মহানগর টু মন্দার, বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক আসলে 'খিদে'

Hunger in Bengali Movie: খাবার চিরকালই নিরীহ, খিদেই ডার্ক। আর এই ডার্ক চরিত্রের খোঁজ, নানা রূপকে মাধ্যমে তার প্রয়োগ বাংলা চলচ্চিত্রকে আরও বর্ণময় করেছে।

ভুখা মানুষ চিরকালই সুশীল সমাজের বিড়ম্বনার কারণ।  খিদের জ্বালায় সে মুণ্ডুও চিবিয়ে খেতে পারে, অন্তত ইতিহাস তেমনটাই জানে। খিদে শারীরিক প্রবৃত্তি, খিদে মানসিক বিড়ম্বনাও। খিদে তৃপ্তির, আবার খিদে ক্ষমতারও। সুতরাং ভুখা মানুষ, যারা কিনা রাক্ষস হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই জন্মায়, হয় খিদেকে কেন্দ্র করেই সংগঠিত হয় বা সমষ্টি থেকে পৃথক হয়। খিদে খেপিয়ে তোলে, সেই খিদে আবার কাউকে কাউকে সুবিধাভোগীও করে তোলে। হাঁড়িতেই হোক বা হাঁড়িকাঠে, সেই কবে থেকেই খিদে নিজ দাপটে সীমা-সীমানা-সীমান্ত পার করে ফুটনোট রেখে গিয়েছে। খিদে গুহাচিত্রে জ্বলজ্বলে, মহাকাব্যে কুটিল, যুদ্ধে নির্ণায়ক, মন্বন্তরে দর্শক, উদারনীতিতে দুরন্ত খেলোয়াড় আর ধর্মে শাসক। খিদের এই বিবিধ পরতকে ছাড়াতে ছাড়াতে এগিয়ে গিয়েছেন শিল্পীরা। খাবার যতটা নিরীহ, খিদে ততটা নয়। ফলত এই ডার্ক চরিত্রকে কখনও ছবিতে, কখনও সাহিত্যে, কখনও চলচ্চিত্রে ভেঙেচুরে এনেছেন শিল্পীরা।

চলচ্চিত্রের মতো দৃশ্য-শ্রাব্য শিল্প মাধ্যমে খিদেই কখনও যুদ্ধের কারণ হয়ে এসেছে আবার যুদ্ধ থামানোর মন্তরও। বাংলা বলতেই যারা দই আর রসগোল্লার ভুলভুলাইয়া থেকে বেরোতে পারেন না, খিদেকে দিয়ে সেই চেতনার ভিত টলোমলো করে দিয়েছেন পরিচালকরা, নানা সময়ে, নানা আঙ্গিকে। বাংলা চলচ্চিত্রে যুদ্ধ-মূল্যবোধের তলানিযাত্রা-রাজনীতি-পরিত্রাণ সবটুকু জুড়েই খাদ্য ও খাদকের যে বাস্তুতন্ত্র তাকে খিদের চরিত্রায়ণ দিয়ে সেলাই করে গিয়েছেন পরিচালকরা। সত্যজিৎ, মৃণাল সেন থেকে শুরু করে অনির্বাণ ভট্টাচার্য পর্যন্ত ‘খাওয়া’ বিষয়টিকে নানাভাবে নানা প্রেক্ষাপটে খুঁড়ে গিয়েছেন। চলুন সেই খিদেরসফরে চোখ রাখা যাক-

বাইশে শ্রাবণ (১৯৬০): দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগের প্রেক্ষাপটে বাঙালির বাইশে শ্রাবণ-কেন্দ্রিক সমস্ত রোমান্টিসিজমের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে নতুন এক দেখার জন্ম দেন মৃণাল সেন। ঠিক নতুন দেখা নয়, চিরায়ত দর্শনই, যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আমাদের বরাবরের। বাইশে শ্রাবণের ইংরেজি নাম ভাবা হয়েছিল The Wedding Day। যেদিন বিয়ে হয়েছিল প্রিয়নাথ (জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়) আর মালতীর (মাধবী মুখোপাধ্যায়)। প্রত্যন্ত গ্রামের একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সদ্য বিবাহিত দুই চরিত্রের মাঝে পরিচালক রেখে দিয়েছেন তেতাল্লিশের মন্বন্তর। রেখে দিয়েছেন আপনি বাঁচলে বাপের নামের গন্ধ। খাবারের সন্ধানে গাঁ গঞ্জ ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষের সারি আর খাবার জোগাড় করে আনা স্বামীটির সর্বগ্রাসী খিদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে একটা বাংলা এবং এক তরুণী স্ত্রী। কষ্ট করে জোগাড় করা ভাত স্ত্রীর জন্য একটুও বাঁচিয়ে না রেখে সবটুকু খেয়ে সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট তত্ত্ব জিতে যায়, আর স্বার্থপর এক বাইশে শ্রাবণ সানাই গুটিয়ে নেয়, মূল্যবোধ ও ভালোবাসার মুখ দিয়ে কেবলই মন্বন্তর আর যুদ্ধের পচা গন্ধ। রোমান্টিসিজমের ঠিক পাশে এভাবেই একটা যথাযথ খিদে বসিয়ে দেন মৃণাল সেন।

