দিনমজুরি করেই স্বপ্ন পূরণ! কীভাবে ল্যাপটপ কিনে মাসে দুই লক্ষ টাকা আয় করছেন এই বাঙালি?

A Bengali Success story : দিনমজুরি করে ল্যাপটপ কিনে মাসে এখন ২ লাখ টাকা আয়, নেপথ্যে এক বাঙালি

আজকাল মাঝেমাঝেই কিছু মেসেজ নেট মাধ্যমে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়, “ঘরে বসে ল্যাপটপে অনলাইনে কাজ করে রোজগার করুন”... এরকমই কিছু একটা হয়তো চোখে পড়েছিল তারও। কিন্তু অনলাইনে কাজ করতে গেলেও তো দরকার একখানা ল্যাপটপ। সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবার, দুবেলা দু মুঠো অন্ন জোগাতেই যাদের নাভিশ্বাস উঠে যায়, তাদের কাছে তো ল্যাপটপ খানিক বামনের চাঁদ ধরার স্বপ্নের মতোই। কিন্তু স্বপ্ন দেখার অধিকার তো সকলেরই আছে। কবির ভাষায় বলতে গেলে, “কার তাতে কি, আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি?”

আর এই আকালে স্বপ্ন দেখার নেশাটাই তাড়িয়ে বেরিয়েছে বাংলাদেশের নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার পশ্চিম মাধনগর গ্রামের বাসিন্দা নিয়ামুলকে। তিন ভাইবোনের সংসারে সেই বড়। বাবা মোহাম্মদ হোসেন আলী প্রামাণিক ও মা রেনুকা বেগম। ছোট থেকেই টানাটানির সংসারে বেড়ে ওঠা নিয়ামুলের। কিন্তু অভাব কখনও পড়াশোনায় বাধা আনতে পারেনি তার। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় স্কুলের গণ্ডি পার করে সে। কিন্তু তারপর? সামনে ধূ ধূ অন্ধকার.... কী করবে সে? এদিকে সংসারের অভাবও মাথাচাড়া দিচ্ছে, পরপর দুটো বোন। তাই রোজগারের তাগিদটা তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করল ক্রমশ। পাশের গ্রামেই থাকতেন তাঁর খুড়তুতো ভাই শামসুল আলম। তিনি অনেকদিন যাবৎ গ্রামে বসেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন। দাদার কাজ থেকেই সাহস সঞ্চয় করে সেও। স্বপ্ন দেখার শুরুটা ঠিক এভাবেই।

আরও পড়ুন - অবশেষে রহস্য উদ্ধার! কোথায় বসে আছেন ভিঞ্চির মোনালিসা? জানলে চমকে উঠবেন…

এরকম সময় পথ দেখায় একটি অনলাইন ভিডিও।স্কিলআপার নামের একটি ফেসবুক পেজে প্রশিক্ষক শামীম হোসাইনের একটি ভিডিও দেখেন নিয়ামুল। সেই থেকেই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানতে শুরু করেন নিয়ামুল। এই আগ্রহ আর স্বপ্নকে সঙ্গী করেই শুরু হল তাঁর অন্য এক লড়াই। অভাবকে হয় করার নতুন সফর।

কখনও খেতে মাটি কাটার কাজ, কখনও আবার জমিতে ধান লাগানো এমনকী মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজও করতে শুরু করেন নিয়ামুল। যখন যেমন কাজের খোঁজ পেয়েছেন এগিয়ে গিয়েছে সে। লক্ষ্য একটাই, স্বপ্ন পূরণ। আর পরিবারে মুখে ফুটে ওঠা একটা চওড়া হাসি। ওই দিন মজুরির কাজ করে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে অবশেষে ঢাকায় এসে ৪২ হাজার টাকায় একটি পুরোনো সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ কেনেন নিয়ামুল।

A Bengali Success story

ল্যাপটপ তো এল এবার শুরু হল নতুন কাজ শেখার পালা। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে গেলে তো সবার আগে প্রয়োজন সঠিক প্রশিক্ষণ। পাশাপাশি টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা তো রয়েছেই। এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে আবার বাড়তি কোর্সের খরচ! আবার শুরু হল দিন মজুরের কাজ করা। একটু একটু করে টাকা জমিয়ে অনলাইনে ওই স্কিলআপার নামে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ডিজিটাল বিপণনের কোর্স করেন। টানা পাঁচ মাস ধরে চলে শেখার কাজ। এই সময় তিনি গুগল অ্যাডস, ওয়েব অ্যানালিটিকস এবং সার্ভার-সাইড ট্র্যাকিং-এর কাজও শেখেন। প্রশিক্ষণ শেষের পর ২০২২ সালে ইন্টারনেটে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া নেওয়ার জন্য একটি নিজস্ব অ্যাকাউন্ট খোলেন নিয়ামুল। প্রথম কাজের পারিশ্রমিক ছিল ২০ মার্কিন ডলার। তখনও দিন মজুরের কাজ করতেন তিনি। হয়তো মাঠে ধান কাটতে কাটতেই কখনও কখনও পকেটের ফোনটা বেজে উঠত। আবার নতুন কাজের বরাত।

আরও পড়ুন - গর্ভের মধ্যেই ভ্রূণের মাথায় বিরল অস্ত্রোপচার! চিকিৎসা জগতে শোরগোল ফেলল যে ঘটনা

শুরুটা ঠিক যতটা কঠিন ছিল এর পরের গল্পটা ঠিক ততটাই সহজ। এতদিন ধরে যে সময়ের অপেক্ষায় লড়াইটা জারি রেখেছিলেন নিয়ামুল, এখন সেই সময় আসন্ন। ক্রমেই কাজের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে তাঁর। একটার পর একটা নতুন কাজের দাওয়াত আসে। ওই একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপের ওপর আর নির্ভর করার জো থাকে না বেশিদিন। একটা ল্যাপটপ থেকে বেড়ে এখন তাঁর ঘিরে একাধিক ল্যাপটপের ছড়াছড়ি। তবে আজও নাটোরের ওই নলডাঙ্গার বাড়িতে বসেই ল্যাপটপে কাজ করেন তিনি। সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের সেই ছেলেটার আয় আজ প্রায় মাসে দুই হাজার ডলার, অর্থাৎ টাকার হিসেবে ২ লাখেরও বেশি। শুধু কাজই নয়, পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়ামুল। নাটোরের শহীদ নজমুল হক সরকারি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন তিনি।

ছেলে প্রতিষ্ঠিত, বাবার ধার দেনা আজ আর নেই। মোটরসাইকেল কেনার স্বপ্নও ছেলে পূরণ করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। এখানেই শেষ নয় নিজের আয় দিয়ে কৃষিজমি ও চারটি গরু কিনেছেন নিয়ামুল। বাবার খামারটা আরও বড় করার ইচ্ছে তাঁর। এখানেই শেষ নয় পাশাপাশি গ্রামের উন্নতিতেও কাজ করতে চান তিনি। না নিয়ামুল নিছক একটা নাম নয়, একটা স্বপ্ন পূরণের উদাহরণ। যে স্বপ্ন তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে সেই একই স্বপ্নের নেশা যিনি বুনে দিতে চান গ্রামের আরও পাঁচটা বেকার ছেলে মেয়ের চোখেও। যার রেশ ধরে হয়তো তারাও একদিন, হয়তো কেন নিশ্চয় তারা একদিন জীবনের সফলতার গল্প বুনে যাবে অচিরেই...

 

সূত্র - প্রথম আলো 

More Articles