উলঙ্গ হয়ে ষাঁড় ধরা, ঠোঁট কেটে চাকতি বসানো, অবাক করবে আফ্রিকার আদিবাসীদের যেসব রীতি

African Tribes: শিশুকন্যাদের ঠোঁট ফুটো করে কাঠের টুকরো ঢুকিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ফুটোর আয়তন বাড়তে থাকত এবং সেখানে বড় প্লেট বসানো হয়।

আফ্রিকাকে মানবজাতির আঁতুড়ঘর বললে ভুল হয় না। সেই আদিম কাল থেকে এখনও অবধি মানুষ নিজেকে সভ্য করেছে একটু একটু করেই। কিন্তু কিছু কিছু উপজাতি নিজেদের ‘সভ্য’ করে গড়ে তুলতে একেবারেই নারাজ। তাঁদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি কোনও কিছুরই বদল হয়নি। তাঁদের সেই আদিম কাল থেকে চলে আসা রীতি তথাকথিত 'সভ্য' সমাজের কাছে অনেকসময় নৃশংস এবং ঘৃণ্য ভাবে প্রকাশ পায়।

আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় অবস্থিত ওমো ভ্যালি। তুর্কানা দ্বীপের পূর্বদিকে অবস্থিত ওমো অঞ্চল। বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় পর্যটন স্থান এই উপত্যকা। যে কোনও দেশের আদিম ও প্রাচীন সংস্কৃতির সন্ধান সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সেই দেশে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ আফ্রিকাতে এইসব উপজাতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। আরবোরে, সুরি, কারো, হ্যামার, মুরসি, কনসো ইত্যাদি ইথিওপিয়ার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপজাতি। মূলত ইথিওপিয়ার ওমো ভ্যালিতে এইসব উপজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। নিম্ন ওমো ভ্যালিকে আফ্রিকার সংস্কৃতি ও একাধিক উপজাতি সম্প্রদায়ের অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেকেই ওমোকে মানবজাতির জন্মস্থান বলেও বর্ণনা করেন।

মুরসি ও সুরি উপজাতি

যদি আক্ষরিক অর্থেই কাউকে ঠোঁটকাটা বলতে হয়, তবে সেটা বলতে হবে ইথিওপিয়ান আদিবাসী মুরসি এবং সুরি গোষ্ঠীর মহিলাদের। তাঁদের মতো ঠোঁটকাটা পৃথিবীতে আর দুটো নেই। সিরিয়ালের ছবিতে দেখা হনুমানের বুক চিরে রাম-সীতাকে দেখানোর মতোই মুরসি মেয়েরা নিজেদের নিচের ঠোঁট চিরে চায়ের প্লেট ঢোকায়। ছবিতে নয় কিন্তু, বাস্তবে। ভাবুন একবার!

মুরসি এবং সুরিরা থাকে ইথিওপিয়ার দক্ষিণ ওমো উপত্যকার বনে জঙ্গলে। আফ্রিকার অর্ধ-উলঙ্গ বনচারী আদিবাসী সবাই। কারও গায়ে পশুর ছালের পোশাক, মাথায় পালক, চুলে জবজব করছে লাল মাটি, কারও গা ভরে হরেকরঙা পুঁতির, ধাতুর বা পশুর হাড়ের গয়না, কারও কারও সারা গায়ে-মুখে খড়িমাটি দিয়ে নকশা আঁকা। সুরি আর মুরসি উপজাতির মেয়েদের পনেরো ষোল বছর বয়স হলেই ওদের নিচের ঠোঁট চিরে, কাটা জায়গায় কাঠের টুকরো গুঁজে দেওয়া হয়। পরদিন টুকরোটা বের করে আর একটু বড় সাইজের টুকরো ঢোকানো হয়। তারপর দিন আর একটু বড়। এইভাবে রোজ কাটা ঠোঁটে টান পড়তে পড়তে কাটা অংশের ফাঁকটা বাড়তে থাকে। তখন মাটির গোলাকার চাকতি লাগিয়ে দেওয়া হয় ওইখানে। কয়েকমাস ছাড়া ছাড়া চাকতি বদলানো হয়। একটু বড় চাকতি, তারপর আর একটু বড়। এরকম করে করে ঠোঁটের কাটা অংশ বাড়তে বাড়তে যখন চায়ের প্লেটের সমান সাইজের চাকতি ধারণ করতে সক্ষম হয়, তখন সেইটাই হয়ে যায় স্থায়ী অলংকার। সেই মাটির প্লেটে আবার সাদা কালো-হলুদ দিয়ে নকশা আঁকা থাকে। অত বড় প্লেটের ভারে নরম ঠোঁট উলটে ঝুলে থাকে গলা অবধি। নিচের পাটির দাঁত, মাড়ি সব বেরিয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন- ঋতুমতী কন্যারা ব্রাত্য, কীভাবে নির্বাচন করা হয় কুমারী পুজোর বালিকাদের?

