বোতামে আলতো চাপ, এক মিনিটে যন্ত্রণাহীন আত্মহত্যা, সাহায্য করবে এই স্টাইলিশ যন্ত্র
Suicide Machine: এতে শুয়ে একটি মাত্র বোতামে চাপ দিলেই মেশিনটি নাইট্রোজেন গ্যাসে ভরে ওঠে। যার ফলে শায়িত ব্যক্তির শরীরে অক্সিজেন কমে যেতে থাকে দ্রুত।
‘গুজারিশ’ ছবিটা ভারতে তেমন চলেনি। একজন পঙ্গু জাদুকর তার শেষ মিরাকলটির জন্য লড়ে যাচ্ছেন। সম্পূর্ণ শরীর পক্ষাঘাতে স্থির। শুধু মাথার ভিতর অতীতেরা আড্ডা দেয়, রঙিন দিনের নেশা জাদুকরকে আরও ক্লিষ্ট করে। তারই মাঝে “মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান”। সেবারত নার্সের সঙ্গে প্রেম, এবং সেই ক্লিষ্ট জাদুকরের সংস্পর্শে প্রেমিকা স্বয়ং জাদুকর হয়ে ওঠে। ঘটিয়ে ফেলে পঙ্গু জাদুকরের বহুকাঙ্ক্ষিত শেষ মিরাকলটি। বিয়ের রাতে মুক্তি। প্রেমিকার বিষের জাদুতে ঘুমের মধ্যেই শান্ত, কোমল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জাদুকর। জীবনের খাঁচা আর তাঁকে পিষতে পারে না অবিরত। কী ভাবছেন? আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে? না। কোনও কিছুকেই মহিমান্বিত করা ঠিক নয়। কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে আত্মহত্যাও যথাযথ। ভারতের আইন এখনও সে কথা স্বীকার করে না। কিন্তু সুইজারল্যান্ড ইতিমধ্যে এমন একখানি মেশিন তৈরি করে ফেলেছে, যার সাহায্যে বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে মানুষ। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। সম্প্রতি সেই মেশিন আইনি স্বীকৃতি পেল।
ইয়ুথেনেশিয়া বা অ্যাসিস্টেট সুইসাইডের কোনো যোগ্য বাংলা তর্জমা নেই। ‘ইচ্ছামৃত্যু’র এমন একটি পৌরাণিক অনুষঙ্গ ভারতীয় সমাজে বর্তমান যে তার সঙ্গে ইয়ুথেনেশিয়ার ধারণা খুব একটা যায় না। তবে বিদেশে এ জিনিস দীর্ঘকালব্যাপী হয়ে আসছে। ফ্রয়েডের নাম আজ মোটামুটি সবাই জানেন। কড়া সিগার খেতেন। তার থেকে চোয়ালে ক্যানসার। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ইয়ুথেনেশিয়া বেছে নিয়েছিলেন। আজকাল বেশ কয়েকটি দেশে এটি আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। আমেরিকা মহাদেশের দশটি দেশে এবং কলম্বিয়ায় সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ অথচ মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সমর্থ প্রাপ্তবয়স্কদের ইয়ুথেনেশিয়ার অধিকার দেওয়া হয়। তবে ছ’মাস তার আগে পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। এর মধ্যে যদি শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটে, বা মানসিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে রোগী অসমর্থ হয়ে পড়ে, তবে ইয়ুথেনেশিয়ার অনুমতি মেলে না।
আরও পড়ুন- তামাকেই মৃত্যু! যে কারণে দেশে হু হু করে বাড়ছে মুখের ক্যানসারে আক্রান্তর সংখ্যা
নেদারল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের মতো দেশগুলিতে মানসিক বা/এবং শারীরিকভাবে চূড়ান্ত পীড়িত ব্যক্তিকে ইয়ুথেনেশিয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু সুইশ আইনে এমন কোনও কারণ নির্দিষ্ট করা নেই। সুইশ আইন অনুযায়ী যে কোনও ব্যক্তিই আত্মহত্যায় সাহায্য করতে পারেন, যদি সেই আত্মহত্যার সঙ্গে তার স্বার্থ না জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ পরিকল্পিত খুন বা অর্থলাভের সম্ভাবনা থাকলে সহযোগীকে দোষী হিসেবেই দেখবে আইন।
