আদালতের শুনানি থেকে ফুসফুসের ক্যানসার! শুটিংয়ে কোনও বাধাই মানেননি সন্তোষ দত্ত

Santosh Dutta : জটায়ু থেকে অবলাকান্ত, “হাইলি সাস্পিসিয়াসসসসস!” সন্তোষ দত্ত

ছায়া সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে চলে যাচ্ছে, সেখানেই একটি গলিতে অতি সাধারণ দোতলা বাড়ি। বাড়ির নাম সুরধনী কুটির। নীচের তলায় চেম্বার, রান্নাঘর, বাথরুম আর ওপর তলায় দুটো ঘর। আর পাঁচটা বাড়ির মতোই ছিমছাম, সাদামাটা। অথচ এ বাড়ির মানুষটি তখন বেশ পরিচিত মুখ, রীতিমতো ‘কাল্টিভেট’ করার মতো একজন।

মানিকতলা চত্বরে এক অতি সাধারণ বাড়িতে থাকা এই মানুষটিই রিয়েল জটায়ু! অর্থাৎ সন্তোষ দত্ত।১৯২৫ সালের ২ ডিসেম্বর, অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরে জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর বাবাও ছিলেন একজন মঞ্চ অভিনেতা। ছেলেকে মঞ্চের পথটা তিনিই চিনিয়েছিলেন প্রথম। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে অনেকবার গিরিশ ঘোষের নাটকও দেখতে গিয়েছেন সন্তোষ দত্ত। পাশাপাশি পড়াশোনাতেও তুখড় ছিলেন তিনি। ওকালতি পাশ করেও প্রথম জীবনে তিনি প্রায় ১৪ বছর ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অর্থাৎ আজকের স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি করেছেন। পরে অবশ্য উড়িষ্যায় বদলির ফরমান আসায়, সে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। বাংলাকে এতটাই ভালোবাসতেন আজীবন। তাই ‘সোনার কেল্লা’ ছবির সেই অমোঘ সংলাপ যেন তার মুখে অমন সুন্দর মানিয়ে যায় - “ধুর মশাই, আমি গড়পাড়ের লোক, হিন্দি কি কেউ সাধে বলে নাকি!”

ব্যাংকের চাকরিতে ইতি টানলেও বসে থাকতে হয়নি, শুরু করলেন ওকালতি। এমনকী অভিনয়ে পাকাপাকি জায়গা করার পরও এ অভ্যাসে ছেদ পড়েনি কখনও। তিনি বরাবর বলতেন, অভিনয় তাঁর নেশা, পেশা কিন্তু ওকালতিই। শুধু তাই নয় বিখ্যাত অভিনেতা হয়েও তিনি আদালতে যেতেন তেরো নম্বর ট্রামে করে। লাইনে দাঁড়িয়ে মিনিবাসে করে বাড়ি ফিরতেন। খ্যাতির বিড়ম্বনায় বাস-ট্রাম ছেড়ে কদিন ডালহৌসি থেকে মানিকতলা হেঁটেও ফিরেছিলেন। এমটাই সাদামাটা ছিল তাঁর জীবন।

আরও পড়ুন : ‘সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান’ হয়ে রয়ে গেলেন, যে সুব্রত মিত্রকে চিনল না বাঙালি


১৯৫৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ ছবি দিয়েই বাংলা সিনেমায় তাঁর পথচলা শুরু। যদিও এর বছর তিনেক আগে রুপকার নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার সবিতাব্রত দত্তের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় সুকুমার রায়ের লেখা ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ নাটকটি, সেখানেই ভবদুলালের চরিত্রে প্রথম সন্তোষ দত্তের অভিনয় চাক্ষুষ করেন সত্যজিৎ রায়। মুগ্ধ হয়ে পরিচালক মশাই সেদিন বলে বসেন, “বাবা হয়ত আপনার জন্যই চরিত্রটা কল্পনা করেছিলেন”। প্রথম জীবনেই এমন একজনের প্রশংসা, এটাই যেন ব্রহ্মাস্ত্র হয় সন্তোষ দত্তের জীবনে। এরপরই ‘পরশপাথর’। ছোট চরিত্র হলেও ঘোষকের ভূমিকায় তাঁর মুখ ভঙ্গিমা নজর কাড়ে দর্শকদের। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ধাপে ধাপে এগিয়ে গেলেন তিনি।

১৯৬১ সালে ‘সমাপ্তি’ ছবিতে পাত্রের মেয়ে দেখতে আসার দৃশ্যে পাত্রীর বাবার ভূমিকায় অভিনয় করলেন সন্তোষ দত্ত। সেই দৃশ্যেই ঘরে একটি কাঠবিড়ালি হঠাৎ ঢুকে পড়ায় তৈরি হয় কৌতুকের আবহ, আর ওই ছোট্ট পরিসরেও জাত চিনিয়ে দিলেন সন্তোষবাবু। সন্তোষ দত্তের মতো অভিনেতাকে নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন সত্যজিৎ। সন্তোষ দত্ত যেন তার লুকানো বোমা। উপযুক্ত পরিসর না হলে কিছুতেই সামনে আনবেন না। তিনি জানতেন চরিত্র ছোট হলেও সন্তোষবাবু তাতেই মাত করবেন, আর আশেপাশের বড় বড় চরিত্রগুলোকে কাটিয়ে উনিই হয়ে উঠবেন শো স্টপার। তাই ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবির ‘মহাপুরুষ’ অংশে (পরশুরামের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ ছোটগল্প অবলম্বনে) আবার একটি ছোট কৌতুক চরিত্রে সন্তোষ দত্তকে ব্যবহার করলেন সত্যজিৎ। এক তোতলা আপনভোলা বিজ্ঞানের প্রফেসরের এই চরিত্রেও দারুণ সফলতা এনে দিলেন সন্তোষ দত্ত। কিন্তু এর পরের দুটি ছবি ‘নায়ক’(১৯৬৬) এবং ‘চিড়িয়াখানা’(১৯৬৭) –তে অজস্র চরিত্রের ভিড় থাকলেও ব্যবহার করলেন না সন্তোষ দত্তকে। কারণ একটাই, উপযুক্ত চরিত্রের অভাব। ১৯৬৮ তে হাতে পান গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির দুটি অনবদ্য চরিত্র শুন্ডিরাজা ও হাল্লারাজা। পরস্পরবিরোধী এই দুটি চরিত্রেই সন্তোষ দত্তের অসামান্য অভিনয় দিয়ে ভরিয়ে দেন ছবিটিকে।অনবদ্য ট্রানজিশন, অনবদ্য ভারসাম্য ফুটে ওঠে তাঁর অভিনয়ে। অত্যন্ত কঠিন অথচ কি সহজাত!

