ইন্ডিগোর ১০০০ ফ্লাইট বাতিল! ভোগান্তির দাম কি শুধুই কেতাদুরস্ত ‘সরি’?
IndiGo Flight Cancellations: কেউ ফোনে ঝগড়া করছেন, কেউ কাঁদছেন, কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে আবার জানতে পারছেন তাঁদের ফ্লাইটও বাতিল। ভিড় এতটাই যে অনেকেই খাবার, জলের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ চলছিল নিয়মমাফিক। টিকিট কাটা, ব্যাগ গোছানো, দেরি না করে বিমানবন্দরে পৌঁছে যাওয়া— যাত্রীদের প্রতিদিনের ব্যস্ততার মতোই। কিন্ত হঠাৎই সব কিছু বদলে গেল। একের পর এক ফ্লাইট বাতিল, বোর্ডিং গেটে আটকে থাকা মানুষ, কাঁদতে থাকা বাচ্চা, রাতভর অপেক্ষায় ক্লান্ত একের পর এক পরিবার সব মিলিয়ে দেশের বড় বড় বিমানবন্দর গুলিতে নেমে এল বিশৃঙ্খলার ঝড়। এখন প্রশ্ন একটাই, এই ভোগান্তির দাম কি শুধুই একটি শুকনো, কেতাদুরস্ত ‘সরি’?
এই বিপর্যয়ের কেন্দ্রে ছিল ইন্ডিগো। দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট এয়ারলাইন, প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ সফর করেন এই এয়ার লাইনে। অথচ ডিসেম্বরের শুরুতেই দেখা গেল, নতুন পাইলট ডিউটি ও বিশ্রামের সময়ের নিয়ম মানিয়ে নিতে গিয়ে তাদের গোটা রোস্টারিং ব্যবস্থাই যেন অচল হয়ে পড়ল। সপ্তাহে পাইলটদের বাড়তি বিশ্রাম, রাতের ফ্লাইটে সীমাবদ্ধতা সব ঠিকই ছিল। নিরাপত্তার স্বার্থেই নতুন নিয়ম আনা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এই নিয়ম চালুর আগে প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্ডিগোর ঘাটতি ছিল ভয়াবহ।
পাইলট-ক্রু নিয়োগ, শিডিউল ম্যানেজমেন্ট সব জায়গায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। রাতের ফ্লাইটের চাপ সামলাতে না পারায় দেশের বড় বড় বিমানবন্দরগুলিতে পরপর বাতিল হতে থাকে ফ্লাইট। ৬ ডিসেম্বর সকালে দিল্লিতে ১০৬টি আর মুম্বাইয়ে ১০৯টি IndiGo ফ্লাইট বাতিল হয়। বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, চেন্নাইও বাদ গেল না। একদিনে হাজারেরও বেশি ফ্লাইট বাতিল হওয়া নজিরবিহীন। আর তাতেই ভোগান্তি হলো যাত্রীদের। কেউ বিয়েতে যাচ্ছিলেন— জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিন মিস করেছেন। কেউ বিদেশমুখী কর্মক্ষেত্রের দরকারে দিল্লি থেকে মুম্বাই, বা বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতা ফ্লাইট ধরতে চেয়েছিলেন, ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় চাকরি-সংক্রান্ত মিটিং-এও যাওয়া সম্ভব হয়নি। অনেকেই আবার চিকিৎসার জন্য যাচ্ছিলেন, কোনো সাহায্য না পেয়ে বিমানবন্দরের মেঝেতে বসে রাত কাটিয়েছেন রোগীরাও। শিশুদের স্কুলের পরীক্ষা, বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর ভিসার সময়, সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার নোটিসে বাতিল হওয়া ফ্লাইটের জন্য।
আরও পড়ুন
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন! পথ দেখাচ্ছেন ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী ড্রোন পাইলট
