শীতের আমেজ আর খেজুর গুড়ের যুগলবন্দি খাদ্য-বেরসিকের মনেও পুলক ধরায়
Nalen Gur: শীতকাল মানেই যেন সব ভুলে ডুব দেওয়া নলেন গুড়ের স্বর্গীয় স্বাদে।
শিমুল তুলো ধুন্তে ভাল,
ঠাণ্ডা জলে নাইতে ভাল,
কিন্তু সবার চাইতে ভাল
পাউরুটি আর ঝোলা গুড়।
শীত এখনও মারণ কামড় বসায়নি ঠিকই, তবে তার আগমন একটু একটু করে মালুম হচ্ছে। ঘরে ঘরে এসি, কুলার বন্ধ হয়েছে, ছুটি নিয়েছে সিলিং ফ্যানও। বদলে কোনও কোনও বাড়িতে চালু হয়েছে গিজার। বেশ শীত শীত আমেজ। আর ঠিক এই মুহূর্তে বাঙালি মাত্রই মনের কোণায় উঁকি দেয় ঝোলা গুড়। সঙ্গে পাউরুটি। বাঙালি যে কেন সারা বছর শীতের জন্য কেন এত মুখিয়ে থাকে, তা বুঝতে আর সময় লাগে না। এক ফোঁটা জিভের জল সম্বরণ করতে না করতেই সন্ধান মেলে এর আসল কারণ খেজুর গুড় বা পাটালি গুড়। এই গুড়ের তৈরি পিঠা-পুলি-পায়েস গ্রাম বাংলার শত শত বছরের ঐতিহ্য। মায়ের হাতে তৈরি পিঠে-পায়েসের স্বর্গীয় স্বাদ এক মুহূর্তে যে কোনও খাদ্য বেরসিককেও আমোদিত করতে পারে নিশ্চিত। সোনালি রঙের পাতলা গুড় অথবা খেজুর রস দিয়ে তৈরি একখণ্ড মিষ্টিদ্রব্য, এর স্বাদ যে নেয়নি, সেই হতভাগ্যের কথা না বলাই ভালো।
শরীরে প্যাঁচানো দড়ি। কোমরে বাঁশের ঝুড়ি, ভেতরে বাটাল-হাঁসুয়া। তারই একপাশে ঝুলছে মাটির হাঁড়ি। তরতর করে বেয়ে গাছি উঠছেন খেজুরগাছে। গাছের ছাল-বাকল তুলে বেঁধে দিচ্ছেন হাঁড়ি। এখন সময় বদলালেও এ দেশে একসময় গ্রামে গ্রামে গাছিদের খেজুরগাছ থেকে রস নামানো এবং গুড় তৈরি ছিল খুবই পরিচিত দৃশ্য। জানা যায় এই রসের একটি অংশ গাছি নিতেন, অন্য অংশটি পেতেন গাছের মালিক। বাকি কিছু কিছু বিক্রিও হতো।
বাজারে ‘নলেন গুড়’ বলতে যা দেখি তা আসলে খেজুর গুড় বা খেজুরের রস। জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে অর্থাৎ ইংরেজি বছরের শুরুতে এই গুড় পাওয়া যায় বলে একে অনেকে ‘পয়লা গুড়’ও বলেন। তবে ‘নলেন’ শব্দটি কোথা থেকে এসেছে এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বেশিরভাগ মানুষই বলেন নতুন গুড়ের ‘নতুন’ শব্দটিই অপভ্রংশ হয়ে করে জন্ম হয়েছে নলেন শব্দটির। আবার খেজুর গাছের গায়ে নলি কেটে এই গুড় সংগ্রহ করা হয় বলে একে নলেন গুড় বলা হয় বলেও দাবি করেছেন কেউ কেউ। এর সপক্ষে দক্ষিণ ভারতে ‘নরকু’ বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে। যার আক্ষরিক অর্থ হল কাটা বা ছেদন করা। শোনা যায়, আমাদের রাজ্যে এক সময় নলেন গুড়ের বড় হাট বসত। নলেন গুড় থেকে তৈরি হত লালচে বাদামি রঙের চিনি। তাই একে লালি গুড়ও বলা হত। এখন আর সেসব কিছু হয় না। যদিও সময়ের সঙ্গে নলেন গুড়ের মহিমায় এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। আজকাল টিউবেও পাওয়া যায় এই গুড়।
আরও পড়ুন : নলেনের স্বাদ নোনতা! শেষ পাতে গুড়ের বদলে কেমিক্যাল খাবে বাঙালি?
