এক কিডনি গ্রাম! তালিবান জমানায় অঙ্গ বিক্রি করেই বাঁচতে হচ্ছে ওদের

One Kidney Village: শুধু খাবার কেনা বা দেনা মেটানোর জন্যে নয়, নিজেদের সন্তানকে যাতে বিক্রি করতে না হয় সেই কারণেও তাঁরা এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান নিয়ে সমস্ত খবর, উত্তেজনা যেন আড়ালে চলে গিয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ইতিমধ্যেই ঘরছাড়া হয়েছেন, চূড়ান্ত কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। রুশ এবং ইউক্রেনের সরকারের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল কয়েক ঘণ্টার, যাতে সাধারণ মানুষেরা যুদ্ধক্ষেত্র, না, বলা উচিত তাঁদের বাসস্থান যাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে, তা ছেড়ে পালাতে পারেন। সারা বিশ্বের নজর টিকে ছিল ইউরোপের এই ভূখণ্ডে। কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু ইউক্রেনের মানুষই যুদ্ধের শিকার হয়ে অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন না। সেই তালিকায় রয়েছে আরও অনেক দেশ, তারই মধ্যে অন্যতম আফগানিস্তান।

তালিবানরা ক্ষমতায় আসার পর দেশটার ওপর চেপেছে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক বাধা নিষেধ। অর্থনীতির অবস্থা ঠেকেছে তলানিতে। তালিবানরা যদিও যুদ্ধ জয়ের এত মাস পরেও বিজয় উৎসব চালিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশের মানুষকে বার্তা দিচ্ছেন যে তাঁরাই আফগানিস্তানের সব সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। কিন্তু আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাটের চিত্র কিন্তু অন্য রকম কথা বলছে। সেই চিত্র ভয়াবহ এবং আতঙ্ক জাগানোর জন্যে যথেষ্ট। কী সেই চিত্র?

হেরাটের একদম লাগোয়া একটি গ্রাম হল সায়শানবা বাজার। সেই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই তালিব-আমেরিকান যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষে কোনও রকমে জীবিত আছেন। সেই গ্রামের একজন হলেন নুরুদ্দিন। তাঁর কোনও জীবিকা নেই, মাথার ওপর অনেক টাকার দেনা এবং নিজের শিশুদের খেতে দিতে পারছেন না। উপায় না পেয়ে নিজের একটা কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু নুরুদ্দিন একা নন, এই গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দা এক পথে হাঁটছেন এবং এমন ভাবেই তাঁদের এই অঙ্গ বিক্রির খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে গ্রামের নাম হয়েছে, 'এক কিডনি গ্রাম', বা One Kidney Village।

আরও পড়ুন- পুজোয় বাড়ে লাশ, মড়া পোড়ানোর গন্ধে যেভাবে কাটে ডোমের দুর্গোৎসব…

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন। তালিবানের 'দয়ায়' প্রায় আড়াই কোটি মানুষ আজ খরার কবলে পরতে চলেছেন, পাঁচ লক্ষ মানুষ হারিয়েছেন জীবিকা নির্বাহের পথ। শুধু খাবার কেনা বা দেনা মেটানোর জন্যে নয়, নিজেদের সন্তানকে যাতে বিক্রি করতে না হয় সেই কারণেও তাঁরা এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

আজিজার কথাই ধরা যাক। ২০ বছর বয়সী আজিজার তিন সন্তান। তিনি বলছেন, তিনি অনেকদিন ধরেই দালালের মাধ্যমে তাঁর একটি কিডনি বিক্রি করার চেষ্টায় আছেন, কিন্তু ক্রেতা পাচ্ছেন না। এইভাবে চলতে থাকলে তাঁকে যে তাঁর এক বছর বয়সী কন্যাকে বিক্রি করে দিতে হবে।

এমনও নয় যে এই ভাবে কিডনি বিক্রি করে তাঁদের বিশেষ লাভ হয়েছে। নুরুদ্দিন এখন আর কোনও কাজ করতে পারেন না, কোনও ভারী বস্তু ওঠাতে তিনি আর সক্ষম নন। এমনকী কিডনি বিক্রি করে খুব বেশি অর্থও তিনি পাননি। তাঁর একটি কিডনি বিক্রি হয়েছে মাত্র দেড় হাজার ডলারে। আগে একটি কিডনি বিক্রি করে পাওয়া যেত প্রায় চার হাজার ডলার। কিন্তু এমন মন্দা এসেছে আফগানদের জীবনে, যে নিজেদের অঙ্গও বিক্রি করে দিতে হচ্ছে, আর দামও খুব বেশি পাচ্ছেন না। এখন নুরুদ্দিনের ভরসা তাঁর বারো বছরের পুত্র। জুতো পালিশ করে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে সে।

কিন্তু এই ভাবে অঙ্গ বিক্রি করা তো বেআইনি? হ্যাঁ, কিন্তু তালিবানের রাজত্বে আইনের শাসন কি আশা করা সম্ভব? কোনওভাবেই নজরদারি করা হয় না এই ধরনের বিষয়ের ওপর এবং দালালরা খুব স্বাধীন ভাবেই নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা ক্রেতা খোঁজেন, সেটা শুধু আফগানিস্তানে সীমাবদ্ধ নয়, পাকিস্তান, এমনকী ভারতেও আফগান কিডনি বিক্রি হচ্ছে।

এই গ্রামের একটি পরিবারের এতটাই ভয়াবহ অবস্থা, যে পাঁচ ভাইকেই তাঁদের কিডনি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ওই পরিবারের একজন গুলাম নবী বলছেন, "আমাদের দেনা আরও বেড়েছে, দারিদ্রে আরও ডুবে যাচ্ছি।" পাঁচ ভাই কিডনি বিক্রি করা সত্ত্বেও তাঁদের রেহাই মিলছে না।

আরও পড়ুন- উলঙ্গ হয়ে ষাঁড় ধরা, ঠোঁট কেটে চাকতি বসানো, অবাক করবে আফ্রিকার আদিবাসীদের যেসব রীতি

অন্যান্য দেশে কিডনি বিক্রি বা দান করলে দাতাকে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়, পর্যাপ্ত খাবার খেতে হয়, এবং সব নিয়ম মেনে চললে তিনি নিয়মিত জীবনে ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু দারিদ্র্য মেটাতে যাঁরা এই কাজ করছেন, তাঁদের জন্য অপারেশন পরবর্তী চিকিৎসাও বিলাসিতা। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা অকেজো হয়ে পড়ছেন। এতটাই খারাপ অবস্থা হচ্ছে যে তাঁরা বেশিরভাগ কাজ করার জন্যই আর সক্ষম থাকছেন না।

পশ্চিমি নেতারা কি শুনছেন? জো বাইডেনের কাছে কি কেউ পৌঁছে দিয়েছে এই খবরগুলো? বা রাষ্ট্রপুজ্ঞের কাছে? সব উন্নত দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইউক্রেনের যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাসিন্দাদের প্রতি, যা অবশ্যই খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু হেরাটের এই মানুষরা? তাদের মর্যাদা কি ইওরোপিয়ানদের কাছে দ্বিতীয় শ্রেণির? পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমে অনেক জায়গাতেই সাংবাদিকদের মুখে শোনা গেছে আকুতি, এরা আফগান বা সিরিয়ার বাসিন্দা নন, এরা ইউরোপিয়ান। তাঁরা ইউরোপিয়ানদের কষ্ট চোখে দেখতে পাচ্ছেননা। কিন্তু সিরিয়া? আফগানিস্তান? অনুন্নত দেশ বলেই কি এমন হওয়া স্বাভাবিক!

More Articles