মধু কিনতে গেলেই ঠকছেন! খাঁটি আর ভেজাল মধু চিনবেন কীভাবে?

Pure Honey: প্রাকৃতিক খাঁটি মধু যে কোনও পাত্রে কিছুদিন রেখে দিলে মধুর পরাগরেণুর হালকা আবরণ পড়বে৷ এই পরাগরেণু বা পোলেন হল উন্নতমানের প্রোটিনের উৎস এবং এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো

মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব!

মধুর মধু আলো, মধুর মধু বায়।

রবীন্দ্রনাথ ‘প্রভাত সংগীত’ কবিতায় এভাবেই করেছেন মধুবন্দনা। মধুর মিষ্টতা পছন্দ নয়, এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। পৃথিবীতে সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ মধু ব্যবহার করে আসছে নানা ভাবে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৭০০০ বছর থেকে মানুষ মধু ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। কেনিয়ায় বসবাসরত মাসাই উপজাতি মধুকে ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত মিষ্টি পানীয় মনে করতেন এবং দল বেঁধে বাউরের নামক গাছ থেকে মধু সংগ্রহ করতেন। মায়া সভ্যতায় বিয়ের কনেকে মধু উপহার দেওয়ার রীতি ছিল। আবার, গ্রিকরা মনে করতেন, মধু শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য নয়, শক্তিশালী ওষুধও বটে। তাছাড়া গ্রিকদের খাদ্য সংস্কৃতিতে প্রায় বিশাল একটা অংশ জুড়ে ছিল মধু। মিষ্টি জাতীয় সব খাবারে মধুর ব্যবহার হত। রোমানরা মনে করতেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ হচ্ছে মধু। তাঁরাও রান্নায় অধিক পরিমাণে মধু ব্যবহার করতেন। ১৭০০ শতকের দিকে ইউরোপের লোকজন চিনির বদলে মধু ব্যবহারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

প্রকৃতি থেকে পাওয়া উপাদান মধু। মৌমাছির চাক থেকে সংগ্রহ করা ষোলো আনা খাঁটি মধুর স্বাদই থাকে আলাদা। তবে মধু সংগ্রহের পর মাঝের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অনেক সময়ে আসল মধুই পাওয়া যায় না৷ আবার সঠিক সংরক্ষণের অভাবে এর পুষ্টিগুণও কমে যায়। মধুর রয়েছে বিভিন্ন ধরন এবং তার ওপর নির্ভর করে স্বাদও হয় ভিন্ন। সাধারণত খলিসা মধুকেই সবচেয়ে ভালো মধু বলা হয়ে থাকে। খলিসা মধু মানে দেখতে সাদা এমন ফুলের মধু। কিন্তু মধুর রং খুব গাঢ় আর স্বাদও হয় খুব কড়া ও মিষ্টি। সাধারণত ফাল্গুন মাসে এই ফুলের মধু পাওয়া যায়। পশুর ফুলের মধু একটু কম গাঢ় (হালকা লালচে) ও মিষ্টি হয়। সাধারণত চৈত্র মাসে এই মধু পাওয়া যায়। বাইন মধু সহনীয় মিষ্টি, খলিসা বা পশুর মধুর মতো কড়া নয়। সাধারণত আষাঢ় মাসে এই মধু পাওয়া যায়। কেওড়া মধু একটু টক-মিষ্টি। এই মধু দেখতে সাদা রঙের, সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসে পাওয়া যায়। গেওয়া একটু তিতকুটে স্বাদের হয়, যা বেশি রূপচর্চায় ব্যবহার করা হয়।

চিকিৎসাক্ষেত্রে মধুর ব্যবহার বেশ পুরনো। নানা রোগের ওষুধ হিসেবে মধু ব্যবহার করা হয়। পুষ্টিগুণ ও শারীরিক উপকারিতার বিষয় বিবেচনা করলে খাঁটি ও প্রাকৃতিক মধুর কোনও বিকল্প নেই। মধুতে থাকা বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদানের কারণে এর উপকারিতার শেষ নেই। হজমে সহায়তা বা শ্বাসকষ্ট নিরাময় থেকে শুরু করে বিভিন্ন কঠিন রোগের বিরুদ্ধে মধু শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। তা ছাড়া চিনির পরিবর্তে প্রতিনিয়ত মধু খেলে বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলতেও এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের মধু পাওয়া গেলেও এগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়ে রয়েছে অনেক ধাঁধা। আবার না বুঝে অস্বাস্থ্যকর ও ভেজাল মধু খেলে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

আরও পড়ুন- ঘরে ঘরে শিশুদের শরীরেও হানা দিচ্ছে এই ঘাতক ডায়াবেটিস! কীভাবে লক্ষণ চিনবেন

