিক্টর ভ্যাসিলভ একসঙ্গে নাচছেন। সদ্যই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে ওই যুগল। তবে ভালবাসার পরিণতিতে বাধা হয়েছে যুদ্ধ। চিরকালের মতো বদলে গেছে এই নবদম্পতির জীবন।

আরও পড়ুন: ইউক্রেনের এই ‘ভূত’-এর ভয়ে কাঁপছে রাশিয়া, আসল ঘটনা জানলে শিউরে উঠতে হয়


২৭ মার্চ, ২০২২। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একমাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ওই দিন ইউক্রেনের লুহানস্ক অঞ্চল থেকে নিজেদের বাড়িতে ফিরছিলেন ওকসানা ও ভ্যাসিলভ। ওকসানা পেশায় একজন নার্স। ফেরার পথে রাস্তায় শত্রুপক্ষের পুঁতে রাখা মাইনে পা পড়েছিল ওকসানার। এর এক মিনিটের মধ্যেই বিস্ফোরণে মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওকসানা। মাইনে পা দেওয়ার পরে কেবল চিৎকার করে ভালবাসার মানুষটিকে বলেছিলেন, "দেখে চলো!" কিন্তু ভ্যাসিলভ তাকানোর আগেই ফেটে উঠেছিল মাইন। ভ্যাসিলিভের কথায়, "যখন বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তখন আমি ওর থেকে এক মিনিটের দূরত্বে ছিলাম। কিন্তু ওকসানা খুবই শক্তিশালী। দুর্ঘটনার পরেও অজ্ঞান হয়ে পড়েনি। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি কী করব।আমি দেখছি ও নড়ছে না।"

 

এর পরের একমাস রাশিয়ার প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মধ্যেই রাত কেটেছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। চিকিৎসায় ওকসানার দুই পা এবং বাম হাতের চারটি আঙুল বাদ পড়েছে। প্রথমদিকে নিজেকে এই অবস্থায় দেখে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি ওকসানা। তাঁদের দুই সন্তানের সামনে এভাবে দাঁড়াতে চাননি তিনি। তবে ভালবাসার মানুষ মনোবল বাড়িয়েছেন ২৩ বছর বয়সি এই তরুণীর। খানিক সুস্থ হয়ে সদ্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন ওকসানা এবং ভ্যাসিলভ। আর তারপরেই আনন্দের নাচ। বিয়ের পরেই নবদম্পতি রওনা দিচ্ছেন জার্মনির উদ্দেশ্যে। সেখানেই কৃত্রিম পা পেতে চলেছেন ওকসানা। নতুন পায়ে ভালবাসার মানুষের সঙ্গে অন্যরকম জীবনে প্রবেশ করবে এই যুগল।


অ্যানা হর্ডেটস্কা ও অনুভব বসিন
অতিমারী ও যুদ্ধ কাটিয়ে নিজেদের ভালবাসাকে পূর্ণতা দিয়েছে অ্যানা এবং অনুভব। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ইউক্রেন থেকে একাই ভারতে ঘুরতে এসেছিলেন অ্যানা। সেই সময়ই দিল্লিতে আলাপ পেশায় উকিল অনুভবের সঙ্গে। অ্যানা নিজে একজন আইটি প্রফেশনাল। অনুভবই যে মনের মানুষ, তা আলাপের কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলেন অ্যানা। কিন্তু ততদিনে অতিমারীর কারণে স্তব্ধ গোটা বিশ্ব। নিজের দেশে ফিরে অ্যানাও ঘরবন্দি। করোনা পরিস্থিতি খানিক ঠিক হলে ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণ করল রাশিয়া। একদিন সকালে হঠাৎ মিসাইলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে অ্যানার। যুদ্ধ শুরু হলে মা এবং পোষ্য কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে বাঙ্কারে আশ্রয় নেয় সেই ইউক্রেনীয় তরুণী। এরপর কোনওক্রমে মা ও প্রিয় পোষ্যকে গ্রামে ঠাকু'মার বাড়ি যাওয়ার ট্রেনে তুলে দেন। আর অন্যদিকে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যানার ভিসার ব্যবস্থা করেন অনুভব। অবশেষে ১৭ মার্চ দিল্লি এসে পৌঁছন অ্যানা। ভালবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধার আশায় কিছু জামাকাপড় এবং ঠাকু'মার দেওয়া উপহার কফি মেশিন নিয়ে দেশ ছাড়ে অ্যানা। অনুভবও আর সময় নষ্ট করেননি। বিমানবন্দরেই বিয়ের প্রস্তাব দেন অ্যানাকে। রাজি হয়ে যান অ্যানাও। অবশেষে দিল্লিতে কাছের মানুষদের সামনে বিয়ে সারেন অ্যানা ও অনুভব। শুধু যুদ্ধ থামলে দেশে ফিরে পোষ্য কুকুরকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চান অ্যানা।


বিয়ের হুজুগ
এ-বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া প্রথম ইউক্রেনে আক্রমণ করে। যুদ্ধের সময় দেশের পুরুষদের ইউক্রেন ছাড়তে নিষেধ করে জেলেনস্কির সরকার। নিজের ভালবাসার মানুষকে ছেড়ে অনেক মহিলা সন্তানকে বাঁচাতে আশ্রয় নেন পাশের দেশে। অনেকে আবার ভালবাসাকে ছেড়ে যেতে নারাজ। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে হাজার অনিশ্চয়তার মধ্যেও হাতে হাত রেখে পাশে রয়ে গেছেন কেউ কেউ। ইউক্রেনের বিচারবিভাগের তথ্য বলছে, পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মার্চ মাস অবধি ১০ হাজার ৬৮৩ জন দম্পতি বিয়ে করেছেন। দেশের সেনা, পুলিশ আধিকারিক ও চিকিৎসকরা অনেকেই পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতিতেই বিয়ে করেছেন নিজের ভালবাসাকে।


মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে এসেছে 'খেরসনে বিয়ে সারলেন চিকিৎসক', ' চেরনিভে গাঁটছাড়া বাঁধলেন এক সৈনিক', 'রাজধানী কিভে বিয়ে করলেন এক চিকিৎসক ও এক স্বেচ্ছাসেবক' - এমন খবর। বেশিরভাগ যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের থেকেই এই ধরনের খবর আসতে শুরু করে। অন্য এক সূত্র থেকে জানা যায়, প্রায় ১১,০০০ দম্পতি যুদ্ধের সময়েই ভালবাসার মানুষের সঙ্গে পথ চলার শপথ নিয়েছেন।

 

যুদ্ধের প্রথম দিনে ভালবাসা
অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, এক তরুণ ও তরুণীর গায়ে সেনাবাহিনীর পোশাক। ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনে সেনাবাহিনীতেই তাঁদের প্রথম দেখা। যুদ্ধের সঙ্গেই পরস্পরের মনের দরজায় কড়া নেড়েছে ভালবাসা। পরিস্থিতি ঠিক হলে পরস্পরের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে চায় তাঁরা। যদিও তাঁদের নাম জানা যায়নি। কিন্তু তরুণীর গলায় শোনা গেছে, "যুদ্ধ থামলে আমরা একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতে চাই। সময় কাটাতে চাই পরস্পরের সঙ্গে। এটাই এখন সবচেয়ে বড় স্বপ্ন আমার।" রণসজ্জায় সজ্জিত তরুণ সেনার এক হাতে বন্দুক আর অপর হাত তরুণীর হাতে।পরস্পরের পথ চলার সঙ্গী। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউক্রেনে ভালবাসার জয়জয়কার।

More Articles