এরপর অবশেষে সেই কালজয়ী চরিত্র - জটায়ু। ১৯৭৪ সালে ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে এক ঘোর তৈরি করলেন তিনি। তাঁর মুখে একের পর এক অসাধারণ সংলাপ। আর কী অসাধারণ সেসব বলার ভঙ্গিমা। নিমেষে অমন গোয়েন্দা কাহিনীর রহস্যের মধ্যেও অচিরেই কৌতুক ভরে দিল। বাঙালি আজও মুখস্থ বলে দিতে পারে সেইসব সংলাপ। এমনটাই গেঁথে রয়েছেন জটায়ু। “কোনও প্রশ্ন নয়” তাঁকে নিয়ে। তিনি সত্যিই যেন “হাইলি সাস্পিসিয়াসসসসস!” মাত্র দুটি ফেলুদার ছবিতে কাজ করেছিলেন সন্তোষ দত্ত, তাতেই বাজিমাত। তাঁর মৃত্যুর পর সত্যজিৎ রায় আর একটাও ফেলুদার গল্প থেকে ছবি করেননি। কারণ একটাই, বাঙালির মনে জটায়ুর ছবিটা যে গেঁথে গিয়েছে ওই মুখেই।

সত্যজিৎ রায় ছাড়াও পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘মালঞ্চ’, অমল শূরের ‘গোপাল ভাঁড়’, পীযূষ বসুর ‘সিস্টার’, ‘ব্রজবুলি’, তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’, দীনেন গুপ্তর ‘মর্জিনা আবদুল্লা’, সলিল দত্তের ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’, ‘পূজারিণী’, উমানাথ ভট্টাচার্যের ‘চারমূর্তি’, ‘নবীন মাস্টার’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ঘটকালি’, ‘শোরগোল’, ‘হুলস্থুলু’, ‘খেলার পুতুল’ বা ‘সুবর্ণলতা’র মতো বহু ছবিতে অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন সন্তোষ দত্ত।

আরও পড়ুন : উত্তমের পা জড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন সৌমিত্র! কেমন ছিল দু’জনের সম্পর্ক 

সত্যজিৎ রায় এক জায়গায় লিখেছিলেন, সন্তোষ দত্তের অভিনয়ের প্রতি টানের কথা। মামলার দিনে শুটিং-এর তারিখ পড়লে হামেশাই বদল করে নিতেন শুনানির তারিখ, কিন্তু অভিনয়ের সঙ্গে কোনও আপোষ নয়। ‘সোনার কেল্লা’ ছবির রাজস্থান অথবা ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির পুরুলিয়া, আউটডোর করতে গিয়ে আদালতের শুনানি মুলতবি রেখেছিলেন তিনি। সন্তোষ দত্ত এমনিই একজন মানুষ ছিলেন যে বাদী ও বিবাদী পক্ষের উকিলরাও মানিয়ে নিতেন সহজেই।

বাস্তব জীবনেও মজার মানুষ ছিলেন সন্তোষ দত্ত। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘একেই বলে শুটিং’ বইতে লেখেন- কাশীর সরু গলির পথ আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি প্রকাণ্ড ষাঁড়, ফেলুদা আর তোপসে ষাঁড়টাকে পাশ কাটিয়ে গেলেও জটায়ু অর্থাৎ সন্তোষ দত্ত ভয় পাচ্ছেন, ইতঃস্তত করছেন। পরে শ্যুটিং-এর সময় সেই ষাঁড়ই ব্যাগড়া দিয়েছিল জটায়ুকে। মুখ ঘুরিয়ে এমন শিং নাড়িয়েছিল যে, অভিনয় ভুলে জটায়ু একলাফে তিনহাত পিছনে। যাকে বলে রিয়েল জটায়ু। যদিও ক্যামেরা ঠিকঠাক কাজ না করায় সেই দৃশ্য শেষ অবধি ধরা যায়নি। এ নিয়ে আফসোস করতেও শোনা যায় রায় মশাইকে।

ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়লেও কাজ থামাননি তিনি। চিকিৎসা চলে ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে। রেডিয়েশন নিয়েও পেশা ও নেশা দুটোই চালিয়ে যান সমানতালে। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৮৮ সালের ৫ই মার্চ চলে গেলেন চরিত্রাভিনেতা সন্তোষ দত্ত। যদিও রেখে গেলেন অনেক অনেককিছু। আজও ‘লালমোহন বাবু’ বা ‘অবলাকান্ত’র মতো চরিত্রের বিকল্প কেবলই সন্তোষবাবুই। যতোই হাল-আমলের ওয়েব সিরিজ চেহারার মিল খুঁজে আনুক না কেন অমন সারল্যের বুঝি সত্যিই কোনও নকলনবিশ হয় না।

More Articles