উত্তমের পা জড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন সৌমিত্র! কেমন ছিল দু'জনের সম্পর্ক
সৌমিত্র একবার উত্তমের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন। কী এমন হয়েছিল সেদিন?
সত্যি সত্যিই আমার ঈর্ষার যোগ্য নন এমন মানুষকে ঈর্ষা করি না, ঈর্ষা করা আমার আসে না। সেরকম গুণ যাঁদের মধ্যে দেখি আমি তাঁদের এত গুণগ্রাহী হয়ে যাই যে, সেই ঈর্ষার জায়গাটা আমার তাতেই মেল্ট করে যায়। সেরকম হয়ত কিছুমাত্রায় উত্তমদার ক্ষেত্রেও আমার ঘটেছে।
-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
বাংলা সিনেমার জগৎ বলে নয়, মোটামুটি সমস্ত ক্ষেত্রেই মানুষ একটা ডাইকোটমি পছন্দ করে। তাতে করে মাটির সোঁদা জীবনে খানিক বৈচিত্র্যও আসে, আবার জুয়ার উত্তেজনারও খানিক সুবিধে হয়। রঙিন দুনিয়া তাই দর্শকের মননের রঙে রঙিন। পর্দার পিছনের নানান ঘটনায় মানুষ রং চড়ায়, যারা গল্প বলে তারাও, যারা গল্প শোনে তারাও। ফলে প্রতিযোগিতার একটা তুমুল উত্তেজনা, দল বিভাজন মায় আড্ডা থেকে হাতাহাতি। উত্তম-সৌমিত্র বাঙালির কাছে তেমনই হট টপিক। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁজ হয়তো খানিক মরে এসেছে, চোখ দিয়ে আর জল পড়ে না, তবু চর্চার ছায়াখানি রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আদতে কেমন ছিল দুই মহারথীর সম্পর্ক? চলুন, আজ তাই নিয়ে আড্ডা দেওয়া যাক।
উত্তম কার্যক্ষেত্রে সৌমিত্রের খানিকটা সিনিয়র। বয়সেও। ফলে সৌমিত্র সক্রিয় হওয়ার আগেই উত্তম রীতিমতো বিখ্যাত তারকা। ছবির জগতেও, আর পাঁচটা কর্মস্থলের মতোই সমান্তরাল সমাজ থাকে। মানুষে মানুষে হাসিকান্না, বন্ধুত্ব, প্রেম, যৌনতা, ঈর্ষা, ঝগড়া— সমস্তই সেখানে বিদ্যমান। বাংলা সিনেমার গোড়ার দিকে এইসব সম্পর্কে কিঞ্চিৎ মাটির গন্ধ থাকত। শুটিংয়ে গিয়ে হয়তো পরিচালকের মশারি খাটানোর দড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, প্রোডাকশন বয় হন্যে হয়ে সাবিত্রীর কাছে, সাবিত্রী চুল বাঁধার ফিতে দিয়ে নিজের হাতে মশারি টাঙিয়ে দিয়ে এলেন। এমন সব সম্পর্ক ছিল। আবার লাইমলাইট নিয়ে রাগ, অভিমান, তিক্ততাও ছিল। উত্তম এবং সৌমিত্রের কার্যক্ষেত্রেও যে রেষারেষি অথবা ঈর্ষার জায়গা ছিল, সেকথা সৌমিত্র কোনওদিনই অস্বীকার করেননি। তবে কী, কার্যক্ষেত্রে, ঈর্ষার ব্যাপারটা প্রোডাক্টিভ। তার বাইরে 'উত্তমদা', তার বাইরে 'পুলু'। বাস্তব জীবনে যে একটা ছদ্ম রাইভালরির ধোঁয়া, তার বেশিরভাগটাই ছবির প্রচারক এবং পত্র-পত্রিকার তোলা। উদ্দেশ্য মূলত বিজ্ঞাপন।
এই লাইনে এসে উত্তমদা কীভাবে নিজেকে কনডাক্ট করেন, এগুলো যখন দেখতাম, আমি দেখতাম সেরকমভাবে আমি পারি না। সুতরাং উত্তমদাকে দেখে দেখে অনেক কিছু আমাকে শিখতে হয়েছে।
-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
