বাবা ঔরঙ্গজেব দু'দশক জেলবন্দি করে রেখেছিলেন, উপেক্ষিতা জেব-উন-নিসা আজও বিস্ময়

পরনে সাদা পোশাক, অলংকার বলতে গলায় পরিহিত সাদা মুক্তার মালা। সোনা রূপোয় মোড়া চাকচিক্যময় মোঘল দরবারে এ যেন সাক্ষাৎ সরস্বতীর আনাগোনা। যার প্রবেশমাত্র মোঘল দরবার আলোকিত হত  জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্যুতিতে। ইতিহাসের বিরাট অঙ্কের পাতা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রক্তাক্তময়, শক্তিশালী মোঘল অধ্যায়ে যে প্রজ্ঞাশিখা সকলের দৃষ্টির অন্তরালেই থেকে গেছে, তিনি মোঘল সম্রাজ্যের শেষ শক্তিশালী সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কন্যা, জেব-উন-নিসা।     

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা হয়েও, তিনি ছিলেন পিতার একেবারে বিপরীতাভিমুখী। তাঁর জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে গেলে দিন ফুরিয়ে যাবে। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি গোটা কোরান মুখস্থ করে ‘হাফিজা’ তকমা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেব কন‍্যার মেধায় এতই খুশি হয়েছিলেন যে, সেই সময়ে তিনি দুই দিনের জাতীয় ছুটি অবধি ঘোষণা করেছিলেন এবং কন‍্যাকে উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন ৩০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা। শুধু তাই নয়, জেব-উন-নিশার শিক্ষিকা হাফিজা মারিয়ামকেও তিনি শিক্ষা দানের জন‍্য পুরস্কার বাবদ দিয়েছিলেন তিরিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। ‘হাফিজা’ স্বীকৃতি লাভের পর রাজকুমারী জেব-উন-নিসাকে কলা এবং বিজ্ঞানে পারদর্শী করে তোলার উদ্দেশ্যে মোহম্মদ সাইদ আশরাফ মাজান্দারানি নামে এক পারসি কবিকে নিয়োগ করা হয়। কিছুদিনের মধ‍্যেই তিনি দর্শন, জ‍্যোতির্বিদ‍্যা, ইতিহাস, গণিত, ধর্মতত্ত্ব এবং সাহিত‍্যে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি একজন অত‍্যন্ত দক্ষ ক‍্যালিগ্ৰাফার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। রাজকুমারীর চোদ্দ বছর বয়সে তিনি যখন পারসি কবিতার চর্চা করছিলেন, তখন তিনি তাঁর শিক্ষক দ্বারা কবিতা লেখার জন্য গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হন। এই সময় থেকেই তাঁর কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয়।  

সম্রাট ঔরঙ্গজেব সাহিত্য এবং শিল্পের বিশেষ অনুরাগী না হওয়ায়, সম্রাটের চোখ এড়িয়েই সেই সময়ে মোঘল দরবারে, গোপনে সাহিত্যিকদের সভা তৈরি হয়েছিল। সেই সভায় উপস্থিত থাকতেন বিখ্যাত সব জ্ঞানীগুণী কবি, সাহিত্যিকরা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানি কাশ্মীরি, নাইমাতুল্লা খান এবং আকিল খান প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গ। কবিতা এবং শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগে, সমস্ত পর্দা প্রথার অবসান ঘটিয়েই জেব-উন-নিসা ক্রমে এই গোপন সভার একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেছিলেন। আবার অন্য সূত্রে জানা যায়, সেইসময়ের একজন পণ্ডিত এবং মোঘল দরবারের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব শাহ রুস্তম গাজী, রাজকুমারীর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে অনুরোধ করেন জেব-উন-নিসাকে সেই সভায় যেতে অনুমতি দেওয়ার এবং তাঁর অনুরোধেই ব্যাতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি তাঁকে কবি, সাহিত্যিকদের সাহিত্যে সভায় অংশগ্রহণে অনুমতি দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত, বাংলা সাহিত্যের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত

তাঁর সাহিত্যচর্চা যে এইখানেই সীমিত ছিল তা নয়। বরং তিনি তাঁর প্রাপ্ত অর্থের বেশিরভাগই ব্যয় করতে শুরু করলেন শিল্প এবং সাহিত্যের কাজে। শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, জানা যায় সেইসময় সম্ভবনাময় অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্য কর্ম প্রকাশ করার জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের সাহিত্য ভাণ্ডারকে আরও নতুন নতুন সাহিত্যের দ্বারা সম্মৃদ্ধ করে তোলা এবং একই সাথে সুযোগ থেকে বঞ্চিত সেইসব সম্ভবনাময় সাহিত্যিকদের এক পরিচয় দান করা। এখানেই থেমে না থেকে, তিনি লেখক, লিপিকার এবং বিভিন্ন জ্ঞানী মানুষদের একত্রিত করে বিশেষ একটি সাহিত্য বিভাগ শুরু করেছিলেন। এই বিভাগে বিভিন্ন সাহিত্যকেরা তাঁদের নিজেদের লেখা এবং বিশ্বের অন্যান্য প্রসিদ্ধ সাহিত্য কর্মগুলির অনুবাদকার্য সম্পাদনা করে থাকতেন। শোনা যায়, তিনি সম্পূর্ণ নিজের খরচে মোল্লা সাফলুদ্দিন আদবেলিকে কাশ্মীরে পাঠিয়েছিলেন ‘তাপসির-ই-কবির’ (Tafsir-i-kabir) অনুবাদের জন্য। এই ‘তপসির-ই-কবির’ ছিল কোরানের এক ব্যাখ্যা, অনেকে বলেন এই ব্যাখ্যা স্বয়ং জেব-উন-নিসা-ই রচনা করেছিলেন। তিনি ‘মাখফি’ (makhfi, means a hidden one) ছদ্মনাম ব্যবহার করে নিজের রচনা কার্য চালাতেন। তাঁর এই ছদ্মনামের মধ্যে সুফি বিশ্বাসের খোঁজ মেলে। জীবদ্দশায় তিনি অসংখ্য সাহিত্য রচনা করে গেছেন। তাঁর রচিত, পাঁচ হাজার কবিতা নিয়ে সংকলিত বই ‘ দেওয়ান-ই-মাখফি’ ছাড়াও আরও তিনটি বইয়ের কথা জানা যায়। সেগুলি হল, ‘মনিস-উল-রো’, ‘জেব-উল মনসাদ’, ‘জেব-উল-তাপসির’। এছাড়াও তিনি কয়েকশো গজল রচনা করেছিলেন।

 জেব-উন-নিসা-র অন্য এটি দিক উল্লেখ না করলেই নয়। ঔরঙ্গজেব ক্ষমতায় বসার পর তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে বিভিন্ন যুদ্ধ দমন করার মধ্যে দিয়েই। শাহজাহানের চার পুত্রের মধ‍্যে শুরু হয় সিংহাসন আরোহনের বিবাদ শুরু হলে এবং ক্রমে তা রক্তাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হলে, ঔরঙ্গজেব মোঘল সিংহাসনের প্রথম দাবিদার দারাশুকোকে ১৬৫৯ সালে এবং তাঁর পুত্রকে ১৬৬২ সালে হত্যা করেন । ঔরঙ্গজেবের অন‍্য দুই ভাই‌ও তাঁর হাতে প্রাণ হারান। সমস্ত ভাইদের হত্যা করে তিনি মোঘল সিংহাসনে আসীন হয়ে কন্যা জেব-উন-নিসাকে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক বিষয়ে পরামর্শদানের জন্য নিযুক্ত করেন। মোঘল সাম্রাজ্য এ ঘটনা বিরল।

 কিন্তু এতকিছুর পরেও রাজকুমারীর জীবনের শেষ কুড়ি বছর কেটেছিল কারান্তরালে। একসময় তাঁর প্রিয় ভাই এবং সম্রাটের পুত্র আকবর, সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।  শোনা যায়, জেব-উন-নিসা তাঁর ভাই আকবরের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখলে, সেই অপরাধে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁকে সালিমগড় দুর্গে আমৃত্যু কারারূদ্ধ করে রাখেন, এমনকী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। জেব-উন-নিশা  কোনও বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হননি, কবিতাই ছিল তাঁর প্রথম এবং শেষ ভালবাসা এবং তাই জীবনের শেষ দিন অবধি আল্লাকে উৎসর্গ করে তিনি কবিতা রচনার কাজ চালিয়ে গেছিলেন। অবশেষে ১৭০২ সালে কারারুদ্ধ অবস্থায় তিনি প্রাণত্যাগ করেন।

 

তথ্যসূত্র-

  • দ্যা হেরিটেজ ল্যাব ডট ইন
  • ওয়াইজমুসলিমওম্যান ডট ওআরজি
  • সানডেগার্ডিয়ান লাইভ ডট কম

More Articles