'সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান' হয়ে রয়ে গেলেন, যে সুব্রত মিত্রকে চিনল না বাঙালি

আমাদের বিস্মিত হওয়া ও ওঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ ছিল যে, সুব্রতদা 'অপরাজিত' ছবিতে প্রথম বাউন্স লাইট করে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সাদা কাপড়ের বিপরীতে লাইট রেখে সিনেমায়ার অভ্যুত্থান ঘটালেন।

 

পাড়ার মুদির দোকানের বিক্রেতা বলেছিল, 'খিটখিটে বুড়ো' আর রিকশাচালক রঘু বলেছিল, "ফটোসটো খিঁচতা হ্যায়, পাগল হ্যায় বাবু।" আসলে ল্যান্সডাউন রোডের ওপর পেল্লায় বাড়ি থেকে সাইকেলে উদ্দেশ্যহীন যিনি প্রতিদিন নিয়ম করে ঘুরে বেড়াতেন, তৎকালীন সময় এই প্রায়ঃবৃদ্ধকে আপাতদৃষ্টিতে পাগল ভাবারই কথা। খিটখিটে তো ছিলেনই, তার সঙ্গে ছিল রসিকতা আর নিরন্তর খ্যাপামি। ভবানীপুরের প্রাচীন বাসিন্দারা ছাড়া অঞ্চলের লোকজন তেমন চিনতেন না এই মানুষটিকে।

কখনও চেনাতে চাননি। আমরাও জানতে চাইনি। তাকে চেনাতে হয় সত্যজিৎ রায়ের প্রথম দশটা ছবির চিত্রগ্রাহক হিসেবে। ঢাকা পড়ে যায় সিনেমার সুনির্দিষ্ট আলো-কালোর যুগান্তকারী প্রণেতা থেকে আলোছায়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই চিত্রগ্রাহক। হ্যাঁ, ইনি সুব্রত মিত্র।

সুব্রত মিত্রর ছোট ভাই বাচ্চুদা ছিলেন আমাদের ঘনিষ্ঠ। তিনি সেই সময় সুব্রত মিত্রের তিন-চারখানা অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরা সামলাতেন। ক্যামেরাগুলো ভাড়ায় পাওয়া যেত শুটিংয়ের জন্য। দেউজিভাইয়ের পর সুব্রত মিত্রই অন্যতম, যিনি বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে উন্নতমানের ক্যামেরা এনেছিলেন (তার আগে এইসব ক্যামেরা মুম্বই কি চেন্নাই থেকে নিয়ে আসতে হতো)। সেই ক্যামেরা ভাড়া পেতে গেলে আবার ইন্টারভিউ দিতে হতো। কে পরিচালক, কে চিত্রগ্রাহক? তাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে ক্যামেরা পাওয়া যেত। এই ক্যামেরা নিয়ে একটা ঘটনা জানাই।

আরও পড়ুন: নেশা আর খিস্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলেন যে বাউল

সুব্রতদা নতুন ক্যামেরা এনেছেন সবে। তো একজন কেয়ারটেকার দরকার। অনেকের মতো আমাকেও বলেন। আমার পরিচিত একটি ছেলেকে নিয়ে যাই। বললাম, এ খুব ভালো ছেলে, ক্যামেরা শিখতে চায়, উৎসাহ আছে।

সুব্রতদা থামিয়ে দিয়ে বললেন, "ভালো ছেলে দিয়ে কী করবো? মেয়ের বিয়ে তো দেব না! আমার চাই কাজের ছেলে।" এই বলে ফিতে দিয়ে তার উচ্চতা মাপতে শুরু করলেন। পদার্থবিজ্ঞানের নানা প্রশ্ন করলেন। জানতে চাইলেন সাহিত্য পড়ে কি না এবং কী কী পড়েছে। আসলে বলতে চাইছি যে, ক্যামেরা কেয়ারটেকার হওয়ার জন্য হয়তো এগুলোর কোনওই প্রয়োজন নেই তেমনভাবে। কিন্তু তিনি ছিলেন এমনই।

আমি তখন ভবানীপুরে ওঁর বাড়ির ঢিলছোড়া দূরত্বে থাকি। নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় তখন থেকে। সুব্রতদার ছিল নিজের বাড়ির প্রতি মারাত্মক ভালবাসা। তা জানতে পেরে ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মকবুল ফিদা হুসেন সুব্রতদার বৈঠকখানার দেওয়ালজুড়ে ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, "সুব্রত বেঁচে থাকতে এই ছবি নষ্ট হবে না। কারণ ও কখনও বাড়ি ভাঙবে তো নাই-ই, এমনকী, সারাবেও না।"

এই বাড়ির দোতলায় থাকতেন তিনি। নিচে কলিং বেলের জায়গায় একটা ছোট্ট ববিন ছিল (ফিল্মের নেগেটিভ ববিনে গোটানো হতো)। তাতে লেখা থাকত, 'জেন্টলি পুল' আর বাংলায় 'ধীরে টানুন'। সেই ববিন টানলেই নিচ থেকে ওপর অবধি সারা বাড়িতে বেজে উঠত ঢংঢং টিংটিং টকটক কুলকুল ঠিংঠাং। সেগুলো নানা কাউবেল আর গোটস হর্নের সমষ্টিবদ্ধ ও সমবেত শব্দ, যা সুব্রতদা বানিয়ে রেখেছিলেন।

