বোমায় বিধ্বস্ত পা, নিজেই ছুরি দিয়ে কেটে বাদ দিলেন এই ভারতীয় সেনানায়ক

Ian Cardozo Indian army: ৮৫ বছর বয়সে আসার পরও সেই সাহস এতটুকুও কমেনি! মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজো আজও অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা

মাথায় কমে আসা সাদা চুল, মুখে সাদা চাপদাড়ি। বয়সের ভারে চামড়াও কুঁচকেছে খানিকটা। কিন্তু এসবের আড়ালে শক্ত, কঠিন চেহারাটা একই থেকে গিয়েছে। ৮৫ বছর বয়সী মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজোকে এখনও বৃদ্ধের খাতায় ফেলা যায় না। সম্প্রতি তাঁর নতুন বই ‘কার্তুস সাব’ (Cartoos Saab: A Soldier’s story of Resilience in Adversity) বইটি উদ্বোধনের সময়ও তাঁর চোখের দৃষ্টি একেবারে তাজা। আর পা? মেজর কার্ডোজোর পা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটা আলাদা জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভারত-পাক যুদ্ধে তাঁর একটি পা একেবারে বাদ যায়। সেটাই এক রোমহর্ষক কাহিনি। আরও ভালো করে বললে, সাহস, কর্তব্যবোধ আর হার না মানা এক সেনা নায়কের কাহিনি। ভারতের প্রথম ওয়ার ডিজেবেলড সেনা অফিসার, যিনি ব্যাটেলিয়ন ও ব্রিগেড সামলেছেন। বলিউডও ইয়ান কার্ডোজোকে নিয়ে একটি সিনেমার পরিকল্পনা করেছে। ২০২৩-এ মুক্তি পাবে সেই 'গোর্খা' সিনেমাটি। তাতে মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজোর ভূমিকায় থাকবেন স্বয়ং অক্ষয় কুমার। 

গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ৭ আগস্ট থেকে। মুম্বইয়ের (তৎকালীন বম্বে শহর) মতো এক স্বপ্ননগরীতে ভিনসেন্ট এবং ডায়ানা কার্ডোজোর কোলে জন্ম নেন ইয়ান কার্ডোজো। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজের প্রাক্তনী ইয়ানের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছিল গোড়া থেকেই। সেই লক্ষ্যেই ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে (এনডিএ) যাওয়া, তারপর ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়া। সেখান থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু ফিফথ রেজিমেন্ট গোর্খা রাইফেলসে। পরবর্তীকালে এই রেজিমেন্টেরই চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার হন ইয়ান কার্ডোজো। এই ব্যাটেলিয়নই ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ – দু’টি ভারত-পাঁক যুদ্ধের সাক্ষী। আর এই দুই যুদ্ধেই গোর্খা বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার পদে ছিলেন মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজো।

আরও পড়ুন : পুলওয়ামা বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড? ইমরানের কাঁটা নয়া পাক সেনাপ্রধানের আসল পরিচয় জানুন

১৯৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধ অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী। বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার, রাজাকারদের তাণ্ডব, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, সমস্ত বিশ্বের নজর ছিল এদিকেই। অ্যালেন গিনসবার্গ যশোর রোডের ছবি তুলে ধরলেন কবিতায়। সেই সময়ই মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১৯৬৫-র পর ফের শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান সম্মুখ সমর। সেই যুদ্ধে নিজের ফৌজর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন ইয়ান কার্ডোজোও। সিলেটের যুদ্ধেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এই বাহিনীতে থাকাকালীনই তাঁর নতুন নাম হয় ‘কার্তুস সাব’। গোর্খা সৈন্যরা ইয়ান কার্ডোজোর নাম মনে রাখতে পারতেন না, উচ্চারণও করতেও অসুবিধা হতো। তাই এমন নাম।

যাই হোক, এবার আসল ঘটনায় আসা যাক। শুরুর দিকে ইয়ান কার্ডোজো এই যুদ্ধের অংশ ছিলেন না। যুদ্ধ চলাকালীন তাঁর সেনাবাহিনীর এক অফিসার শহিদ হয়ে যান। তখন তাঁর জায়গায় কার্ডোজোকে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সময়ই তিনি ভারতীয় সেনার প্রথম হেলিকপ্টার মিশনের অংশীদারও হন। বাংলাদেশের মাটিতে নেমে হাতে বন্দুক তুলে নেন তিনি। খাবারের অভাব, গুলি-বারুদও কমে আসছে। তবুও লড়াইয়ের ময়দান ও নেতৃত্ব প্রদানের জায়গা থেকে একচুলও সরেননি ইয়ান কার্ডোজো। এদিকে ১৯৭১ সালের সেই ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বরের দিন চলে এল। ঢাকায় পতন হল পশ্চিম পাকিস্তানের। তার দু’দিন পর হঠাৎই ইয়ান কার্ডোজোর কাছে একটা খবর এল। স্থানীয় বেশকিছু মানুষের সঙ্গে বিএসএফের কয়েকজন জওয়ানও বন্দি হয়ে আছে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশনে উদ্যত হলেন কার্ডোজো সাহেব। কিন্তু প্রথমে তাঁর রেজিমেন্টেরই অফিসাররা একটু দোনোমোনো করতে থাকেন। যুদ্ধ তো শেষ হয়ে গিয়েছে, তার ওপর ওটা বিএসএফের ব্যাপার। গোর্খা রাইফেলসের কি যাওয়া উচিত? কে জানে, বিপদও ঘনিয়ে আসতে পারে শেষ মুহূর্তে। কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল ছিলেন ইয়ান কার্ডোজো। শেষমেশ তিনি রওনা দিলেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

