গুড়ের সন্দেশকে টেক্কা দিল চকলেট সন্দেশ! মিষ্টিমুখেও সাম্রাজ্যবাদ
Nalen Gur: বাহারি ডার্ক চকোলেটের পাশে ম্রিয়মাণ নলেন গুড়, বিষণ্ণ সন্দেশ, আর একখানা রুগ্ন অস্তিত্ব সংকট।
বাঙালিকে আত্মঘাতী বললে অর্ধেক বলা হয়। বাকি অর্ধেক খুঁজতে হলে যেতে হবে বাংলা অভিধানের কাছে। সেখানে ঐতিহ্য, পরম্পরা, শাশ্বত, চিরকালীন এসব শব্দের উপর বাঙালিরা পিঁড়ি পেতে রেখেছেন সেই কবেই। তবে কী না জীবন গতিময়, তাই স্রেফ পিঁড়ি পেতে রাখলেই তো হয় না। জীবন মানে হালফিলে জেনেছি জি বাংলা, তার আগে অবধি দার্শনিকরা গতিময়তাকেই জীবন মেনে এসেছেন। সুতরাং স্রোতের গতি বাঙালির পা টলমলিয়ে দিল। সে ঐতিহ্যের পিঁড়ি ছেড়ে পা বাড়াল বাজারের পথে। বাজারে ঠেলাঠেলি, গোঁতাগুঁতি শেষে জীবনের একটি ধন সে খুঁজেও পেল। দেখল সম্ভার কারে কয়! বিকল্প কারে কয়! তাক লাগিয়ে দেওয়া সব আয়োজন, চমক লাগানো তার প্রকাশ। পরম্পরার পিঁড়ি তুলে আসা বঙ্গবাসী বাজারে গিয়ে বুঝল, এখানে নিত্য নতুনের আনাগোনা। কোথায় পিঁড়ি, কোথায় সোফা! এই সমান্তরাল বিশ্বও (একটু বাদেই যাকে আমরা কর্পোরেট বলেও ডাকব) বুঝল, এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা গ্রাহক ছাড়া। খদ্দেরকে ভগবান করে টেনে আনল নিজগৃহে, মিনারেল ওয়াটার দিল, এসির শৈত্য দিল। হাঁ মুখে গুঁজে দিল ডার্ক ফ্যান্টাসি। তারপর ক্লোজ ইওর আইজ অ্যান্ড মিস মি… বলতে বলতে এনে ফেলল সঙ্কটের মুখে! শ্যাম রাখি না কুল, প্রণাম রাখি না হ্যান্ডশেক, পায়েস রাখি না কেক, গ্রামবাংলা রাখি না বিশ্ববাংলা - এই দ্বন্দ্বে পড়ে ক্রমেই সে হয়ে উঠল অকেশনালি ট্রাডিশনাল।
অকেশনকে গ্রামবাংলা বলে পরব, পার্বণ আর বিশ্ববাংলা বলে ইভেন্ট। জীবন যেমন গতিময়, তেমনই ঘটনাময়! বিশেষ করে বাঙালির, এই ধরনের ঘটনা/উৎসবের সঙ্গে মিষ্টান্নের ব্যাপক সখ্যতা। অন্নপ্রাশন থেকে সত্যনারায়ণ, বিয়ে থেকে শ্রাদ্ধ, বিরহ থেকে বাসনা সবেতেই মিষ্টিমুখের কদর। তবে দু’ দশক আগেও বাঙালির পিঁড়ির প্রতি টান ছিল অমোঘ। মিষ্টিমুখ বলতেই রসগোল্লা, সন্দেশ। তার আবার হাজারো রকমফের। বিয়েশাদিতে রসগোল্লা খাওয়ার প্রতিযোগিতা- সে এক তুমুল ব্যাপার! শীতের পিছু পিছু চলে আসত নলেন গুড়ের কীর্তিকলাপ। গুড় দানা দানা হয়ে গেলে দোকানি গুষ্টির তুষ্টি করা, পাতলা খেজুর গুড়ে পিঠে চুবিয়ে আঙুল অবধি খেয়ে নেওয়া, চিনির নারকেল নাড়ু না কি গুড়ের নাড়ু- কে কাকে টেক্কা দেবে এসব ছিল ওই পিঁড়ি পাতা সংসারের বারোমাস্যা। আতপচালে মাখা গুড়ের পায়েসের ঘ্রাণ যখন চৌকাঠ পেরিয়ে পাশের ছাদের নাকে গিয়ে পৌঁছেছে- সে যে কী মোহময় সর্বনাশ! বাড়িতে বাড়িতে তখন শীতের অপেক্ষা, গুড়ের অপেক্ষা, শীতের ওমে গুড়ের রসগোল্লা, মুখে দিলে গলে যাওয়া নলেন গুড়ের সন্দেশ ছাড়া কিচ্ছু চায়নি বাঙালি।