সাধারণত বিকেলের পর বিভিন্ন খেজুর গাছের গা চেঁচে ফেলে ফুটো করে রাখা হয়৷ তারপর ফাঁকা হাঁড়িগুলো ঝুলিয়ে দিয়ে আসা হয়। সারারাত ধরে টুপ টুপ করে রস পড়ে হাঁড়িতে৷ তারপর দিন সকালে নিয়ে আসা হয় রস ভর্তি হাঁড়িগুলো। একটা বড় পাত্রে সেই রস ঢেলে ভালো করে ফোটানো হয়। ফুটিয়ে ফুটিয়ে সেই রস থেকে প্রস্তুত করা হয় কাঙ্ক্ষিত গুড়৷ তারপর সেই গরম গুড় ঠান্ডা হয়ে এলে তাকে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে তৈরি করে ফেলা হয় পাটালি গুড়। নলেন গুড়ের দু’টি রকমফের৷ ঝোলা তরল জাতীয় এবং শক্ত পাটালি। সে যে কী স্বাদ, তা একমাত্র বাঙালিরাই জানেন। বছরের এই সময়টা বাদ দিলেও সারা বছর আরও কয়েক রকম গুড়ের চল আছে বাংলায়। যেমন- আখের গুড়, ভেলি গুড়, চিটে গুড়, হাজারি গুড়।
বাংলার প্রায় সর্বত্র আখের চাষ হয় এবং মূলত চিনি তৈরিতেই আখের রস ব্যবহৃত হয়। তবে, চিনিকলসমূহ তৈরি হওয়ার আগে আখের রস থেকে তৈরি গুড়ই দেশে চিনির প্রধান বিকল্প হিসেবে চালু ছিল। এখনও আখের রস থেকে গুড় তৈরি হয় এবং নানা কাজে তার ব্যবহার। আখ কাটার পর তার কান্ড পরিষ্কার করে টুকরো টুকরো খন্ডে মাড়াই কলের ভেতর দিয়ে পেষণের মাধ্যমে রস বের করা হয়। পূর্বে আখমাড়াই কল সাধারণত গরু দিয়ে চালিত হতো। বর্তমানে এসেছে যন্ত্রচালিত আখমাড়াই কল। রস সংগ্রহের পর তা ছেঁকে পরিষ্কার করে বয়লারে জ্বাল দিয়ে ময়লা গাদ ফেলে দিতে হয়। এভাবে জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস লালচে বর্ণ ধারণ করে এবং ঘন হয়ে গুড়ে পরিণত হয়। এভাবেই তৈরি হয় আখের গুড়। গুড় চিনির থেকে কম মিষ্টি হলেও বেশি পুষ্টিকর। চিনির জন্য দুইবার ফোটালে ঘন কালচে একটু তিতকুটে ভেলি গুড় পড়ে থাকে। আরো বেশি বার চিনি বের করে নিলে থাকে চিটে গুড়, যার মধ্য প্রচুর ভিটামিন থাকলেও তেতো বলে সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়। তাল পাটালিও শীতকালের আর পাঁচটা খাবারের মতোই জিভে জল আনা উপাদান।
এখানেই শেষ নয় গুড় বৃত্তান্ত। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে ‘হাজারি গুড়’-এর নাম। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকার কয়েকটি গাছি পরিবার এই গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জানা যায়, এক সময় হাজারি গুড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত। গুড়ের নাম কেন হাজারি এ ব্যাপারে দু’টি গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি, দৈবশক্তিসম্পন্ন কোনও এক দরবেশ ও অন্যটি রানি এলিজাবেথকে ঘিরে।
