বাঙালিকে প্রথম ‘টুইস্ট’ শেখালেন পঞ্চম দা, আজও হার্টথ্রব রাহুল দেব বর্মন

R D Burman : বাবার ঘরানা থেকে একেবারে বেরিয়ে এলেন পঞ্চম, তৈরি হল আর.ডি যুগ

ষাট সত্তরের দশক। পুজো প্যান্ডেলের বক্সে জোরে জোরে বাজছে, “চোখে চোখে কথা বলো, মুখে কেন বলো না!”। তালে তালে কোমর দোলাচ্ছে তরুণ তরুণীরা। আর অলক্ষ্যে গানের সুরে প্রেমিক প্রেমিকার ‘মন নিয়ে খেলা’ করছেন পঞ্চম দা। তাঁর গানের সুরে দশকের পর দশক বিভোর হয়ে ছিল। এখনও আছে। আজও সেইসব কালজয়ী গানের সুর কানে এলে মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়েন সকলেই। বাজতে থেকে একটার পর একটা রেকর্ড। কখনও সেই সুরের মূর্ছনায় বিভোর হয়ে ‘যেতে যেতে পথে হল দেরি’, কখনও আবার মনে পড়ে যায় চিরাচরিত সেই ‘রুবি রায়’-এর কথা। ইনিই সে যুগে বাঙালির হার্টথ্রব ছিলেন আর ডি বর্মন ওরফে রাহুল দেব বর্মন।

পারিবারিক রাসভারী নাম রাহুল দেব বর্মনের ইতি হয়েছিল অনেক আগেই। এমনকী ঠাকুরমার দেওয়া আদরের ‘টুবলু’ নামও মনে তখন বাড়িতেই সীমাবদ্ধ। পঞ্চম নামেই মুখে মুখে ফিরতেন তিনি সঙ্গীত মহলে। ‘সা রে গা মা’-এর ওই পঞ্চম শুরে ‘পা’-এর প্রতি চিরকেলে আসক্তি ছিল তাঁর। শোনা যায়, পঞ্চম সুরের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখেই অভিনেতা অশোক কুমার তাঁকে নাম দিয়েছিলেন ‘পঞ্চম’। ব্যাস সেই থেকেই কারোর কাছে তিনি পঞ্চম, কারোর কাছে আবার পঞ্চম দা।

আরও পড়ুন - মান্নার কণ্ঠে উত্তমের লিপে বাংলা গানে র‍্যাপের ছাপ! রইল তুমুল জনপ্রিয় সেই গানের ইতিহাস

১৯৩৯ সালের ২৭ জুন কলকাতায় জন্ম সুরকার, গায়ক রাহুলদেব বর্মনের। ছোট থেকেই গানের পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন রাহুল। বাবা শচীন দেব বর্মন সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠিত মুখ। মা মীরা দাশগুপ্তও ছিলেন নামকরা গীতিকার। তাই গান আলাদা করে শিখতে হয়নি কোনও দিনই। বলা ভালো গানের আবহেই তাঁর বিচরণ। মাত্র নয় বছর বয়সে ‘ফ্যান্টুস’ ছবির একটি গানে প্রথম সুর দেন রাহুল। সে ছবি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালে। এরপর ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় ‘ছোটে নবাব’। সেখানেও গান গান রাহুল দেব বর্মন। তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি তাঁর।

৩৬/১ সাউথ এন্ড পার্ক, কলকাতা- ২৯, এই ঠিকানায় তাঁর বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা, গান, খেলাধুলা থেকে শুরু করে যাবতীয় দৌরাত্ম্যের সাক্ষী ছিল এই বাড়িটিই। যদিও জন্ম হয়েছিল হিন্দুস্তান রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে। ছেলের জন্মের এক বছরের মাথাতেই বাড়ি বদল করেন শচীন কর্তা। রাহুলের পড়াশোনা ও গানের পাশাপাশি চলছিল তবলা এবং সরোদের তালিম। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ব্রজেন বিশ্বাস, উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের মতো বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞদের। এছাড়া বাবা মায়ের ছত্রছায়া তো ছিলই।