লোডশেডিং যখন শুরু হলো, সেবার ইন্ডাস্ট্রিতে একখানা মিটিং ডাকা হয়েছিল। তিনজন কনভেনর। সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। টেকনিশিয়ান স্টুডিও-তে থিকথিকে ভিড়। লোডশেডিং মানে শুটিংয়ের বিরাট ক্ষতি। কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, ঠিক হলো, এই মর্মে সরকারের কাছে একটা ডেপুটেশন দেওয়া হবে। সেদিন সত্যজিতের গাড়িতে তিনজন। উত্তম, সৌমিত্র পিছনে বসেছেন। সামনে সত্যজিৎ। টুকটাক গল্প চলছে। হঠাৎ করেই উত্তম বললেন, "কী মানিকদা, আমাকে আর ছবিতে নিচ্ছেন না?" সত্যজিৎ নাকি বলেছিলেন, "তুমি এমন একটা বয়সে পৌঁছেছ, না বুড়ো না জোয়ান! এই বয়সের রোল না পেলে তো আর তোমাকে নেওয়া যায় না। এই বয়সের রোল পাওয়া মুশকিল।" তখন কথা উঠল, না, ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো বুড়ো নেই। ছবি বিশ্বাস তখন গত হয়েছেন। সেরকম জমকালো স্টার ভ্যালুর বুড়ো, সঙ্গে সেই অভিনয়, খুঁজি খুঁজি নারি। সৌমিত্র ঠাট্টা করে বলেছিলেন, "না না, উত্তমদা ছাড়ো তো! ওসব বুড়ো এখন পাওয়া যাবে না। তুমি আর আমি বুড়ো হলে তখন ইন্ডাস্ট্রিতে আবার ভালো বুড়ো আসবে।" হেসে উঠলেন সকলেই। এরপরে কারণে-অকারণে হতাশায় বিধ্বস্ত উত্তম হয়তো কখনও সৌমিত্রর কাছে দুঃখ করেছেন, "দুর, আর ভালো লাগছে না।" সৌমিত্র বুঝেছেন মানুষটার হতাশা। বলেছেন, "বুড়োর রোলগুলো করতে হবে না? কোত্থেকে হবে, এখন থেকেই ভালো না লাগলে? তুমি আর আমি বুড়ো না হলে…!" হেসে ফেলেছেন উত্তম। এই ছিল দু'জনের সম্পর্ক। যদিও সেই সুযোগ আর আসেনি কখনও।
আরেকটা ঘটনা বলি। সেবার দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের ছবির শুটিং চলছে। একসঙ্গে উত্তম-সৌমিত্র। তা সেই শটে সৌমিত্র নেই। ক্যামেরার পাশে মোড়ায় বসে আছেন। একা উত্তমের শট। লম্বা একটা সংলাপ। দর্শকরা হয়তো জেনে অবাক হবেন, স্ট্যামারিং-এর একটু সমস্যা উত্তমের ছিল। ছবিতে যার গন্ধ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি কোনওদিন। নিজের কাজের প্রতি এতখানি নিষ্ঠা না থাকলে 'মহানায়ক' হওয়া কি সম্ভব! যাই হোক, লম্বা সংলাপের একটা জায়গা একটু খটোমটো। বারবার সেইখানে আটকে যাচ্ছেন উত্তম। রিটেক হচ্ছে। কিছুতেই ঠিক হয় না। সৌমিত্র উঠে গিয়ে বললেন, "আরে এটা বাজে শট। বদলে দিতে বল না?" উত্তম নাছোড়। পরিচালককে ডেকে যদি একবার বলতেন, "লাইনটা বলব না। পাল্টে দাও", না করার সাহস হত না কারও। কিন্তু উত্তম উত্তমই, সৌমিত্রকে বললেন, "আরে বোস না, এক্ষুনি হয়ে যাবে। এটা ঠিক করে বলে নিয়ে তারপর চা খাব।" পরিচালকের টি-ব্রেকের প্রস্তাবও নাকচ করে দিলেন। ছ'-সাতটা টেক বাতিল হওয়ার পরে সৌমিত্রকে ডেকে বললেন, 'পুলু, তুই একটু বাইরে যা তো।' অবাক হয়ে বেরিয়ে সৌমিত্র। মিনিট খানেকের মধ্যে পারফেক্ট শট দিয়ে বেরিয়ে এলেন উত্তম, 'দে, তোর ভালো সিগারেট একটা দে।' হার্টের সমস্যা। প্যাকেট রাখেন না তখন। সিগারেট খেতে খেতে সৌমিত্র কিঞ্চিৎ অবাক স্বরেই বললেন, "আমার অদ্ভুত লাগছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?"