তারপর কালের সাইকেলে চড়ে একদিন যুগের হাওয়া এল। জন্মদিনের পায়েসকে হালকা করে ঠেলে টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে পড়ল চকলেট কেক! স্টিলের বাটি, তাতে গুড় রঙা পায়েস, সামর্থের কিশমিশ তাতে উঁকি দিচ্ছে কোথাও। তার না তো আছে নিজস্ব মোমবাতি, না তো আছে দুড়ুম করে ফাটানো রঙিন কাগজের বৃষ্টি। বাহারি ডার্ক চকোলেটের পাশে ম্রিয়মাণ নলেন গুড়, বিষণ্ণ সন্দেশ, আর একখানা রুগ্ন অস্তিত্ব সংকট। কিন্তু এই বঙ্গদেশে, এই ভারতদেশে এমন সংকট এলো কোত্থেকে? ভারতীয় মিষ্টিপদ কবেই বা হয়ে গেল ডেজার্ট! সবার উপরে ব্রিটিশ সত্য! ভারতে কোকো চাষের (মানে চকলেটের মাতৃকুল) ইতিহাস লুকিয়ে আছে ঔপনিবেশিকতাতেই।
আরও পড়ুন: আসছে গুড়ের মরশুম! স্বাদে নয় শুধু, পুষ্টিগুণেও সেরা এই শীতের মিষ্টিমুখ
যেভাবে ভারতের মাটি হয়ে উঠল কোকোর বসতি
চকলেটের ইতিহাস ৪০০০ বছরের পুরনো। দক্ষিণ আমেরিকার মায়ান এবং অ্যাজটেকরা প্রথম কোকো বীজের মাহাত্ম্য আবিষ্কার করে। নিজেদের দেবতাদের ভোগ হিসেবে চকলেটই দিতেন তারা। ব্যাপারটা দেব দেবতা থেকে সোজা অর্থনীতিতেও নেমে আসে কারণ সেই সভ্যতায় মুদ্রা হিসাবেও ব্যবহার করা হত চকলেট। কিন্তু এদেশে ব্রিটিশদের আঙুলে ধরেই এল কোকো, আঠারো শতকের শেষের দিকে। ব্রিটিশরা চকলেট অন্ত প্রাণ। ফলে মাঝে মাঝেই মিষ্টিমুখ করতে ইচ্ছে হয়। এই ইউরোপীয় ক্রেভিংস মেটানোর জন্যই ব্রিটিশরা বিশ্বজুড়ে যেখানে যেখানে উপনিবেশ গড়েছে, সেখানে সেখানেই পরিবেশ বুঝে কোকোর চাষের ঘাঁটি গেড়েছে। তবে সংকটের ধমনী খুঁজতে হলে বেশ কিছুটা এগিয়ে চলে আসতে হবে ১৯৬০-এর দশকের ভারতে। এই সময়ই ক্যাডবেরি, বিশ্বব্যাংক এবং কেরল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহাযোগিতায় কোকো কৃষি উদ্যোগ নেয়। ক্যাডবেরি বুঝতে পারে, দক্ষিণ ভারতের উষ্ণ আবহাওয়া, বনের ছায়া, মাটিতে এই চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। ক্যাডবেরির উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থাই স্থানীয় কৃষকদের কোকো সম্পর্কে জ্ঞান দেয়, কোকো চাষে কত লাভ তার হিসেব একেবারে অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দেয়। ট্রায়ালও দিয়ে নেয় যাতে কোকোর কার্যকারিতা এবং উচ্চ-ফলনশীল কোকোর জাত চিহ্নিত করা যায়। কোকো শুধুমাত্র দক্ষিণের রাজ্য কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটকেই চাষের উপযুক্ত। এত কিছু শোনার পরেও পরিসংখ্যান হতাশই করবে। ভারতীয় কোকো বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের মাত্র ১%। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, ভারতে চাষ হওয়া কোকো সরাসরি স্থানীয় চাহিদা মেটাতেই চলে যায়। প্রায় ১৪০ কোটির ‘মিষ্টিমুখ’ করাতে হলে উদ্বৃত্ত যা থাকে তা দিয়ে ওই ১% সরবরাহই সম্ভব।
ভারত তারপর হয়ে উঠল চকলেট তৈরির যন্ত্রপাতি উৎপাদনের আধুনিক কেন্দ্র। ইউরোপে ১৮, ১৯ এবং ২০ শতকের বড় অংশ জুড়েই এইসব মেশিনপাতি তৈরি হয়েছিল। তারপর থেকে ভৌগলিকভাবে এই উৎপাদনের মুখ ঘুরে যায় এশিয়ার দিকে। এই উৎপাদনের বেশিরভাগই এখন ঘটছে ভারতে। যার ফলে ভারতের ‘চকলেট সংস্কৃতি’র লাভ বেড়েছে বেশিই। স্থানীয় চকলেট ব্র্যান্ডগুলি ধীরে ধীরে কম দামের যন্ত্রপাতি নিয়েই গড়ে তুলছে চকলেট শিল্প। কেক, হোমমেড চকলেট ধীরে ধীরে ব্যবসায় হাত পাকানোর মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই বঙ্গেও।