তবে এই অদ্ভুত প্রথার পিছনে আরও একটি তথ্য একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম, ১৯৩৮ সালের এক রিপোর্টের সূত্রে বলা হয়েছে, দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই আজব প্রথা শুরু হয়েছিল। একসময় আরবের ধনী ব্যক্তিরা এই এলাকার নানা গ্রামে এসে মেয়েদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার চালাত। তাঁদের দাস হিসেবে কিনে নিয়ে যেত। এই দাসত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই ঠোঁট কেটে প্লেট বসানোর প্রথা চালু হয়। যাতে মহিলাদের দেখতে খারাপ লাগে। তাঁদের আর কেউ পছন্দ না করে। ওমো উপত্যকার পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও শিশুকন্যাদের ঠোঁট ফুটো করে কাঠের টুকরো ঢুকিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ফুটোর আয়তন বাড়তে থাকত এবং সেখানে বড় প্লেট বসানো হয়।

আবার ওদের ছেলেমেয়ে সকলের হাতে, পিঠে, বুকে, পেটে দেখা যায় অজস্র ক্ষতচিহ্ন। কোনও মারপিট, দুর্ঘটনার ব্যাপার নয়। নিজেদের শরীরে নিজেরা বা অন্য কাউকে দিয়ে কাচের টুকরো বা ছুরির সাহায্যে খুঁচিয়ে এইসব করে। চামড়া ভেদ করে মাংস পর্যন্ত কেটে যায় তাতে। তারপর কাটা জায়গায় গাছের রস, কাঠকয়লার গুঁড়ো দিয়ে ইচ্ছে করে ইনফেকশন বাঁধায়। তাতে হয় কী, ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পরেও কাটা অংশ বরাবর চামড়া ফুলে উঁচু হয়ে থাকে। যে যেমন প্যাটার্নে কাটবে, তেমন নকশা হয় তার শরীরে। সরলরেখায় জ্যামিতিক নকশা, জিলিপির প্যাঁচ, ঢেউ, ফুলছাপ, ডোরাকাটা যা খুশি হতে পারে। কেউ কেউ পাশাপাশি ছোট ছোট ঘা বানিয়ে বুটি বুটি প্যাটার্নও বানায়।

আদিবাসীদের থ্রিডি ট্যাটু বলা যায় একে! কিন্তু ট্যাটু করা হয়তো এর চাইতে ঢের কম যন্ত্রণাদায়ক। সে তো শুধু চামড়ার ওপরের স্তরে খোঁচাখুঁচি। অল্পদিনেই ঘা শুকায়। আর এখানে কমপক্ষে ছ’মাস থেকে এক বছর লেগে যায়। কিন্তু এসব কেন? আদিবাসীদের কথায়, সবই নাকি সৌন্দর্যায়ন। গায়ের ঘা যার যত বেশি, তার যৌন আবেদন তত বেশি! আর ঠোঁটের চাকতি যার যত বড়, সেই মেয়ে তত সুন্দরী, ম্যারেজ মার্কেটে তার মূল্য বেশি। এখানে বিয়েতে কন্যাপণ দেওয়া হয়। মুরসি আর সুরিরা জোয়ার, ভুট্টা চাষ করলেও মূলত পশুপালক। পণ হিসাবে গরু ছাগল দেয় বরের বাড়ি। যে মেয়ের ঠোঁটের চাকতি যত বড়, তার বাবা তত বেশি গরু পাবে মেয়ের বিয়েতে।

