পুজোয় বাড়ে লাশ, মড়া পোড়ানোর গন্ধে যেভাবে কাটে ডোমের দুর্গোৎসব...
Durgapuja of Female Dom: ডোমের না আছে বোধন, না বিসর্জন, না আছে বড়দিন, না আছে মেলা। পুজোয় মড়া বাড়ে, মড়া বাড়লে কাজ বাড়ে, চুল্লির বিশ্রাম নেই।
পশ্চিমদিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা গাড়ি। গাড়ির সামনে একটু ঘষটে যাওয়া হরফে লেখা রয়েছে উদয়ের পথে। সাধারণত এসবই নাম হয়, উদয়ের পথে, স্বর্গদূত, হাবিজাবি…। উদয়ের পথে যেতে গিয়ে গাড়িটা পশ্চিমদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শহরে গাড়ি বেশি, গাড়ি কেটে কেটে উদয়ের রাস্তা তৈরি করে নিতে হয় নিজেকেই। উড়ন্ত খই পথচারীদের মুখে লাগে, চুলে আটকে যায়। পাশ দিয়ে টেম্পো চেপে দুর্গা যাচ্ছে প্যান্ডেলে। সেখানে কয়েকদিন তার কর্মসূচি রয়েছে। অথবা তাঁকে ঘিরে কর্মসূচি রয়েছে। মানুষ উড়ন্ত খইয়ের পাশ দিয়ে প্রণাম করছে দুর্গাকে, প্রণাম করছে উদয়ের পথের যাত্রীকেও। একই প্রণাম ছুঁয়ে যাচ্ছে মৃত আলতা আর ভক্তির আলতাকে, দূর থেকে। দুই মৃত পাশাপাশি চলেছে। একজনের প্রাণ প্রতিষ্ঠা বাকি, অন্যজনের দেহ ছাই হওয়ার অপেক্ষা। উদয়ের পথ গিয়ে শ্মশানে মেশে। শহরের ঢাক ক্ষীণ হয়ে আসে এখানে, ইতস্তত কান্না, কয়েক ছটাক খিস্তি খেউড়, মোবাইলে চলা ভিডিওর আওয়াজ আর স্তব্ধতা এখানে সহাবস্থানে থাকে। একটা কারাগারের ভেতর দরজা হাঁ হয়, শরীর ঢুকে যায়। এরপর ৪৫ মিনিট টুম্পার তেমন ব্যস্ততা থাকে না। বাকি কাজ আগুনের। টুম্পার কাজ কেবল আগুনের হাঁ মুখে দেহকে ঠেলে দেওয়া, ছাই ঘেঁটে অস্থি বের করে আনা। টুম্পা সারা বছর অগুণতি দেহকে বৈতরণী পার করান, চতুর্থীর সকালেও, অষ্টমীর অঞ্জলিকালেও, দশমীর রাত্রেও। ডোমের জীবনে গনগনে চুল্লিই যজ্ঞের আগুনের মতো ঝলসে ওঠে।
টুম্পা দাস পেশায় ডোম। মহিলা ডোম। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ- কাজের এই বিশাল ব্যাপ্তিতে অবশ্য না তো জুতো সেলাই করতে মহিলাদের তেমন দেখা যায়, না তো চণ্ডীপাঠ। ফলত, ডোমের পেশায় আলাদা করে টুম্পাকে মহিলা বলে উল্লেখ করতেই হয়। দশভুজা নিয়ে ছবি আঁকতে বললে আজকাল বাচ্চারা আধুনিক বেশের মহিলার পিছনে আটখানা হাত জুড়ে তাতে বেলনা, স্টেথোস্কোপ, কর্পোরেট ব্যাগ, বাচ্চার ন্যাপি সবই অস্ত্র করে গুঁজে দেয়। সমাজ নিজের তেজ দিয়ে দশভুজা মহামায়া (মহাবিড়ম্বনাও) গড়ে