ভারতের চকলেট বাজার ২০১৭-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৫-২০২০ সময়কালে চিনের পাশাপাশিই ভারতে চকলেটের বাজার সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পাবে। ২০১৬ সালে, দেশে চকলেটের বাজার বছরে ১৩ শতাংশ বৃদ্ধির মুখ দেখেছিল! বাংলায় খানাপিনা সংক্রান্ত বাজার চিরকালই লাভজনক। সুতরাং এসব সংখ্যার কচকচানির ঊর্ধ্বে হাতে রইল মার্কেট। কিন্তু চাইলেই তো আর ঐতিহ্যশালী বাঙালিকে পিঁড়ি থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে ফেলা যায় না। অতএব, স্লো বাট স্টেডি। আগে শিশুদের পাকড়াও করো। লেবু লঞ্জেস, কাচ্চা ম্যাঙ্গোর পাশে ধীরে ধীরে এসে বসল জেমস, কিটক্যাট, ডেয়ারি মিল্ক। তারপর ‘হোয়াই শুড কিডস হ্যাভ অল দা ফান’ বলতে বলতে বড়দের পাতে, মনে, ব্যাগে, ফ্রিজে সর্বত্র ঢুকে পড়ল চকলেট। তবে হ্যাঁ, সে এল বাঙালিয়ানার ঘ্রাণ মেখেই। বাঙালি দেখল মিষ্টির তাক লাগানো ফিউজন! চকলেট রসগোল্লা, টু ইন ওয়ান সন্দেশ। কালচে চকলেটের টপিংয়ের নিচে কোণঠাসা বঙ্গ মিষ্টান্ন।
ফিউজনের প্রতি মোহ আসলে বিরাট এক ঢাল। ঠিক সর্বস্ব খুইয়ে বসছিও না আবার ট্রেন্ডিং হয়েও সারভাইভাল সারভাইভাল খেলছি। ইচ্ছা হলে উইকেন্ডে ফিরে আসছি পাতা পিঁড়ির কাছে, আর সপ্তাহ জুড়ে তুমুল হট্টগোলে সাঁতরে যাচ্ছি কর্পোরেট পারাবার। পরীক্ষায় পাশ, বিবাহবার্ষিকী, প্রেমে ছ্যাঁকা বা উত্থান, প্রমোশন, ডিপ্রেশন- সবেতেই চকলেট মাখামাখি। শুধু চকলেট নয়। মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে বৃহৎ পুঁজি বনাম ছোট পুঁজির লড়াই। মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে পাড়ার দোকানকে খাবলে গড়ে ওঠা ব্র্যান্ডেড ঝলসানি। দুর্দান্ত প্যাকেজিংয়ে যে ডেজার্ট ফ্রিজে উঠে আসছে তা আসলে ছোট ব্যবসায়ীদের গ্লানি, গরিব পকেটের হাপিত্যেশ। কিন্তু এসবই সংখ্যালঘু। বাজারে চাহিদার গ্রাফ তৈরি করে ভরা পকেটের মানুষই। ফলে দেহাতি গুড়ের মিষ্টির বদলে সেখানে চকলেট সন্দেশের জাত্যাভিমান যে বেশি হবে, এমনটাই তো স্বাভাবিক।
এর মাঝে অনুঘটক হয়েছে বিজ্ঞাপন এবং সোশ্যাল মিডিয়া! চকলেট অনুরাগীদের কত কত গ্রুপ। মাখানো চকলেটের লোভনীয় ছবির পাশে শীত এলে অবশ্য নলেন ঐতিহ্যের দাস্তান নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু সাময়িক। বছরভর সে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারে না, এগলেস, ক্যারামেল, ডার্ক, ফ্রুট-নাটসের হাতছানির সঙ্গে। পুজোয় উজ্জ্বলতার স্রোতে বুকের ভিতর থেকে হাঁক পাড়ে সেলিব্রেশনের তাগড়াই বাক্স। দীপাবলিতে ঝাঁ চকচকে প্রেমিক-প্রেমিকা আলোয় মাখামাখি চকলেট ভাগ করে খায়, ভাইফোঁটায় বিশ্বস্ত, সুলভ উপহার হয়ে ওঠে ক্যাডবেরি। চকলেট খেলে কী কী উপকার হয় তা নিয়ে ঢালাও ঢালাও তথ্য-আবেগ ঝরে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। গুড় কদরহীন পরম্পরার ঝাড়বাতিতলে দাঁড়িয়ে যুগের জলে প্রজন্মের অবগাহন দেখে। এই কর্পোরেট সমগ্রে, এই বাজার সংকলনে তার জন্য দু’এক পাতা বরাদ্দ কী না ভাবে। উৎসবে-ব্যসনে-রাষ্ট্রবিপ্লবে-রাজদ্বারে যঃ তিষ্ঠতি, স চকলেটঃ! এখানে গুড়ের আখ্যানের জন্য কতই বা সময় বরাদ্দ আর।