নকল মধু কী এবং ভেজাল মধু কী

নকল মধু: মৌমাছিরা ফুলে ফুলে ঘুরে ফুলের নেকটার সংগ্রহ করে তাদের মৌচাকে জমা করে যে মধু তৈরি করে সেটিই আসল প্রাকৃতিক মধু৷ বাজারের সব মধুই আসল মধু নয়৷ আপনি খুব সহজেই খোলা বাজার থেকে নকল মধু কিনে প্রতারিত হতে পারেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কেমিক্যালের মিশ্রণের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে এই নকল মধু তৈরি করে থাকেন৷ এসব নকল মধু শরীরের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর৷ এমনকী দীর্ঘদিন নকল মধু খেলে ক্যান্সার সহ বিভিন্ন জটিল রোগ হতে পারে৷

ভেজাল মধু: বাজারে নকল মধুর থেকে ভেজাল মধুর পরিমাণই বেশি৷ ভেজালকারীরা তাদের মধুকে ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ভালো মধুর সঙ্গে নকল মধু মিশিয়ে থাকেন। আবার অনেকসময় ভালো মধুর সঙ্গে চিনির শিরা বা গুড় মিশিয়েও ভেজাল মধু তৈরি করে থাকেন অধিক লাভের আশায়।

তাহলে কি বাজারের সব মধুই ভেজাল? না! বাজারের সব মধু ভেজাল নয়। বাজারে হাজারো রকমের মধুর মধ্যে কোনটি খাঁটি, তা যাচাই করে সঠিকটি বেছে নেওয়া বেশ কঠিন। অর্থাৎ বাজারের ভেজাল ও খোলা মধুর ভিড়ে খাঁটি মধু খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। মধুর সঙ্গে অতিরিক্ত রং এবং বিভিন্ন ধরনের চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল মধু। এরপর নাম বাহারি মোড়কে তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এগুলোই ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায় আর বিক্রি হচ্ছে সুন্দরবন বা পাহাড়ি অঞ্চলের আসল মধু নামে। তবে খাঁটি মধু চেনার বেশ কিছু ঘরোয়া উপায় রয়েছে। কয়েকটি সহজ পদ্ধতিতে তা যাচাই করা সম্ভব।

মধু চেনার উপায়

আসল মধু চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হল মধুর সঠিক বৈশিষ্ট্য জানা৷ আপনি যদি জানেন কোন মধুর বৈশিষ্ট্য কেমন তাহলে ভেজাল বা নকল মধু কিনে প্রতারিত হবার সম্ভাবনা খুবই কম৷

  • সুন্দরবনের মধু এবং একক কালোজিরা ফুলের মধু ব্যতীত সকল মধু একটি নির্দিষ্ট সময় পরে জমে যাবে। সরিষা ফুলের মধু, ধনিয়া ফুলের মধু, লিচু ফুলের মধু বেশি জমতে দেখা যায়।
  • জমে যাওয়া মধুর রং ঘিয়ের মতো দেখায় এবং অনেকটা ক্রিমের মতো বা দানাদার হয়ে যায়৷ জিভে নিলে এটি গলে যাবে এবং খেতে গ্লুকোজের মতো লাগবে৷
  • সুন্দরবনের মধু সবসময় পাতলা এবং ফ্যানাযুক্ত হবে। পাত্রে আটকে রাখলে পাত্রের মধ্যে গ্যাস তৈরি হবে। আপনাকে কোনও বিক্রেতা যদি সুন্দরবনের নন-প্রসেসড ঘন মধু দেন, মধু ঝাঁকা দিলে যদি ফ্যানা না হয় সেটি অবশ্যই ভেজাল মধু।
  • সরিষা ফুলের মধুতে সরিষা ফুলের একটা ঘ্রাণ পাওয়া যাবে এবং লিচু ফুলের মধুতে লিচুর মতো স্বাদ এবং ঘ্রাণ পাওয়া যাবে৷
  • কালোজিরা ফুলের মধুর রং কালচে বর্ণের হয় এবং এর স্বাদ অনেকটা গুড়ের মতো৷ এর ব্যতিক্রম হলে সেটি অবশ্যই ভেজাল।
  • সরিষা, লিচু বা ধনিয়া ফুলের মধু বলে কেনা মধু যদি কখনও না জমে তবে তা আসল মধু নয়৷

