মমতার স্বপ্নের তাজপুর বন্দর কি আদানির হাতে? আদৌ লাভ হবে রাজ্যের?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয়বার সরকার গড়ার সময় থেকেই স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এবারে তাঁর লক্ষ্য হবে, বাংলায় ব্যবসা বৃদ্ধি এবং বাংলার ছেলে-মেয়েদের এই রাজ্যেই কর্মসংস্থান। বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন থেকে শুরু করে সিলিকন ভ্যালি প্রোজেক্টের গতিপ্রকৃতি নিয়ে চিন্তাভাবনা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় সরকারের লক্ষ্য একেবারে যেন স্থির। আর সেই লক্ষ্যেই আরও একধাপ এগোনোর পথে তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প– তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দিঘা-লাগোয়া তাজপুর সমুদ্রসৈকতে গঠিত হবে একটি গ্রিন ফিল্ড সমুদ্র বন্দর। প্রাথমিকভাবে এই সমুদ্র বন্দরে পণ্য ওঠানো এবং নামানোর ক্ষমতা হবে বছরে পাঁচ কোটি মেট্রিক টন। আর মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রকল্পে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে ভারতের বিজনেস টাইকুন গৌতম আদানির ‘আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড’ (APSEZ)।
জানিয়ে রাখা ভাল, আদানি পোর্টস সংস্থাটি কিন্তু ভারতের সবচেয়ে বড় বন্দর পর্যবেক্ষক সংস্থা। কর্নাটক বাদ দিয়ে সমুদ্র-লাগোয়া ভারতের সবক’টি উপকূলবর্তী রাজ্যেই এক-একটি বন্দর রয়েছে এই কোম্পানির। আর এই সংস্থাই ৯৯ বছরের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে তাজপুর গভীর সমুদ্রবন্দরের, এমনটা জানা যাচ্ছে। যদিও এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি এবিষয়ে, বিষয়টি বিধানসভায় বিবেচনাধীন। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন’ এই তাজপুর সমুদ্র বন্দরের জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছিল। সূত্রের খবর, সেই টেন্ডার নিলামের প্রতিযোগিতাতেই সজ্জন জিন্দালের ‘জেএসডব্লিউ’ গ্রুপকে টেক্কা দিয়েছে আদানির সংস্থা।
হলদিয়ার একাংশের পর পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বন্দর হিসেবে তাজপুর বন্দরের দায়িত্ব গ্রহণ করল গৌতম আদানির ‘APSEZ’। কর্নাটক বাদ দিয়ে ভারতের বাকি সবক’টি উপকূলবর্তী শহরেই বন্দরের দায়িত্বে বর্তমানে এই সংস্থা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দরের একাংশের উন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে আদানির ‘অ্যাপসেজ’। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পোর্ট অথরিটি’-র কাছ থেকে বেশ মোটা অঙ্কের বিনিময়ে হলদিয়া বন্দরের দায়িত্ব গ্রহণ করে এই সংস্থাটি। তবে তাজপুর বন্দর ছিল এই সংস্থার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একপ্রস্থ বৈঠক করে গিয়েছেন স্বয়ং গৌতম আদানি। তারপর থেকে অনেকেই মনে করছেন, তাজপুর বন্দরের দায়িত্ব যাচ্ছে আদানির সংস্থার কাছেই।
তাজপুর বন্দর নিয়ে ইতিমধ্যেই চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে গৌতম আদানির সংস্থা। তাজপুর বন্দরকে অত্যন্ত আধুনিক, ভাল গভীরতাসম্পন্ন একটি বন্দর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে APSEZ।
এতদিন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কাছে এরকম কোনও বেসরকারি বন্দর ছিল না। বলতে গেলে, ভারতের আটটি উপকূলবর্তী রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ হল একমাত্র রাজ্য, যা এখনও পর্যন্ত বন্দরের বেসরকারিকরণের দিকে এগোয়নি। এতদিন পর্যন্ত আমদানি-রফতানির জন্য পশ্চিমবঙ্গ মুখিয়ে থাকত শুধুমাত্র কলকাতা এবং হলদিয়া বন্দরের দিকে। কিন্তু তাজপুর আদানির হাতে গেলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে বলে ধারণা ওয়াকিবহাল মহলের।