তোলে খাপের খাপ। এসব ছবিতে টুম্পার অবশ্য জায়গা হওয়ার কথা না। অন্ত্যজ পেশা, এত ভিড় ঠেলেঠুলে জাতে উঠতে পারে না। সে পারে বলতে সারা বছর দেহকে ছাই করে দেওয়া, ডোমের না আছে বোধন, না বিসর্জন, না আছে বড়দিন, না আছে মেলা। পুজোয় মড়া বাড়ে, মড়া বাড়লে কাজ বাড়ে, চুল্লির বিশ্রাম নেই। গামছা কাঁধে মানুষজন অপেক্ষা করে, ভাঙা মালসা, এঁটো বিড়ি, চায়ের ভাঁড় ভাঙা সব মিলে অপেক্ষা করে। দেহ যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ শোক সপ্তমে, দেহ ছাই হলে শোকও থিতু হয়ে যায়। শ্মশানযাত্রীরা পুজোর শহরে হারিয়ে যায়, শ্মশানে একা টুম্পা, একা অষ্টমী নিয়ে, একাই দশমীর দিকে এগিয়ে যায়।
২০১৫ থেকে মড়া পুড়িয়ে চলেছেন টুম্পা। বারুইপুরের পুরন্দরপুর শ্মশানে কাজ করেন। বাবা মড়া পোড়াতেন, পেট চালানোর উত্তরাধিকার পেয়েছেন টুম্পা। বাবা যখন হঠাৎ মারা যান, সংসার টানতে টুম্পা ডোমের কাজ শুরু করেন। তখন অবশ্য কাঠের চিতা। তাতে মড়া পুড়তে অগাধ সময় লাগে। সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা কাজের মধ্যে যে যে কাজগুলো পড়ে, তার মধ্যেই পড়ে টুম্পার কাজ। তবে, পুলিশ, নার্স, সাংবাদিক, ডাক্তারের তোলার মতো পেশাদারি কলার টুম্পার নেই। সকাল আটটা থেকে রাত ৮ টা ৯ টা অব্দি কাটে শ্মশানে, মাঝরাতও পেরিয়ে যায় কখনও সখনও। প্রথম প্রথম ভয় লাগত। তখন শ্মশান একটু ঘেরা ছিল, উঁচু উঁচু দেওয়াল, অন্ধকার হলেই গা ছমছম। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টাই কাজ করেছেন টুম্পা। “তখন এখানে কাঠের চিতা হত। চুল্লি ছিল না। আর আমি একাই ছিলাম কাজের দায়িত্বে, আমি আর ঠাকুরমশাই। ফলে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করতাম, কখন কার বডি আসবে তার তো ঠিক নেই। বাড়ি আর শ্মশান- এই আমার জগত,” বলেন টুম্পা।
আরও পড়ুন- বনেদি আভিজাত্যে বিলুপ্তির পথে নীলকণ্ঠ পাখিরা! দশমীর দিনে কেন ওড়ানো হয় এই বিশেষ পাখি?
বাবা যতদিন ছিলেন, পুজোটা স্বাভাবিক ছন্দেই কেটেছে পরিবারের। ষষ্ঠী থেকে শুরু করে পুজোর প্রতিদিন ঘুরতে যাওয়া, নতুন জামা পরার আনন্দ সবটুকুই অটুট ছিল। পরিবার বলতে এখন মা, বোন, ভাই আর বোনপো। “তখন তো বাবাও বেঁচে ছিল, সবাই মিলে খুব মজা হত। বাবা যে সময় পেত খুব বেশি তা নয়। বাবা ঠাকুরও দেখতে যেত না সেরকম। কাজ পড়ে যেত, আমরা যেতাম মায়ের