হামার উপজাতি

ইথিওপিয়ার আরেকটি জনপ্রিয় উপজাতি হল এই হামাররা। জনসংখ্যায় প্রায় ৪০,০০০ এর কাছাকাছি এই উপজাতি ওমো নদীর তীরে বসবাস করে। প্রধান পেশা গবাদি পশুপালন। আফ্রিকার বন্য উপজাতিদের আচার অনুষ্ঠান একে অপরের থেকে আলাদা। এই জাতির বিশেষত্ব ষাঁড়ের পিঠে দৌড়নো। একজন যুবক পোশাক ছাড়াই এই পশুকে ৪ বার কাবু করলে বিয়ে করার অধিকার পায়। বিয়ের অধিকার পাওয়ার জন্য একজন বর ষাঁড়ের পিঠে উলঙ্গ হয়ে লাফ দেয়।

মেয়েদের ১২ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের দিন মেয়েরা চামড়া এবং ধাতু দিয়ে তৈরি একটি কলার পরে থাকে যা খোলা যায় না। প্রতি রাতে এই উপজাতির মধ্যে একটি অনুষ্ঠান হয় যেখানে একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বেত দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত করে। আশ্চর্যের বিষয়, স্বামী এবং স্ত্রী দু’জনেই সমানভাবে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করে।

শোনা যায়, হামারদের মধ্যে একটি ভয়ানক এবং নৃশংস রীতি হল ‘মিঙ্গেই রীতি’। এই নিয়মের সঙ্গে যুক্ত আছে শিশু হত্যার মতো কাহিনি। বলা হয়, যেসব শিশু জন্মের সময় কিছু দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাদের কোপা নামক এক পবিত্র স্থানে এনে হাত ও পা চামড়ায় জড়িয়ে মুখ এবং কান মাটি, গোবর এবং মাখন দিয়ে আটকে দিয়ে দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করা হয়। এরই নাম মিঙ্গেই। আমার আপনার কাছে এই রীতি বর্বর হলেও আফ্রিকার এই উপজাতিরা বংশপরম্পরায় এই কাজ করে আসছে। বর্তমানে ইথিওপিয়ার সরকার বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই নৃশংস রীতি বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

বদি উপজাতি

আফ্রিকার উপজাতিদের বিচিত্র সাজপোশাক ও জীবনচর্চা বাকি দুনিয়ার কাছে প্রায়ই প্রবল কৌতূহল তৈরি করে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্থূলতা কমাতে জিমে দৌড়চ্ছে, যোগব্যায়াম করছে, ডায়েট করছে। অথচ, এই উপজাতির পুরুষরা ভুঁড়ি বাড়াবার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে থাকে, কারণ তাঁদের গ্রামের বার্ষিক মোটা হওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে পারলেই সারা জীবনের জন্য সে হয় নায়ক। ভুঁড়িই তাঁদের সৌন্দর্যের মাপকাঠি। ইথিওপিয়ার ওমো উপত্যকার এক প্রত্যন্ত কোণে বাস করে আফ্রিকান বদি উপজাতি। এই উপজাতির যুবকরা, সবচেয়ে মোটা পুরুষের শিরোপা পাওয়ার জন্য জানপ্রাণ লড়িয়ে দেয়।

বলা হয়, তাঁদের গ্রামে ‘হিরো’ হতে গেলে, কোনও সাহসিকতার কাজ করতে হয় না। প্রতি বছর নববর্ষের সময়, গ্রামে ‘কায়েল’ উৎসব হয়। তার ছ’মাস আগে থেকে গ্রামের কিছু যুবককে বাছাই করা হয় এই প্রতিযোগিতার জন্য। পরের ছ’মাস তারা নিভৃতবাসে থাকে। তাঁদের বিশেষ খাবার এবং পানীয় দেওয়া হয়। তারপর, কায়েল উৎসবে তাঁরা নিজেদের নতুন মোটা শরীর প্রদর্শন করে। সেই শরীর প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে পারলেই, বাকি জীবনের জন্য গ্রামে নায়কের সম্মান পাওয়া যায়।