পশ্চিমবঙ্গের আশপাশের ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ের মতো খনিজ ভাণ্ডার রাজ্যগুলিকেও এতদিন পর্যন্ত শুধু কলকাতা এবং হলদিয়া বন্দরের ভরসায় বসে থাকতে হত। এই দু’টি বন্দরের নাব্যতাও কিছুটা কম, তাই এই দু’টি বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানিও ধাকা খাচ্ছিল অনেক ক্ষেত্রে। পাশাপাশি, উত্তর-পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, নেপাল এবং ভুটানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ একটি গেটওয়ের কাজ করে। তাই এই রাজ্যের বন্দর উন্নত হওয়া ছিল অত্যন্ত প্রয়োজন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া বন্দর এমনিতেই আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে খুব একটা উপযোগী বন্দর হিসেবে খ্যাত নয়। এই বন্দর যেহেতু গঙ্গার ডেল্টা অঞ্চলের মধ্যবর্তী জায়গায় স্থিত, তাই এই বন্দরে নাব্যতার সমস্যা রয়েছে। প্রতি বছর ড্রেজিং করার জন্য হলদিয়া বন্দরে প্রচুর টাকা খরচ হয়। জায়গা কম হওয়ায় এই বন্দরে পূর্ণ ক্ষমতা বিশিষ্ট জাহাজের আসা-যাওয়াটাও একটু কঠিন। পাশাপাশি, মাল্টি পয়েন্ট ডিসচার্জ সুবিধা না থাকায়, হলদিয়া বন্দরে জাহাজ নিয়ে আসার খরচ অনেকটাই বেশি। তাই প্রয়োজন ছিল একটি বিকল্প বন্দরের।
টেন্ডার নিয়মাবলি অনুযায়ী, বিডারদের জানানো হয়েছিল, যাতে তারা নিজেদের রয়্যালটি রেট পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে পেশ করে। সেই রয়্যালটি রেটের হিসেবেই এই বন্দরের দায়িত্ব নিজের হাতে নিতে পেরেছেন গৌতম আদানি। জানানো হয়েছিল, যে বিডার সরকারকে সর্বাধিক মূল্য নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু হিসেবে দিতে পারবে, সেইই দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে এই বন্দরের। এই নেট প্রেজেন্ট ভ্যালুর তুলনাতেই আদানি গ্রুপের কাছে পরাস্ত হন সজ্জন জিন্দাল। তাদের তরফ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে অফার দেওয়া হয়েছিল, তারা ওই বন্দর থেকে পাওয়া মোট রাজস্বের ০.২৩ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে প্রদান করবে। সেখানেই আদানি গ্রুপের তরফ থেকে ০.২৫ শতাংশ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। স্বাভাবিকভাবেই এই তুল্যমূল্য প্রতিযোগিতায় শেষ বাজি জিতে নেন গৌতম আদানি।
যদিও তাজপুর বন্দরের এই নিলামের বাজিতে প্রবেশ করা গৌতম আদানির পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। এর আগেও বিশাখাপত্তনম বন্দরের কার্গো ইস্যু নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে ছিল গৌতম আদানির ‘APSEZ’। প্রথমদিকে এই প্রতিযোগিতা থেকে কার্যত বাদ পড়ে গিয়েছিল এই সংস্থা। তবে পরে আদালতে বিশাখাপত্তনম বন্দর মামলায় কিছুটা স্বস্তি পান আদানি। তারপরেই, তাজপুর বন্দর প্রকল্পের নিলামের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন তিনি।
সুবিধা
তাজপুর বন্দরটি সঠিকভাবে তৈরি হলে এটি হবে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় সমুদ্র বন্দর। এই বন্দরের কর্মক্ষমতাও হবে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বন্দরের থেকে অনেকটা বেশি। অন্যদিকে, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্য উড়িষ্যার সমস্ত খনিজসমৃদ্ধ এলাকার সামনাসামনি জায়গায় তৈরি হচ্ছে এই বন্দর। এই সমস্ত জায়গা আকরিক লোহা, আকরিক কয়লা, জেমস্টোন, মূল্যবান পাথর, লাইমস্টোন এবং সোনা উত্তোলনের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও এই সমস্ত রাজ্যে বড় বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট, ভারতের বড় কিছু স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, হার্ডওয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে। তাই এই জায়গায় সমুদ্র বন্দর থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই সমস্ত শিল্পের ক্ষেত্রে এমন বন্দর প্রয়োজন, যেখানে নাব্যতা বেশি এবং যেখানে বড় জাহাজ প্রবেশ করতে পারে। একজায়গায় একেবারে অনেকটা পরিমাণ প্রোডাক্ট লোডিং এবং আনলোডিং করার মতো বন্দরের প্রয়োজন এই সমস্ত শিল্পের ক্ষেত্রে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাজপুর বন্দর এই সমস্ত শিল্প এলাকার জন্য হতে চলেছে অনেকটাই বেশি সুবিধাদায়ক। অন্যদিকে, তাজপুর অঞ্চলটি জলহাওয়ার দিক থেকেও বেশ ভাল। তাই এই বন্দরটি সমস্ত ঋতুতেই কর্মোপযোগী থাকবে। পাশাপাশি, মনে করা হচ্ছে, এই বন্দরে সিঙ্গল পয়েন্ট ডিসচার্জ সুবিধাটিও দেওয়া হবে, যা হলদিয়া শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দরের থেকেও এটিকে বেশি সুবিধাজনক করে তুলবে মালিকদের জন্য।
কর্মসংস্থান
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প তাজপুর বন্দর যদি তৈরি হয়, তাহলে খুব শীঘ্রই বাংলায় বড় ব্যবসা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই, শর্ত অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে গৌতম আদানির সংস্থাকে শিল্প তৈরির উদ্দেশ্যে ১২৬ একর জায়গা দেওয়া হবে। এই জায়গায় আদানি কঙ্গলোমেরেটস সংস্থাটি একাধিক শিল্প স্থাপন করতে পারে। পরবর্তীতে, তাজপুর বন্দরের কাছাকাছি জায়গায় পোর্ট এস্টেট ডেভেলপমেন্টের জন্য আরও ১,০০০ একর জায়গা লিজ দেওয়ার কথা রয়েছে। এই সমস্ত জায়গায় যদি ভালভাবে শিল্প তৈরি হতে পারে, তাহলে বাংলায় কর্মসংস্থানের জোয়ার আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে যদি আদানি বাংলায় প্রবেশ করে, তাহলে তাকে অনুসরণ করে অন্যান্য কিছু ছোট কঙ্গলোমেরেটস সংস্থাও বাংলায় বিনিয়োগের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও পশ্চিম মেদিনীপুরে যদি বিমানবন্দর স্থাপনের কাজটি সফল হয়, তাহলেও পশ্চিমবঙ্গের শিল্প মানচিত্রে পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
অসুবিধা
তবে তাজপুরের বন্দর তৈরি করা গৌতম আদানির সংস্থার পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ হবে না। এই তাজপুর বন্দর প্রকল্পটি দীর্ঘ শিপিং চ্যানেল এবং ড্রেজিংয়ের সমস্যার জন্য প্রথম থেকেই সমস্যার মুখ দেখছে। এর আগে টাটা গ্রুপের তরফ থেকে তাজপুর বন্দরে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখানো হয়েছিল। তবে পরবর্তীতে তাজপুর বন্দর নিয়ে তারা আগ্রহ হারায়, কেবলমাত্র এই দু’টি সমস্যার জন্য। টাটা এই মুহূর্তে ব্যস্ত উড়িষ্যার চৌমুখ বন্দর তৈরির কাজ নিয়ে। উড়িষ্যার এই বন্দরটি তাজপুর বন্দরের কাছাকাছি এলাকায় স্থাপিত হবে। তাই যদি পরবর্তীতেও তাজপুর বন্দরে ড্রেজিং সমস্যা হয়, তাহলে অনেকেই উড়িষ্যার বন্দরটিকে ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আবার তাজপুর বন্দর আরও সমস্যার মুখে পড়বে। তবে এর থেকেও বড় একটি সমস্যা রয়েছে। তাজপুর বন্দরের সমস্ত জমি রাজ্য সরকারের অধীনে। তাই যদি জমি প্রয়োজন হয়, তাহলে গৌতম আদানির সংস্থাকে সব সময় দরবার করতে হবে রাজ্য সরকারের কাছেই।
এই সমস্ত সমস্যার জন্যই, বন্দর ইন্ডাস্ট্রির বিশেষজ্ঞদের কথায়, “সুবিধা থাকলেও তাজপুর বন্দর তৈরি করা খুব একটা সহজ প্রজেক্ট নয়। যদিও ৯৯ বছরের কনসেশন পিরিয়ড ভারতের বন্দর-শিল্পকে অনেকটাই পাল্টে ফেলেছে। এখন বেসরকারি সংস্থাগুলিও ভারতের উপকূলবর্তী এলাকায় বেসরকারি বন্দর তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এর ফলে বন্দরগুলির কর্মক্ষমতা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে সেই রাজ্যের লাভের অঙ্ক। তবে, তাজপুর বন্দর পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-মানচিত্রকে কতটা পরিবর্তন করবে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।”