চাহিদা প্রচুর, নেই জোগান, এবারের শীতে গুড়ের স্বাদে তবে বঞ্চিত বাঙালি?

Nolen Gur: যে গাছ থেকে প্রায় ২০০ লিটারের কাছাকাছি খেজুরের রস পাওয়া যায় তা থেকে মাত্র ১৫ লিটার খেজুরের রস পাওয়া গেছে

বাঙালি বারো মাসের তেরো পার্বণ প্রায় শেষের মুখে দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা এবার শুধুই পৌষ পার্বণের। বছরের শেষ উৎসব। আর উৎসব মানেই মন খুলে পেটপুজো। তবে এই সময় বাঙালির চোখ টক-ঝালে নয়, বরং সুস্বাদু, সুগন্ধি মিষ্টিতে। এই সময় পায়েস থেকে শুরু করে পিঠেপুলিতে ভরপুর রান্নাঘর নলেন গুড় ছাড়া যেন একেবারেই নিষ্প্রাণ।

মূলত খেজুরের রস থেকেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় এই নলেন গুড়। তবে বাবা-মায়েদের আমলের গুড়ের স্বাদ আজ আর নেই। খেজুরের রস থেকে এই গুড় যারা তৈরি করেন তাঁদের শিউলি বলা হয়। প্রতিবছর দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা মেদিনীপুর জেলা থেকে শিউলিরা পরিবার নিয়ে চলে আসেন হাওড়া এবং আশেপাশের এলাকায়। এখানে থেকেই গুড় তৈরি করে বিক্রি করেন সারা মাস ধরে। প্রতিবছরের মতো এই বছরও নির্দিষ্ট সময় তাঁরা জেলাগুলিতে এসে হাজির হলেও, সবারই প্রায় মাথায় হাত। শীতের হাওয়া বইতে না বইতেই গুড়ের চাহিদা শুরু হলেও গুড়ের জোগান হয়নি পর্যাপ্ত মাত্রায়। অসময়ে গাছ কেটেছেন বলে মেলেনি পর্যাপ্ত পরিমাণে খেজুরের রস। যে গাছ থেকে প্রায় ২০০ লিটারের কাছাকাছি খেজুরের রস পাওয়া যায় তা থেকে মাত্র ১৫ লিটার খেজুরের রস পাওয়া গেছে। যদিও শিউলিরা আশা করছেন ঠিকঠাকভাবে শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা পর্যাপ্ত গুড়ের জোগান দিতে পারবেন।

কীভাবে তৈরি হয় নলেন গুড়?

খেজুরের রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে নলেন গুড় তৈরির প্রক্রিয়া চলে প্রায় আড়াই মাস ধরে। এই সময় খেজুর গাছের মাথা ধরালো অস্ত্রের মাধ্যমে কেটে একটি নল পুঁতে দেওয়া হয় আর তার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় একটি মাটির হাঁড়ি। সারারাত ধরে সেখান থেকে সেই মাটির হাঁড়িতে এসে জমা হয় খেজুরের রস। এরপরে এটিকে পরিষ্কার ছাঁকনির মাধ্যমে ছেঁকে উনুনের ওপর রেখে শুরু হয় জ্বাল দেওয়ার কাজ। আস্তে আস্তে এটি ঘন হয়ে এলে সেখান থেকে তৈরি হয় নলেন গুড়। শীতের মরশুমে এই নলেন গুড়ের চাহিদা প্রচুর পরিমাণে থাকলেও এই বছর উত্তরের হাওয়া কম থাকায় খেজুরের রসের ফলন অনেক কম হয়েছে। এছাড়াও উনুনে খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার সময় প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণে খড়ের। এই খড়ের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা নানাভাবে গুড় তৈরি নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন।

আরও পড়ুন- শীতের আমেজ আর খেজুর গুড়ের যুগলবন্দি খাদ্য-বেরসিকের মনেও পুলক ধরায়

গুড়ের পুষ্টিগুণ কী কী?