দিল্লি ও মুম্বাইয়ের বিমানবন্দরে তখন টার্মিনাল জুড়ে হাহাকার। কেউ ফোনে ঝগড়া করছেন, কেউ কাঁদছেন, কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে আবার জানতে পারছেন তাঁদের ফ্লাইটও বাতিল। ভিড় এতটাই যে অনেকেই খাবার, জলের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। ততক্ষণে টিকিটের দাম বেড়ে আকাশ ছোঁয়া হয়ে গিয়েছে। কারণ অন্য এয়ারলাইনগুলিতে যাত্রীদের হুড়োহুড়ি। অথচ ইন্ডিগোর কাছ থেকে আশ্বাসের বদলে বারবার পাওয়া গিয়েছে রোবটিক ভয়েস, মেসেজ বা অ্যাপ নোটিফিকেশন।
এই বিশৃঙ্খলা দেখে কেন্দ্রীয় বিমান মন্ত্রক ও DGCA তড়িঘড়ি হস্তক্ষেপ করে। DGCA এককালীন বিশেষ ছাড় দেয়, রাতের ফ্লাইটে সীমাবদ্ধতা সাময়িকভাবে তুলে নেওয়া হয়, পাইলটদের সাপ্তাহিক ছুটিকে সাপ্তাহিক বিশ্রাম হিসেবে গণ্য করার সুযোগ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ যেন দেশব্যাপী বিমান চলাচল রক্ষার জরুরি অস্ত্র। কিন্তু এই ছাড় ইন্ডিগোর জন্য বিশেষভাবে দেওয়া হলেও অন্য এয়ারলাইনগুলিকে তা দেওয়া হয়নি, যদিও এই নিয়ে পাইলট ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনগুলি তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, এই নিয়ম চালু করা হয়েছিল পাইলটদের ক্লান্তি কাটাতে এবং নিরাপত্তা বাড়াতে। এখন নিরাপত্তা কমিয়ে, যাত্রী-ভোগান্তি কমাতে গেলে তার মূল্য কি ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে না? উঠছে সেই প্রশ্নও।
সরকার অবশ্য বলেছে, এটি একমাত্র যাত্রী স্বার্থের কথা ভেবেই করা হয়েছে। বৃদ্ধ, রোগী, বাচ্চা—যাদের জরুরি ভ্রমণের প্রয়োজন তাদের সাহায্য করতেই এই সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি গঠিত হয়েছে উচ্চ-স্তরের তদন্ত কমিটি। কেন IndiGo আগে থেকে পরিকল্পনা করেনি? কোথায় গাফেলতি? রোস্টারিং-এ কোন ভুল? ক্রু কম ছিল, নাকি ম্যানেজমেন্টের অবহেলা? সব খতিয়ে দেখা হবে।
আরও পড়ুন
মানুষ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় বিমান? নেপথ্যে যে কাহিনি ‘ডানকি ফ্লাইটে’র
ইন্ডিগো অভিযোগ অস্বীকার করলেও, তারা একটি বিষয় স্বীকার করেছে, এই ফ্লাইট বাতিল ছিল তাদের 'রিবুট প্ল্যান'-এর অংশ। তারা বলছে, নতুন নিয়মে রোস্টার বানাতে সময় লাগবে, তাই ফ্লাইট সংখ্যা সাময়িক কমানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, এই পরিকল্পনার কথা আগে যাত্রীদের জানানো হয়নি কেন? কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয়কারী একটি এয়ারলাইন্স কি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে?
জরুরি সময়ে যাত্রীদের জন্য নির্দেশ এসেছে—রিফান্ড দ্রুত মিলবে, রি-শিডিউলিং চার্জ নেই। কিন্তু টিকিটের টাকা ফেরত পেলেও কি যাত্রীদের ভোগান্তির মূল্য ফেরত পাওয়া সম্ভব? যারা অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে ফ্লাইট পেলেন না, যারা বাচ্চাকে নিয়ে রাতভর এয়ারপোর্টে কাটিয়েছেন, যারা সব পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন— তাঁদের কাছে কি সত্যিই একটি 'সরি' যথেষ্ট? তারা টিকিট কেনেন, ভরসা কেনেন— তার প্রতিদান শুধুই কয়েক লাইনের ক্ষমা প্রার্থনা হতে পারে না।
এই ঘটনার পর ভারতীয় বিমান পরিবহন ব্যবস্থার উপর নতুন করে আস্থা-সঙ্কট তৈরি হয়েছে। DGCA–র সিদ্ধান্ত, সরকারের হস্তক্ষেপ, ইন্ডিগোর ম্যানেজমেন্ট— সবার ভূমিকা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। আকাশপথের নিরাপত্তা, যাত্রী সুরক্ষা এবং পরিকল্পনার গুণগত মান নিয়ে এখন আরও বড় প্রশ্ন উঠেছে।

Whatsapp