কয়েকশো বছর আগে ঝিটকা অঞ্চলে মোহাম্মদ হাজারি নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। হঠাৎ একদিন বিকালে খেজুর গাছে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ তাঁর কাছে রস খেতে চান। তখন ওই গাছি দরবেশকে বলেছিলেন, ‘সবে মাত্র গাছ হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এতো অল্প সময়ে বড় জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে। তবুও দরবেশ তাঁকে গাছে উঠে হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ানোর অনুরোধ জানান। দরবেশের রস খাওয়ার অনুরোধে গাছি আবার খেজুর গাছে ওঠেন। এরপর বিস্মিত হয়ে দেখতে পান, সারারাত ধরে যতো রস পড়তো সেই পরিমাণ রসে হাঁড়ি ভরে গেছে। গাছি হাঁড়ি ভরপুর রস নিয়ে নিচে নেমে ওই দরবেশকে রস খাওয়ান এবং পা জড়িয়ে ধরেন। গাছিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে দরবেশ বলেন, ‘কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সবাই খাবে এবং তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে’ বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান।
আরও পড়ুন : শীতের আমেজ আর খেজুর গুড়ের যুগলবন্দি খাদ্য-বেরসিকের মনেও পুলক ধরায়
আর অন্য গল্পটি হলো, ব্রিটিশ আমলে রানি এলিজাবেথ ভারতবর্ষ সফরে এসেছিলেন। তাঁর খাবার টেবিলে দেওয়া হয়েছিল এই গুড়। রানি গুড় হাতে নিয়ে একটু চাপ দিতেই হাজার টুকরো হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে এটি হাজারি গুড় নামে পরিচিত। রানি এলিজাবেথ গুড় খেয়ে এতই মজা পেয়েছিলেন যে, তিনি নিজে আগ্রহী হয়ে ‘হাজারি’ নামে একটি সিলমোহর তৈরি করে দিয়ে গেছেন। জনশ্রুতি এটাই। ফলে সত্যি মিথ্যা – যাই হোক, মোদ্দা কথা হল এই গুড়ও স্বাদে লা জবাব! এই গুড়ের উৎস খেজুরের রস। গাছির রস নামানো থেকে শুরু করে গুড় তৈরির মধ্যে রয়েছে আদি অন্তকালের প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও হাজারি গুড় তৈরির এই প্রক্রিয়ার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
গ্রামবাংলায় শীতের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুরের রস। এই রসের নলেন গুড়, খাঁটি দুধের উৎকৃষ্ট ছানা ও ময়রাদের বহু যুগের অভিজ্ঞতা-এই তিনের সমন্বয়ে তৈরি হয় 'নলেন গুড়ের সন্দেশ'। এর মনমাতানো ঘ্রাণে যেমন রসনাতৃপ্তি ঘটে, তার জুড়ি মেলা ভার। তাই শীতের মরসুম এলে বাঙালির হাতে ও পাতে এই নলেন গুড়ের তৈরি সন্দেশে চাইই চাই। শীতে বাঙালির ব্যঞ্জনের তালিকায় পীঠে-পুলির মতোই মর্যাদা পায় এই নলেন গুড়ের সন্দেশ। আর মিষ্টির দোকানের শোকেস থেকে উঁকি দেয় গুড়ের রসগোল্লা। এই তো সময়! খাবারের প্রতি যিনি ততটা বিলাসী নন, কিংবা ডায়বেটিসের যন্ত্রণা আছে- সবভুলে তিনিও না হয় একদিন ডুব দিলেন নলেন গুড়ের স্বর্গীয় স্বাদে! ক্ষতি কি?