আরও পড়ুন- পুজোয় বাড়ে লাশ, মড়া পোড়ানোর গন্ধে যেভাবে কাটে ডোমের দুর্গোৎসব…

মহানগর (১৯৬৩): মহানগর শব্দটার মধ্যেই শুয়ে রয়েছে এক চূড়ান্ত খিদে। শহরতলি, ছোট শহরকে গিলে গঞ্জ থেকে আসা শ্রমজীবীদের, মেধাজীবিদের নিংড়ে চলে যে মহাকায় নগর, তার পেটের মধ্যে বেড়ে চলা রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের বদলে যাওয়ার গল্প। পুরুষের চাকরি হারানোর গল্প, বিবাহিত স্ত্রীর চাকরি করতে যাওয়ার গল্প, স্বাধীনতা আর আপসের মাঝে খিদের গল্প। সুব্রতর (অনিল চট্টোপাধ্যায়) চাকরি হারানো আর তার স্ত্রী আরতির (মাধবী মুখোপাধ্যায়) পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে চাকরি করতে বেরনোর গল্পে মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ছবি আঁকতে খাবার থালাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৫০ সালের আবহে স্বামী ও চাকরি করতে যাওয়া স্ত্রীর একসঙ্গে খেতে বসা, এবং শাশুড়ির রান্না করার মতো বৈপরীত্যকে সুচারুভাবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক।

নিজের পরিবারের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কী ভাবে একজন মহিলার যাপনে বাড়তি আত্মবিশ্বাস গুঁজে দেয় সেই গল্প পুত্রবধূর পাতে মাছের মুড়ো তুলে দেওয়া, আর পাখার বাতাসের মধ্যেই মিশিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ। দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং পেট চালানোর অনিশ্চয়তার আবহে এক স্বতন্ত্র লড়াইয়ের গতিকে কোথাও এই দৃশ্যগুলোই দিশা দিয়েছে।

গুপি গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯): আবার সত্যজিৎ! আরও সহজ অথচ আরও তীক্ষ্ণ খিদের গল্প। এই খিদে রাজনৈতিক, এই খিদে বিশ্বময়। যুদ্ধের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে এমন ধারালো হাতিয়ার কোনও মারকুটে যোদ্ধারই ভাঁড়ারে নেই সম্ভবত। হাজারে হাজারে হাতিয়ারে কাটাকুটি করে মরে যাওয়া রুগ্ন, আধপেটা খাওয়া বোড়ের দলকে যুদ্ধবিমুখ করেছেন সত্যজিৎ, খিদের ভরসাতেই। আকাশ থেকে খসে পড়া খাবার খেতে হামলে পড়া সেনাদের চরিত্র কোনও যুগেই পালটায় না তেমন। রঙ বদলে, গদি পালটে যারা আসে তারা আসলে ঐতিহাসিক খাদক। তারা দেশ খায়, সংখ্যালঘু খায়, ফ্রিজে থাকা গোপন মাংস খায়, সার্বভৌমত্ব খায়। কিছু খায়, উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে দেয় বোড়েদের মাঝে। স্বল্পাহারে খিদে বাড়ে, আর ভুখা মানুষ চিরকালই রাক্ষস। এখানেই সত্যজিতের স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান। শুধু বোড়ের দলই নয়, যুদ্ধের পিছনের মাস্টারমাইন্ডদের সামনে যখন হাঁড়ি হাঁড়ি মণ্ডা, মিঠাই, মিহিদানা, পুলিপিঠে, জিভেগজা নেমে এসেছে ‘ছুটি…ছুটি’ বলে এগিয়ে এসেছে শুণ্ডির রাজাও। যুদ্ধের ছুটি, অনাহারের ছুটি।

মন্দার (২০২১): খিদেকে মানুষের পোশাক পরালে যা রূপ, ম্যাকবেথ অনুসরণে মন্দারের মুকাদ্দর মুখার্জি (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) তারই স্বরূপ। একটা বড়ো মাছের ছোটো মাছ গিলে খাওয়া হোক, একটা পপুলিস্ট রাজনীতির আনপপুলার আদর্শকে গিলে খাওয়া হোক, ক্ষমতার লোভেকে গিলে খাওয়া হোক সবার মুকাদ্দর হয়ে এসেছে যে সে আসলে খিদে। মুকাদ্দর অর্থে ভাগ্য, কিসমত। যা চমকালেই রাজার ভাগ্যে সিংহাসনের পাসওয়ার্ড জুটে যায়। একটি উপকূলীয় গ্রাম্য জুবানে মুকাদ্দরের পরিশীলিত উচ্চারণ, খাদ্যাভ্যাস এবং চাহিদা দুই মেরুর রাজনীতিকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ক্যামেরায় একে একে লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, মাংস, রসগোল্লা, পায়েসের বাটির পাশে খুলে রাখা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের টুপির যে দৃশ্য তাতে খাদ্য-খাদকের এই শিকল রাখঢাকহীনভাবেই স্পষ্ট। মুকাদ্দর আসলে ভাগ্যই, যার ডাকনাম খিদে।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামীদের আরাধ্য মোরগবাহন বহুচরা দেবী, অচেনার তালিকায় এক রহস্যময় সংযোজন

বাংলা চলচ্চিত্রে খাবার নানাভাবেই ঘুরে ফিরে এসেছে কৌতুকের ঢঙে বা প্রেমের সাধারণ অনুষঙ্গ হিসেবে। গল্প হলেও সত্যি থেকে মাছের ঝোল বা রসগোল্লা। কিন্তু খাবার চিরকালই নিরীহ, খিদেই ডার্ক। আর এই ডার্ক চরিত্রের খোঁজ, নানা রূপকে মাধ্যমে তার প্রয়োগ বাংলা চলচ্চিত্রকে আরও বর্ণময় করেছে।

More Articles