ওঁর ঘরে ছিল একটি প্রশস্ত খাট। তার অর্ধেকের বেশি অংশজুড়েই গোটা ক্যামেরা কিংবা খোলা ক্যামেরা, ক্যামেরার নানাবিধ যন্ত্রাংশ, তার সঙ্গে কিছু অযত্নের বই-খাতা।

ও-বাড়িতে সিগারেট খাওয়া বারণ ছিল। আমার জন্য ঘরের সঙ্গে লাগানো ছোট্ট বারান্দাটা বরাদ্দ করেছিলেন (সিগারেট ফোঁকার জন্য)। ফলে আমি বারান্দায় একটা চেয়ার বা টুলে বসে আর উনি ঘরে বসে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতো আড্ডা আর রকমারি গল্প। ওঁর স্ত্রী ছিলেন পাঠভবনের তখন প্রধান শিক্ষিকা নন্দিতা মিত্র। নন্দিতাদি শনিবার কি রবিবার করে মাঝে মাঝে আসতেন। তখন আরও জমে যেত। কেননা নন্দিতাদির সঙ্গে তর্কে-কথায় পেরে উঠতেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুপ করে যেতেন। সে-বয়সে এটা উপভোগ্য ছিল নিঃসন্দেহে। এখানে জানাই, সুব্রতদা ছিলেন অত্যন্ত সিনিকাল নাক সিঁটকানো ভাবের মানুষ। শেষ বয়সে এই কারণে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। তা হোক গে!

আমি দেখার চেষ্টা করেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি সুব্রতদার প্রায়োগিক আয়োজন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বা আচার-আচরণ নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। সুব্রতদার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগেই ওঁর সম্পর্কে নানা কথা শুনেছি। কেউ বলেছে বাতিকগ্রস্ত, তো কেউ বলেছে অহংকারী, কেউ বলেছে খ‍্যাপাটে, তো কেউ বলেছে পাগল। কিন্তু আমি যেটা দেখেছি, তা হলো নিখুঁত করার চেষ্টা। বিষয়টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করে তারপর লক্ষ‍্যে পৌঁছনো।

একটা ছোট্ট ঘটনা এখানে জানিয়ে রাখি। একদিন সকালে উনি এসেছেন। তখন ব্রেকফাস্টের আয়োজন চলছে। ওঁকে অনুরোধ করতে একটা টোস্ট খেতে সম্মত হন। খেতে খেতেই জানতে চাইলেন, টোস্টারটি কোন কোম্পানির ইত্যাদি। আমার বান্ধবী যথাসাধ্য জানাল। তার পরের দিন শুনি যে, উনি চার-চারটি টোস্টার ও দু'পাউন্ড পাউরুটি কিনে দিনভর পরীক্ষা করেছেন কীভাবে সমগ্র পাঁউরুটির খন্ডটি একইসঙ্গে টোস্ট করা যায়।

হ্যাঁ, পাগল বলতেই পারে আশপাশের লোকজন।

সেই বয়সে আমাদের বিস্মিত হওয়া ও ওঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ ছিল যে, সুব্রতদা 'অপরাজিত' ছবিতে প্রথম বাউন্স লাইট করে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সাদা কাপড়ের বিপরীতে লাইট রেখে সিনেমায়ার অভ্যুত্থান ঘটালেন। তিনি নানা সাদা কাপড়ের ওপর পরীক্ষা করে আবিষ্কার করেছিলেন যে, একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির কাপড়ই লাইট-কারেকটেড। ওঁর আরেকটি বিরাট কাজ হলো অ্যারিফ্লেক্স ও নাগ্রা কম্বিনেশনকে জনপ্রিয় করা। পূর্ববর্তী কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়া একজন স্থিরচিত্রগ্রাহক কীভাবে আবিশ্ব সিনেম‍্যাটোগ্রাফির দিকদর্শন পাল্টে দিয়েছিলেন, ইতিহাসে নিশ্চয়ই তার উল্লেখ থাকবে।

শুধু মেশিন বা প্রযুক্তি দিয়েই সুব্রত মিত্রকে শনাক্ত করা যাবে না। উনি একজন দক্ষ সেতার বাজিয়ে ছিলেন। শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের ও মার্চেন্ট আইভরির একাধিক ছবিতে আবহ কম পড়ায় সেতার বাজিয়ে দিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, যখন শুনি যে, সেইসব কোনও কোনও ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন রবিশঙ্কর। বলতে গেলে নিয়মিত ছবি আঁকতেন, যার কিছু কিছু কাজ আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। একটা সিরিজ করেছিলেন কম্পিউটার প্রিন্টআউটের পিছনে নীল আর কালো রঙ দিয়ে। অসম্ভব ধারালো শক্ত তুলিতে (!) আঁকা অন্তত গোটাতিরিশেক ছবি। তার বিষয় কী ছিল? বিষয় ছিল নির্দিষ্ট। দু'টি কঙ্কালের মৈথুন। অকস্মাৎ দেখে ঠিক বুঝতে পারিনি, কী বলব! দুরূহ সেই ভাবনার তারিফ করব না কি ভয়ংকর মর্বিড বলে নিস্তার পাব। আচ্ছা এটা কি প্রতিষ্ঠানবিরোধী...

More Articles