কিন্তু মোটা হওয়ার জন্য কী বিশেষ খাবার গ্রহণ করেন তাঁরা? জানা গিয়েছে, গরুর রক্ত ​​এবং দুধ মিশিয়ে এক বিশেষ মিশ্রণ তৈরি করা হয়। সেটি, বাছাই হওয়া যুবকদের নিয়মিত পরিবেশন করেন গ্রামের মহিলারা। এই বিশেষ পানীয়ই তাঁদের বড় পেট বা ভুঁড়ির উৎস। তবে, এই মিশ্রণ তৈরির জন্য কিন্তু কোনও গরুকেই হত্যা করা হয় না। বদি উপজাতির কাছে গরু পবিত্র। তাই, গরুর রক্ত সংগ্রহের জন্য একটি বর্শা বা কুড়ুল দিয়ে গরুর একটি শিরা কেটে রক্ত বের করে নেওয়া হয়। তারপরে, আবার কাদামাটি দিয়ে ওই ক্ষত নিরাময় করে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- বাংলার নিজস্ব সিন্ড্রেলার ক্যাসল রয়েছে এখানে, পুজোর ছুটির ঠিকানা ‘প্রাসাদ গ্রাম’ ধান্যকুড়িয়া

ছ’মাস বাদে প্রতিযোগীরা তাঁদের নিভৃতবাস থেকে বেরিয়ে হেঁটে অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। তারপর তাঁদের শরীরে তাঁরা মাটি এবং ছাই দিয়ে নকশা আঁকে। মহিলারা তাঁদের শরীরে বেঁধে দেন নানারকম রঙিন পাথরের তৈরি অলঙ্কার। এরপর, একটি পবিত্র গাছের চারপাশে বৃত্তাকারে তাঁদের দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ধরে হাঁটতে হয়। অনেকেই, সেই পরিশ্রম সহ্য করতে পারেন না। গ্রামের মহিলারা প্রতিযোগীদের মদ পান করান। তাঁদের ঘাম মুছিয়ে দেন। সবচেয়ে স্থুল ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার পর, গ্রামের প্রবীণরা বিজয়ীর ভবিষ্যত নির্ণয়ের জন্য তার ভুঁড়ি ও রক্ত ​​পরীক্ষা করেন। সবশেষে একটি বড় পবিত্র পাথর দিয়ে একটি গরু জবাই করে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

সাধারণত, কায়েল অনুষ্ঠানের পরে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই খাওয়া কম হওয়ার কারণে এই পুরুষরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। অধিকাংশ প্রতিযোগীরই বিশাল ভুঁড়ি কমে যায়। আর তারপরই, পরের বছরের প্রতিযোগিতার জন্য আবার কয়েকজন পুরুষকে বেছে নেওয়া হয়। তবে, ভুঁড়ি কমে গেলেও কায়েলের বিজয়ীরা সারা জীবনই গ্রামে অনন্য সম্মান পেয়ে থাকেন। তাই, এই উপজাতির পুরুষরা, ছোট থেকেই কায়েল প্রতিযোগিতা জেতার স্বপ্ন দেখতে থাকে। বিয়ের ক্ষেত্রেও ভুঁড়িওয়ালা মোটা পুরুষদেরই কদর বেশি। কাজেই ভুঁড়ি বা ওজন বাড়লে হতাশ হবেন না, বা দুঃখ পাবেন না।

সকল উপজাতির মধ্যেই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে এক তীব্র গর্ব আছে। যাঁর যত বড় ঠোঁটের চাকতি, যাঁর গায়ে যত বেশি ক্ষত, অর্থাৎ কিনা যাঁর শরীরে কষ্ট সহ্য করার চিহ্ন যত বেশি, তাঁদের চোখে তিনি তত বেশি সুন্দর। আবার যে যত বেশি মোটা তাঁর সম্মান তত বেশি। বিপদসঙ্কুল বন্য পরিবেশে যাঁদের বাস, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাঁদের চলতে হয়, তাঁদের জীবনযাপনের সঙ্গে সাহস আর সহ্যশক্তি জড়িয়ে থাকে। তবেই না ভয়ের সঙ্গে, বিপদের সঙ্গে লড়াই করা যাবে।

More Articles