এই সুইজারল্যান্ডেই ফিলিপ নিচকে নামক এক ব্যক্তি কয়েক বছর আগে একটি মেশিন তৈরি করেন। মেশিনটি দেখতে কফিনের মতো। অত্যন্ত সুদৃশ এবং স্টাইলিশ। নাম সার্কো। এটির মাধ্যমে বিনা যন্ত্রণায় আত্মহত্যা সম্ভব। এতে শুয়ে একটি মাত্র বোতামে চাপ দিলেই মেশিনটি নাইট্রোজেন গ্যাসে ভরে ওঠে। যার ফলে শায়িত ব্যক্তির শরীরে অক্সিজেন কমে যেতে থাকে দ্রুত। শায়িত ব্যক্তি কয়েক মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। দমবন্ধ হয়ে আসা বা অন্যান্য শারীরিক কষ্টজনিত দুর্ভোগ বিন্দুমাত্র পোহাতে হয় না। অক্সিজেনের অভাবে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু। এবং এই মেশিন আত্মহত্যাকারীর ইচ্ছা মতো যত্রতত্র নিয়ে যাওয়া যায়। নির্বাচিত জায়গায় চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন সেই ব্যক্তি।
আরও পড়ুন- স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের
মেশিন তৈরি হয়ে গেলেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল নিচকে-কে। এর নানান সমস্যার দিকগুলি তুলে ধরেছিলেন নানা প্রাজ্ঞজন। ড্যানিয়েল সামসে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেনেডি ইনস্টিটিউট অফ এথিকসের ডিরেক্টর। ক্যাপসুলটির বিলাসবহুল গাড়ির মতো চকচকে নজরকাড়া ডিজাইনের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। তাঁর মতে আত্মহত্যাকে গ্ল্যামারের মোড়কে পেশ করা হচ্ছে এভাবে। এই বিষয়ে অনলাইনে নিচকের খোলামেলা আলোচনাকেও ভালো ভাবে গ্রহণ করেননি ভদ্রলোক। বলেছেন, এতে করে ছোঁয়াচে রোগের মতো আত্মহত্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্ষরিক অর্থেই আত্মহত্যার ব্যাপারটা ছোঁয়াচে। তার এমন মহিমান্বিত উপায় সম্বন্ধে নিচকের আন্তর্জালে খোলামেলা পোস্ট দেওয়াটা উচিত হয়নি। এমনকি স্টিফেন ডাকওয়র্থ নামের এক উকিল, তিনি ইয়ুথেনেশিয়ার সমর্থক হয়েও এই মেশিনটিকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, ইয়ুথেনেশিয়ার মতো সংবেদনশীল ব্যাপারে সবার আগে নিরাপত্তার বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত। রাগের মাথায় যদি কেউ ব্যবহার করে ফেলেন এই মেশিন? যদি কোনও শিশুর হাতে পড়ে? যদি খুনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়? যদি শান্তিপূর্ণ ভাবে মৃত্যু না ঘটে ব্যক্তিটির, এবং সাহায্যটুকু পর্যন্ত চাইবার অবস্থায় না থাকেন তিনি? এমন অজস্র সম্ভাবনার উল্লেখ করেন ভদ্রলোক।
যদিও নিচকের বক্তব্য ছিল, বছর পঞ্চাশের ওপরে যাদের বয়স তাঁদেরকেই সার্কো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হবে এবং অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে তাঁর মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য। পুরোটাই অলাভজনক পদ্ধতিতে এগজিট ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা আয়োজিত হবে। সেই মেশিনকেই আইনি স্বীকৃতি দিল সুইজারল্যান্ডের সরকার। গত বছরেই ইয়ুথেশিয়ার সংখ্যা সুইজারল্যান্ডে মোট ১৩০০। সেই ঘটনাকে সামনে রেখেই এই মেশিন উন্নত পরিষেবা দেবে বলে মনে করছেন নিচকে। আপাতত দু’টি প্রোটোটাইপ রয়েছে। আরো একটি প্রোটোটাইপ থ্রিডি প্রিন্টিং করতে চলেছে এগজিট ইন্টারন্যাশনাল। সামনের বছরের মধ্যেই পুরোপুরি কাজ করবে এই সার্কো। আদতেই কি ইয়ুথেনেশিয়াকে গ্ল্যামারাইজ করবে এই মেশিন? নাকি উপকৃত হবে মানুষ? শেষ কথা বলবে সময়ই।