সঙ্গে, সবাই মিলে মজা করতাম,” বছর আটেক আগের কথা মনে পড়ে টুম্পার। টুম্পাদের বাড়ির সামনেই পুজো হয়, সেখানে বসে আড্ডা মারা, খাওয়াদাওয়া- ঠিক যেমনটা হয়, তেমন আনন্দে পরিবারের সঙ্গেই কেটেছে টুম্পার পুজো। জীবন আমূল বদলে গেল ২০১৫ সালে। টুম্পা একহাতে সংসার ধরেন, অন্য হাতে চিতা সাজান। ঠাকুর দেখা, ঘোরা সব একেবারেই বন্ধ। চার বছর কাঠের চিতা সামলে ২০১৯ সাল থেকে ইলেকট্রিক চুল্লির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন টুম্পা। তাঁর আরেকজন সহকর্মী রয়েছেন। সহকর্মীর সঙ্গে ভাগ করে একদিন বা একবেলা হয়তো পুজোতে বাড়িতে থাকতে পারেন। যদি অবশ্য সেই সময়টা সহকর্মী তাঁর কাজ সামলে দিতে রাজি হন। কয়েক ঘণ্টার জন্য ছুটি মেলে, এছাড়া এই কাজ থেকে ছুটি পাওয়া দুষ্কর।
“পুজোর সময় বডির চাপ বেড়ে যায়। গতবছর বিজয়া দশমীর কথা, দশমীর দিন পাড়ার ঠাকুর বিসর্জন হয়। একটু নাচ হয়, হুল্লোড় হয়। সেদিন সামান্য একটু রেডি হয়ে বেরিয়েছি। ঠিক তখনই খবর এল বডি ঢুকেছে। ব্যাস, আবার পোশাক বদলে চলে এলাম শ্মশানে! আমি যে একটু আনন্দ করব, সেটাও হয় না। বডি চলে আসে। যখন বডি পুড়িয়ে বাড়ি যাচ্ছি, ঠাকুর ভাসান হয়ে গেছে। কখন কেমন বডি আসবে বলা তো মুশকিল,” সহজভাবে কথা বলে চলেন টুম্পা। এসব রোজকার কথা, পুজো তাই নতুন করে কোনও ঢেউ তোলে না পুরন্দরপুরের এই ডোমের নিজস্ব জীবনদিঘিতে। পুজোয় বাইরে এত উৎসব, এত আলো, এত পারফিউম, জীবন এত ঝলমলিয়ে ঝিলিক মারে, শ্মশানে তার ছিটেফোঁটা আসেনা। এখানে কেবল কান্নার সংসার, হারিয়ে ফেলার পরস্তাব। ঘাম, কান্না আর ছাইয়ের গন্ধে হাওয়া ভারী হয়ে থাকে। অস্বস্তি হয় না?
টুম্পা আবারও সহজ, “পরিস্থিতি অদ্ভুত ঠিকই। তবে এতবছর এই লাইনে কাজ করছি তো, অভ্যাস হয়ে গেছে। লাগলেও তো কিছু করার নেই। আমারও ইচ্ছা হয়, একদিন বেরোই, সবার সঙ্গে ঘুরতে যাই, কিন্তু কাজের চাপে হয় না আর। দায়িত্বটাও তো পালন করতে হবে আমাকে, তাই না?” এই ‘তাই না’র উত্তরে চুপ থাকাই দস্তুর। দেহ বডি হয়ে গেলে এই সংসারে তাঁর প্রয়োজন ফুরোয়, সংসারও তড়িঘড়ি দেহের ছাপ মুছে ফেলে ছন্দে ফিরতে চায়। নিত্যবর্তমানকে অতীত করে তোলার কত আয়োজন। টুম্পা এই আয়োজনে অনুঘটক সাজেন। বডিকে আলো, বায়ু, মাটি, জলে মিশিয়ে দেওয়ার কাজ সহজ করেন, দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। তাই না?