প্রাকৃতিক খাঁটি মধু যে কোনও পাত্রে কিছুদিন রেখে দিলে মধুর পরাগরেণুর হালকা আবরণ পড়বে৷ এই পরাগরেণু বা পোলেন হল উন্নতমানের প্রোটিনের উৎস এবং এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভাল৷ স্থানীয় ভাষায় মধুতে পরাগরেণুর এই আবরণকে মধুর গাছও বলা হয়। সুতরাং, যে মধুতে পরাগরেণু বা গাদ জমবে সেটি খারাপ মধু নয় বরং সেটিই আসল প্রাকৃতিক মধু৷

আরও পড়ুন- চৈতন্যর প্রিয় মিষ্টি, আজও রসকদম্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলার এই জেলা

কিন্তু মধু খাঁটি কিনা তা নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণাও আছে।

মধু সম্পর্কে বিভিন্ন ভুল মতবাদ

  • খাঁটি মধু জমে না- খাঁটি মধু জমে যাবে এটি একটি স্বাভাবিক এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার৷ মধুর অন্যতম উপাদান হল গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ৷ যে মধুতে গুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে সেটি অল্পদিনেই জমে যায়৷ মধু জমে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে মধুর স্ফটিকায়ন বলা হয়। তবে সব মধুই যে জমে যাবে তাও নয়। যে মধুতে ফ্রুক্টোজের পরিমাণ বেশি এবং গ্লুকোজের পরিমাণ কম সেটি জমবে না৷ কম ঘনত্বের মধুও জমতে কম দেখা যায়৷ যেমন, সুন্দরবনের মধু কখনই জমে না।
  • খাঁটি মধুতে পিঁপড়ে ধরে না- আমরা হয়তো সকলেই দেখেছি যে বাড়িতে গ্লুকোজ কিনে রাখলে সেই পাত্রে পিঁপড়ে ওঠে। আর যেহেতু মধুর অন্যতম উপাদনই গ্লুকোজ সুতরাং মধুতে যে পিঁপড়ে ধরবে এটি খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার৷ তাই এই পরীক্ষা ভিত্তিহীন৷
  • শুধুমাত্র খাঁটি মধু দিয়েই আগুন জ্বালানো যায়- আগুন জ্বলতে সাহায্য করে মূলত মোম। যেহেতু মৌমাছির মৌচাক মোমের তৈরি তাই মধুতে সামান্য পরিমাণ প্রাকৃতিক মোমের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এজন্য কোনও কাপড়ে মধু লাগিয়ে তাতে আগুন ধরালে তা জ্বলতে থাকে৷ কিন্তু ভেজাল মধু দিয়ে যে এরকম আগুন জ্বালানো যাবেনা তা নয়৷ আপনি যদি চিনির শিরাতেও মোম মিশিয়ে এভাবে কাপড়ে লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন, দেখবেন জ্বলছে৷
  • খাঁটি মধুর রং শুধুমাত্র গাঢ় লাল বা খয়েরি হয়- মধুর রং নির্ভর করে ফুলের নেকটারের উপর৷ প্রকৃতিতে এক এক সময় এক এক ফুলের আধিক্য থাকে৷ সংগত কারণে বিভিন্ন সময়ে মধুর রংও বিভিন্ন হয়৷ যেমন, সরিষা ফুলের সময় মধুর রং প্রায় হলুদ বর্ণ। আবার বর্ষাকালে মধুর রং হয় সাধারণত লালচে বর্ণের।

এমন অসংখ্য পদ্ধতি আছে খাঁটি মধু চেনার। কথায় আছে, ৪০ বছরেও মধু নষ্ট হয় না। সত্যিই তাই, প্রাকৃতিক মধু কখনই নষ্ট হবে না যদি একটু সর্তক থাকা যায়। প্রাকৃতিক মধু নষ্ট হয় শুধু জলে, তাই এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, যেন মধুতে জল না লাগে। মধু রেফ্রিজারেটরে বা গরম স্থানে রাখা যাবে না। মধুর বোতলের মুখ খোলা রাখা যাবে না। বলে রাখা ভালো, মধু অনেকদিন পর প্রাকৃতিকভাবে নিজেই তার ঘ্রাণ ও স্বাদ বদল করে। সেই সঙ্গে বদল করে রঙ ও ঘনত্বও। এই বদল মধুকে আরও বেশি সুস্বাদু করে তোলে। তবে মাথায় রাখবেন,

১) মধুতে কখনও কটু গন্ধ থাকবে না। খাঁটি মধুর গন্ধ হবে মিষ্টি ও আকর্ষণীয়।

২) মধুর স্বাদ হবে মিষ্টি, এতে কোনও ঝাঁঝালো ভাব থাকবে না।

৩) শীতের দিনে বা ঠান্ডায় খাঁটি মধু দানা বেঁধে যায়।

More Articles