পরে নিজের বইয়ে কার্ডোজো সাহেব বলছেন, “হয়তো না গেলেই ভালো হতো।” সেই সময়ের বাংলাদেশের মাঠে ঘাটে মাইন ছড়িয়ে রেখেছে পাকিস্তানি সেনারা। সেই মাইনের হদিশ ইয়ান কার্ডোজোর কাছে ছিল না। যাওয়ার পথে অজান্তেই পাকিস্তানের একটি পি২ মাইনে তাঁর পা গিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে ফেটে উঠল মাইনটি। সমস্ত দিকে ধোঁয়ায় ভরে গেল। মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজোও ছিটকে গিয়ে পড়লেন একদিকে। গোটা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। চোখের সামনে সমস্তটাই ঝাপসা, কে দাঁড়িয়ে আছে, কোথায় তিনি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ইয়ান কার্ডোজো কেবল দেখলেন, তাঁর একটি পা-কে আর পা বলে চেনা যাচ্ছে না। মাংস আর হাড়ের একটা পিণ্ড হয়ে কোমরের সঙ্গে লেগে আছে মাত্র। রক্ত আর ধোঁয়ায় ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা। সেই সময়ই স্থানীয় এক ব্যক্তি রক্তাক্ত, গুরুতর আহত ইয়ান কার্ডোজোকে দেখতে পান। আরও কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে তাঁকে গাড়িতে তোলা হল। এঁরা কে? কোথায় যাচ্ছেন তিনি? গাড়িটা কার? মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজোর কিছুই মনে নেই তখন…

কোনওরকমে তাঁকে ব্যাটেলিয়নের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হল। তাড়াতাড়ি সেনা হাসপাতালে খবর দেওয়াহল, সঙ্গে রেডিও মারফৎ হেলিকপ্টারের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছিল। যন্ত্রণার মধ্যেও কার্ডোজো দেখলেন, রক্তের স্রোত থামতেই চাইছে না। পা বলে যে বস্তুটি তখনও লেগে রয়েছে শরীরে, সেটি আরও বিপদ ডেকে আনবে। আচ্ছা, যন্ত্রণা কমানোর জন্য একটু মরফিন পাওয়া যাবে? প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল, পাকিস্তানি সেনাদের শেল হামলায় সমস্ত ওষুধপত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিচ্ছু নেই আর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইয়ান কার্ডোজো। যন্ত্রণা সহ্য করেই এই পা কেটে বাদ দিতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, সার্জিক্যাল ছুরি জাতীয় কিছুই নেই ওখানে। থাকার মতো আছে কেবল খুকরি, গোর্খাদের চাকু। শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত পা, সেখানে লেগে আছে ঘাস, কাদা, মাটি আর বোমার টুকরো। যদি ইনফেকশন হয়ে যায়, তাহলে তো আরও বিপদ!

আরও পড়ুন : সংস্কৃত শিখে গঙ্গার পুজো করেছিলেন বাংলায় প্রথম মসজিদের নির্মাতা এই তুর্কি সেনাপতি!

চটপট কিছু একটা ভাবলেন ইয়ান কার্ডোজো। পাশেই ছিলেন তাঁর সঙ্গী বলবাহাদুর। এই অবস্থা দেখে তিনিও রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে কার্ডোজো খুকরি চাইলেন। বের করার পর বলবাহাদুরকে বললেন, “পা-টা কেটে বাদ দিয়ে দাও। দেরি করো না।” বল্বাহাদুর কিছুতেই রাজি নয়। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করাটা ঠিক হবে না। বরং ডাক্তার আসুক আগে। এক মুহূর্তও দেরি করলেন না ইয়ান কার্ডোজো। বলবাহাদুরের হাত থেকে খুকরিটা নিলেন, তারপর নিজেই জখম পা-টি কেটে বাদ দিয়ে দিলেন। বলবাহাদুরকে বললেন কাটা পা-টি মাটিতে পুঁতে দিতে। খানিক পরে ডাক্তার ঢুকে একেবারে অবাক! “এটা কী করলেন, স্যার?” ততক্ষণে ইয়ান কার্ডোজোর নির্দেশ এসে গিয়েছে, “দ্রুত ব্যান্ডেজ বাঁধো”।

শেষমেশ তিনি দেশে ফিরলেন। তাঁর বীরত্ব, সাহসিকতার জন্য একাধিক পুরস্কারও অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৫ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গিয়ানি জাইল সিংয়ের থেকে অতি বিশ্বস্ত সেবা মেডেল পান। পাশাপাশি পান সেনা মেডেলও। এত বছর পরও, ৮৫ বছর বয়সে আসার পরও সেই সাহস এতটুকুও কমেনি। ভারতের ম্যারাথনে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী মেজর জেনারেল ইয়ান কার্ডোজো আজও অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা।

More Articles