গুড়ে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ থাকে যা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী। এছাড়াও আরও নানারকম উপকারিতা রয়েছে গুড়ের;

এক কাপ তাজা গুড়ে থাকে;

ক্যালোরি – ১০০ গ্রাম

প্রোটিন – ১ গ্রামের কম

ফ্যাট – ১ গ্রামের কম

কার্বোহাইড্রেট – ২৬ গ্রাম

ফাইবার – ১ গ্রামের কম

সুগার - ২৪ গ্রাম

এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস থাকে গুড়ে যা মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপযোগী। শরীরে রক্তের ঘাটতি হলেই অ্যানিমিয়া দেখা দেয়। তবে নিয়মিত কিছুটা পরিমাণ গুড় খেলে এই রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। কারণ গুড়ে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে যা শরীরে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। এছাড়াও গুড় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবেও কাজ করে। গুড়ের মোলাসেসে ফেনোলিক নামের এক ধরনের অ্যাসিড থাকে, যা শরীরকে ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে মুক্তি দেয়। তবে ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরামর্শ নিতে হবে।

আজকাল বাজারে ভেজালের শেষ নেই। যা কিনতে যাবেন তাতেই কোনও না কোনওভাবে ভেজাল মিলবেই। তবে কোনওরকম ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস কিনতে শুধু একটি জিনিসই প্রয়োজন; পরখ করে দেখার ক্ষমতা। যেমন, নলেন গুড় কিনতে গিয়ে সবাই শুধুমাত্র গন্ধ শুঁকেই তা কিনে ফেলেন। অনেকেরই অজানা, আজকাল এই গুড়ের মধ্যে নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে তাকে সুগন্ধি করা হয়। দোকানে গিয়ে গুড় কেনার সময় কিছু জিনিস ভালো করে যাচাই করে দেখবেন;

আরও পড়ুন- গুড়ের সন্দেশকে টেক্কা দিল চকলেট সন্দেশ! মিষ্টিমুখেও সাম্রাজ্যবাদ

১. নলেন গুড়ের পাটালি খুব নরম হয়। যদি কখনও দোকান থেকে শক্ত পাটালি দেয় তবে বুঝবেন তা নলেন গুড় নয়।

২. কেনার সময় একটু ছোট টুকরো মুখে দিয়ে দেখবেন যে তাতে নোনতা স্বাদ আছে কিনা। কারণ যদি নোনতা স্বাদ থাকে তার মানে গুড়ে ফিটকিরি মেশানো রয়েছে।

৩. নলেন গুড়ের রং সাধারণত গাঢ় বাদামী রঙের হয়। গুড়ের সঙ্গে চিনি মেশানো থাকলে এই বাদামী রং অনেকটাই ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

গুড় দিয়ে তৈরি একটি সুস্বাদু মিষ্টি মনোহরা। শ্রীরামপুরের পাশেই রিষড়ার ফেলু মোদকের এই মনোহরা মিষ্টিপ্রেমীদের মন ফুরফুরে করে দিত এককালে। তবে দোকান নয়, বাড়িতেও বানিয়ে নেওয়া যায় এই মনোহরা।

কীভাবে বাড়িতেই বানাবেন মনোহরা?

প্রথমে ভালো করে ফ্রাইং প্যানে ছানা এবং চিনিকে একসঙ্গে পাক দিয়ে নিতে হবে। এরপর যখন আস্তে আস্তে ছানার জল ছাড়তে শুরু করবে তখন মিশিয়ে দিতে হবে নলেন গুড়। এবার এই নলেন গুড় আর ছানাকে একসঙ্গে ভালো করে পাক দিতে হবে। মিনিট পাঁচেক পর একটি পরিষ্কার পাত্রে নামিয়ে রেখে ঠান্ডা করতে হবে এই সন্দেশ। ঠান্ডা হয়ে গেলেই এটিকে গোল করে মনোহরার আকার দিয়ে পাটালি গুড়ের সঙ্গে পরিবেশন করতে হবে।

 

More Articles