ভারতে বৈবাহিক সম্পর্কে গিয়েই আত্মহত্যা করছেন মানুষ! শিউরে ওঠা সত্য প্রকাশ পেল সমীক্ষায়

National Suicide Prevention Strategy: ২০২১ সালে প্রায় ৪২০০৪ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেন। তার পরিমাণ মোট আত্মহত্যার পরিমাণের ২৫.৬ শতাংশ।

অর্থনৈতিক টানাপোড়নের সঙ্গে ভারতবর্ষের সমঝোতা নতুন নয়। প্রতিমুহূর্তেই কোনও না কোনও ভাবে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে এই দেশ। তবে অর্থনীতির মতো এই দেশের আরেকটি মূল সমস্যা হলো আত্মহত্যা। সেই কারণেই চলতি বছরের ২১ নভেম্বর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশল বা নিয়মাবলী আনা হয়। যার মুখ্য উদ্দেশ্য আগামী ১০ বছরের মধ্যে সমগ্র ভারতবর্ষে এই ধরনের অপরাধ যতটা সম্ভব নিষ্ক্রিয় করা। এছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যাতে জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত কেউ সহজে নিতে না পারে। একজন মানুষ আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত সাধারণত দু'টি কারণে নিয়ে থাকে, একটি সামাজিক; অন্যটি মানসিক। তবে একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে শক্তিশালী হলে সামাজিক পাঁক তাঁকে সহজে ছুঁতে পারে না। সেই কারণেই এই আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশলের মূল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের মানসিক পরিকাঠামোর উপর বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সেল্ফ হেল্প গ্রুপ এবং মানসিক চিকিৎসকদের যৌথ সহায়তায় ভারত সরকারের উদ্দেশ্য ২০২৩ সালের মধ্যে আত্মহত্যার পরিমাণ ১০ শতাংশ কমিয়ে আনা।

জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ বা ন্যাশনাল সুইসাইড প্রিভেনশন স্ট্র্যাটেজি আসলে কী?

জাতীয় আত্মরক্ষা প্রতিরোধ কৌশলের মূলত তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে।

প্রথমত, আগামী তিন বছরের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা। অর্থাৎ কোনও ব্যক্তির কোনওপ্রকার মানসিক সমস্যা দেখা দিলে সবার প্রথম তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

দ্বিতীয়ত, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি জেলায় মনোরোগ চিকিৎসা বিভাগ তৈরি করা। যাতে কোনও রোগী যেকোনও সময় তাঁর মানসিক চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন।

তৃতীয়ত, সরকার থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে আগামী ৮ বছরের মধ্যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে মানসিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্যক্রমগুলি ছাত্রছাত্রীদের সিলেবাসের আওতায় নিয়ে আসা।

জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশলকে বাস্তবায়িত করার জন্য মূলত পাঁচটি স্তরে কাজ করা হবে। প্রথম সংস্থাটি হবে ভারত সরকারের, দ্বিতীয় স্তরে থাকবে রাজ্য সরকার এবং তৃতীয় স্তরে জেলা আধিকারিকেরা থাকবেন।। এছাড়াও মানসিক চিকিৎসা সংস্থা 'নিমহানস' এই প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত থাকবে। সর্বশেষ স্তরে থাকবে বিভিন্ন এনজিও, মানসিক রোগের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।

আরও পড়ুন- বোতামে আলতো চাপ, এক মিনিটে যন্ত্রণাহীন আত্মহত্যা, সাহায্য করবে এই স্টাইলিশ যন্ত্র

তবে একথা সকলেরই জানা যে, কোনও উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন হয় সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের। দ্বিতীয়ত, আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে গেলে স্বাস্থ্যসেবাকে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে একথাও সত্য, স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি তখনই হবে যখন সাধারণ মানুষ তা চাইবে। সুতরাং সামাজিক স্তরে সচেতনতা গড়ে তোলা সবথেকে প্রয়োজন । অন্যান্য রোগ নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বললেও মানসিক রোগ নিয়ে কথা বলতে আমরা নিজেরাই সংকোচ বোধ করি। সুতরাং এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভারতের মতো দেশে সাধারণ মানুষকে সবার আগে বোঝাতে হবে মানসিক রোগও বাকি আর পাঁচটা রোগের মতই খুব সাধারণ। বিশেষ করে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, ৮ থেকে ৮০ সকলেই কোনও না কোনওভাবে মানসিক সমস্যায় ভোগেন।

জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতবর্ষে প্রতি বছর ১ লাখেরও বেশি মৃত্যু হয় শুধুমাত্র আত্মহত্যার কারণে। এবং ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যেই এই ধরনের ঘটনার প্রবণতা সবথেকে বেশি। ২০১৯-এর আগে পর্যন্ত প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার পরিমাণ ছিল ১০.২। যা বর্তমানে ২০১৯ থেকে ২০২২ এর মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ১১.৩।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (NCRB) সম্প্রতি ভারতের মৃত্যু এবং আত্মহত্যার উপর ভিত্তি করে একটি পরিসংখ্যান রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যা থেকে জানা যায়; ২০২১ সালে প্রায় ৪২০০৪ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেন। তার পরিমাণ মোট আত্মহত্যার পরিমাণের ২৫.৬ শতাংশ। এই প্রথমবার দৈনিক উপার্জন করা মানুষের আত্মহত্যার পরিমাণ এত বেশি।

আত্মহত্যার মূল কারণ গুলি কী কী?

সমীক্ষা অনুযায়ী জানা গেছে, ৩৩.২ শতাংশ আত্মহত্যা হয়ে থাকে পারিবারিক সমস্যার কারণে। ৪.৮ শতাংশ আত্মহত্যা হয়ে থাকে শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। এছাড়াও ১৮.৬ শতাংশ আত্মহত্যা হয় অসুস্থতার কারণে।

২০২১-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সব থেকে বেশি আত্মহত্যা হয়েছে মহারাষ্ট্রে, তারপর তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশে। গত বছর মোট আত্মহত্যার পরিমাণের ১৩.৫ শতাংশই হয়েছে মহারাষ্ট্রে। এছাড়াও দিল্লিতে মোট আত্মহত্যার পরিমাণ ২৮৪০।

আরও পড়ুন-হু হু করে বাড়ছে কৃষক আত্মহত্যা! দেশজুড়ে অন্নদাতাদের দুর্দশার দায় কার 

আত্মহত্যা কমাতে ভারতের কী কী উদ্যোগ বর্তমান?

মানসিক স্বাস্থ্য সেবা আইন ২০১৭-এর লক্ষ্য মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা। সামাজিক ন্যায় বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার চিন্তা এবং অন্যান্য মানসিকভাবে দুর্বল মানুষদের সহায়তা প্রদানের জন্য ২৪/৭ টোল ফ্রি হেল্পলাইন ‘কিরণ' চালু করেছে। যাতে দিনের যে কোনও সময় শুধুমাত্র একটি ফোন কলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ পর্যাপ্ত সুবিধে পেতে পারেন।

এছাড়াও আত্মনির্ভর ভারত অভিযানের অধীনে শিক্ষামন্ত্রকের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হল ‘মনোদর্পণ'। বিশেষত কোভিড-১৯ এর সময় ছাত্রছাত্রী, পরিবারের সদস্য এবং শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

উদ্যোগ নেওয়াই শেষ কথা নয়। প্রয়োজন বাস্তবায়নের। একটি উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করা হবে। সুতরাং জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশলের উদ্দেশ্য এবং উদ্যোগগুলি জানা গেলেও তা কতটা বাস্তবায়িত হবে এখন সেটাই দেখার।

 

More Articles