—জানি, কী জিজ্ঞেস করবি।
—হ্যাঁ, কেন? তোমার তো আমাকে দেখে নার্ভাস লাগার কথা নয়। শুনলে পাগলেও হাসবে।
—না, নার্ভাস লাগছিল না। তোকে দেখে ভীষণ সেলফ-কনশাস লাগছিল।
—কেন?
—না মানে উচ্চারণের, জিভের ওই ব্যাপারটা হচ্ছিল তো। তোর জিভটা পরিষ্কার। ওই জন্য একটু সেলফ-কনশাস লাগছিল।
এই ছিলেন উত্তম। আর এই ছিল সৌমিত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। এত অকপটে নিজের সীমাবদ্ধতা যিনি স্বীকার করতে পারেন, তিনিই নিজেকে ভাঙার ক্ষমতা রাখেন। বাস্তবের স্ট্যামারিং কতখানি পরিশ্রম করে দর্শকদের বিন্দুমাত্র বুঝতে দেননি, তা তাঁর সহকর্মীরা দেখেছেন, সৌমিত্র দেখেছেন। শ্রদ্ধা বেড়েছে, বন্ধুত্ব গভীর হয়েছে।
একটা জিনিস মানিকদা সাধারণভাবে বলেছিলেন, হি ওয়াজ নট এ সেরিব্রাল অ্যাক্টর। এই সেরিব্রাল অ্যাক্টর এবং ইনস্টিংক্টিভ অ্যাক্টর— এই জাতগুলো কিন্তু আমার কাছে খুব অ্যাকসেপ্টেবল নয়। কেন বলছি, সেই লোকটার বুদ্ধিমার্গের ছাপ হয়ত অন্য জায়গায় নাও থাকতে পারে অ্যাপ্লিকেশন অব আর্ট-এর সময় ঐ বুদ্ধিটা ফুটে ওঠে। আর উত্তমদার মতো অভিনেতা যদি বুদ্ধি দিয়ে অভিনয় না করতেন, তাহলে তিনি অন্তত এতটা বড় রেঞ্জের জায়গায় কখনওই যেতে পারতেন না। এইটা আমার মনে হয় বেশ একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা।
এখানে দেখা যাচ্ছে, স্বয়ং সত্যজিতের সঙ্গে উত্তমের অভিনয়ের ব্যাপারে বিরুদ্ধ মত পোষণ করছেন সৌমিত্র।
একদিন দু'জনে হলে গিয়েছেন, নিজেদের 'দেবদাস' দেখতে। ওপেনিং শো। এদিকে উজ্জ্বলা-র সাউন্ড বক্স যাচ্ছেতাই রকম খারাপ। খানিক পরে বিরক্ত হয়ে সৌমিত্র উত্তমের হাঁটুতে চাপড় দিয়ে বললেন, "কী হচ্ছে বলো তো। আমি তো কোনও ডায়লগই বুঝতে পারছি না।" উত্তম মুচকি হেসে বললেন, "আমি তোরটা তবু বুঝতে পারছি। আমারটা একেবারেই পারছি না।" এমনই সম্পর্ক ছিল দু'জনের। সেই সৌমিত্রই একবার উত্তমের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন। কী এমন হয়েছিল সেদিন?