“আমি যদি ভাবি আমি ঘুরব, তাহলে আমার যিনি সহকর্মী তাঁরও তো ঘোরা হবে না, তাঁরও পরিবার রয়েছে। আমার জন্য আমার বাড়ির লোকও অনেকসময় বেরোতে চায় না। আমি বলি ওদের, বাড়িতে বাচ্চা আছে। ওর আনন্দ আমার জন্য কেন থেমে থাকবে? আমি বলি বেরোও, ঘুরতে যাও,” শ্মশানে বসেই বলে চলেন টুম্পা। বলেন, “এই শীতের সময় কত মানুষ কত জায়গায় ঘুরতে যায় তিন চার দিনের জন্য, আমার সেই সুযোগও নেই। আমি গেলে অন্যজনকে ২৪ ঘণ্টা টানা কাজ করে যেতে হবে। ক’টা দিন এভাবে পারে কেউ কাজ করতে! শীতকাল এলেই বডির চাপ বাড়ে, সারাদিন বসতেও পারি না এত মৃতদেহ আসে।” “আমার জন্য মাঝে মাঝে বাইরে থেকে কিছু ভালোমন্দ খাবার নিয়ে আসে, বাড়িতে বসে একসঙ্গে খাওয়া হয়। এটাই আনন্দ পুজোর। আমি বেরোতে পারি না বলে মা মাঝেসাঝে বাড়িতে একটু ভালো রান্না করে। কোনও দিন দুপুরে ছুটি পেলে সেটা একটু আরাম করে খাওয়া হয়, যদি না বডি থাকে! আর বডি থাকলে দুপুরে খাওয়াও হয় না অনেকসময়। পুজোয় রোজ ৫/৬ টা করে বডি তো আসেই,” পুজোয় যারা ছিল থেকে নেই হয়ে গেছে, তাঁদের হিসেব টুম্পার খাতায় লেখা থাকে এভাবেই।
আরও পড়ুন- কালে কালে জৌলুস হারিয়েছে পুজোসংখ্যা? কী মত লেখকদের
শ্মশানে পোড়াতে আসে পুরুষরাই বেশি, পুড়তে আসে সবাই। মহিলা ডোম দেখে অবাক হয় মানুষ, অবাকের আগে আগে চলে শোক। শোকার্ত পরিজনের পাশে সাময়িক স্বজন হয়ে যান টুম্পা। দূর মণ্ডপ থেকে ক্ষীণ ভেসে আসে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে,” চেতনারূপে সকলে মিলে ডাকাডাকি করছে দুর্গাকে, দুর্গা চৈতন্য দেবেন, শান্তি দেবেন, নিদ্রা দেবেন, বুদ্ধি দেবেন, ক্ষুধা দেবেন। সেই ক্ষুধার পেটে আহার জোগাতে টুম্পা নিজেই কখনও ছায়ারূপেণ হয়ে উঠবে, কখনও বৃত্তিরূপেণ। টুম্পা আগুনের দিকে এগিয়ে দেবে দেহকে, বডি বৈতরণী পার হয়ে কোথাও একটা যাবে, যেতে হবে। থাকার নিমিত্ত কেই বা এসেছে। একদিন অন্ধ ইস্কুলে ঘণ্টা বাজে, ছুটি হয়। ছুটি প্রসঙ্গে টুম্পা ফের বলে ওঠেন, “শ্মশানে একমাত্র মেশিন খারাপ হলে আমাদের ছুটি। মানুষ তো সময় বাঁচাতে চায়, একান্তই বয়স্ক কেউ শেষ ইচ্ছেয় বলে না গেলে কাঠে পোড়ায় না কেউ। তখন ছুটি।”
বাকি সময়টা কাজ, সারাবছর ধরে খালি কাজ আর কাজ। মড়া পোড়াও, ছাই ঘাঁটো, অস্থি আনো! যদি ইচ্ছে না করে? যদি মনে হয় এই শ্মশান ছেড়ে পালালে কাশ ফোটা বনে দু’ দণ্ড শান্তির সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যাবে? যদি মনে হয়, ভোগের খিচুড়ির গন্ধ লাশ পোড়ানোর চেয়ে ঢের আরামের? যদি মনে হয় ‘বলো হরি’র চেয়ে ‘বলো বলো দুগগা মাইকি জয়’ বলতে বলতে দশমীর দিকে এগিয়ে চলা মানুষের মধ্যে ভিড়ে যেতে পারলেই মুক্তি?
“যে মানুষের স্বজন মারা যাচ্ছে তাঁরা ইতিমধ্যেই এত কষ্টে আছে, এসে যদি দেখে শ্মশান বন্ধ, পোড়ানোর লোক নেই, তাঁদের হয়রানি প্রচুর হবে। কাউকে তো কম্প্রোমাইজ করতেই হবে,” বলেন টুম্পা। কম্প্রোমাইজের মধ্যে দিয়ে সংসার, খিদে, কর্তব্যের ঠেলাগাড়ি এগিয়ে যায়, এক অনন্ত দশমীর দিকে, ডোমের দশমীর দিকে।