সাতের দশকের কাছাকাছি এসে অভিনেতৃ সংঘ ভেঙে গেল। তৈরি হলো শিল্পী সংসদ। তার নানা কারণ ছিল। অনেক অনেক শিল্পীদের মতো ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন উত্তম এবং সৌমিত্রও। সৌমিত্র আজীবন বামপন্থী চিন্তাধারার মানুষ। তাই অভিনেতৃ সংঘ-র সামনের সারির একজন। অন্যদিকে বিকাশ রায়, উত্তম শিল্পী সংসদের নেতৃস্থানীয়। সেসময় প্রত্যেক বছর বসুশ্রীতে পয়লা বৈশাখের একটা অনুষ্ঠান হতো। অভিনেতারা আসতেন, আড্ডা দিতেন, কোলাকুলি করতেন। কুশল বিনিময় হতো। ভাগাভাগির পরের বছরের ঘটনা। সেবার সৌমিত্রর পৌঁছতে একটু দেরি হয়েছে। অকুস্থলে গিয়ে দেখলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর উত্তম পাশাপাশি বসে গল্প করছেন। দুইজন দুই শিবিরের। তখন দেখা হলেই তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়াঝাঁটি, বাগযুদ্ধ। কিন্তু উত্তম এবং ভানু দিব্য গল্প করছেন। সৌমিত্র এগিয়ে গিয়ে ভানুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। পাশেই 'উত্তমদা'। কিন্তু তাহলে কী হবে, বিরোধী শিবির বলে কথা। হাত ধরে 'শুভ নববর্ষ' বললেন মাত্র। রাগে-দুঃখে উত্তমের মুখ রক্তাভ। একবুক অভিমান নিয়ে সৌমিত্রকে বললেন, "বড় ভাই, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারিস না!" দাদার অভিমানের স্রোতে ভাইয়ের যাবতীয় বিরোধ ভাসিয়ে নিয়ে গেল। লজ্জায়, অনুতাপে উত্তমের পা জড়িয়ে ধরলেন সৌমিত্র, "আমাকে মাপ করে দাও, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।" হাত ধরে টেনে তুলে পুলুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর উত্তমদা।
দু'জনের সম্পর্কের এমন ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। 'টিকটিকি' নাটকটা উত্তমের সঙ্গে করার কথা ভেবেছিলেন। প্রোডিউসার পাননি সৌমিত্র। 'মেয়ে নেই' বলে কেউ টাকা ঢালতে রাজি হননি। অথচ সেই কাজটা বাস্তবায়িত হলে বাংলা ছবির একটা অন্যতম মাইলফলক হয়ে থাকত। যাঁরা উত্তম-সৌমিত্রের ভক্তদের ভাগ করেছেন আপন বেসাতির প্রয়োজনে, লড়িয়ে দিয়েছেন বারবার, তারাই দু'জনের কাজের ক্ষেত্রটিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন বারংবার। আজ 'উত্তমদা' বা তাঁর 'পুলু'— কেউই বেঁচে নেই। আপামরের আড্ডায় তবু তাঁদের ছায়া পড়ে। পথের মোড়ে, চপের দোকানে অথবা চায়ের গুমটিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। ক্যাফে বা রেস্তোরাঁ নয়, পথের ধারে, মোড়ের ওপর এই মহারথীরা বেঁচে রয়েছেন। মোরগ লড়াই লড়িয়ে দিয়ে আড্ডায় উত্তেজনা আসে ঠিকই, সমালোচনাও প্রয়োজন, অস্বীকার করা যায় না। তবে প্রতিযোগিতাটুকুই সব নয়, তার বাইরেও বৃহত্তর এক মানবস্রোত রয়েছে। যেখানে হাজার জটিলতা, হাজার রিরংসা নিয়েও মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয়, সৌহার্দ্য তৈরি হয়। তৈরি হয় হাজারো সংবেদ। ভঙ্গিহীন, চাকচিক্যহীন অথচ অমলিন, উজ্জ্বল- রেস্তোরাঁর ফিসফিস যাদের ছুঁতে পারে না, যুগ যুগ বাঁচুক কল্লোলমুখর সেই সব খোঁড়া বেঞ্চ, তাতে লেগে উত্তম-সৌমিত্রর গন্ধ।