R D Burman

বাবা শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে আরডি

‘চলতি কা নাম গাড়ি’, ‘কাগজ কে ফুল’, ‘তেরে ঘর কে সামনে’ কিংবা ‘গাইড’-এ শচীনদেবের সহকারি হিসাবে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছিল আরডি’র। তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পথ চলা শুরু হয় ১৯৬৫ সালে। অন্তরঙ্গ বন্ধু অভিনেতা মেহমুদ সাহাব তাঁর হাতে তুলে দেন এ দায়িত্ব। ছবির নাম ‘ভূত বাংলা’। সুরের দায়িত্ব হাতে পেয়েই পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন সুরকার। গতানুগতিক ধারা ভেঙে পশ্চিমী প্রভাবের দিকে ঝুঁকেলেন তিনি। প্রথম কাজেই অভিনব চিন্তাভাবনা নিয়ে অবশ্য প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। সেই সময় এলভিস প্রেসলির দৌলতে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল টুইস্ট নাচ। পঞ্চম ঠিক করলেন তাঁর গানেও রাখবেন সেই টুইস্ট নাচের প্রসঙ্গ। আর তাতেই কোমর দোলাবেন মেহমুদ সাহাব। লিখলেন বিখ্যাত গান “আও টুইস্ট করে”। সুরও দিলেন নিজেই। গাইলেন মান্না দে। কিন্তু গান তো হল, তবে এতে ভয়ানক রেগে গেকে বাবা শচীন দেব বর্মন। ছেলের এমন গান নাকি বাজারে চলবে না, এই মর্মে কথা বলাও বন্ধ করে দিলেন তিনি। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি যে ততদিনে বদলাতে শুরু করে দিয়েছে,সে কথা বাবার বুঝতে খানিক সময় রাখলেও ছেলে রাহুল আগেই বুঝেছিলেন। তাই আত্মবিশ্বাসে ছেদ পড়েনি।

এরপর একে একে আরও আরও পশ্চিমী প্রভাব নিয়ে এলেন তিনি। পশ্চিমী ক্যাবারের অনুকরণে বানালেন ‘আজা আজা ম্যয় হুঁ পেয়্যার তেরা’, ‘ও হাসিনা জুলফোওয়ালি জানে জাঁহা’র ‘ও মেরে সোনা রে সোনা রে’ ও ‘তুমনে মুঝে দেখা’ -এর মতো মতো বিখ্যাত সব গান। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সাফল্যের সেই শুরু। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। অলক্ষ্যে তখন শুরু হয়ে গিয়েছে আর ডির যুগ। অল্প দিনের মধ্যেই বাবা শচীন দেব বর্মনের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করে ফেললেন পঞ্চম।

R D Burman

স্ত্রী আশা ভোঁশলের সঙ্গে জুটিতে রাহুল দেব বর্মণ

পঞ্চম দা মানেই তখন ছবি হিট। মাঝারি মাপের চিত্র নাট্যে এমন সুরের জাদু খেলতেন তিনি, প্রযোজকের ভাগ্য ফিরে যেন সেখানেই। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক দাপিয়ে বেড়িয়েছে সেইসব সুর। এরই মধ্যে ব্যক্তিগত জীবনেও শুরু হয়ে গিয়েছে ওঠা পড়া। রীতা প্যাটেল নামে এক অনুরাগী বিয়ে করেন ১৯৬৬ সালে। বছর পাঁচেকের মধ্যেই সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। যদিও সম্পর্কের রেশ কাটতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও অনেকগুলো বছর। ব্যক্তিগত জীবনের ছবি থেকেই একের পর গান তৈরি করেন পঞ্চম। বিবাহ বিচ্ছেদের বিবাহ-বিচ্ছেদের পরের বছর লিখে ফেললেন ‘পরিচয়’ ছবির জন্য ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’ গানটি। যেন হট কেকের মতো বাজার মাতিয়ে দিল সেই গান। এর পর ১৯৮০ সাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সঙ্গীত শিল্পী আশা ভোঁশলেকে।

আরও পড়ুন - ‘আপনারা আর আমাকে গাইতে বলবেন না’, ধরা গলায় বলেছিলেন মান্না দে

ভারতীয় সংগীতে এক্স ফ্যাক্টর নিয়ে এসেছিলেন রাহুল দেব বর্মন। সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না প্রতিটি আবেগ আর ডি বর্মনের সুরের ছোঁয়ায় হয়ে উঠলো অনবদ্য। দুঃখের, মন কেমন করা গানের সঙ্গে প্রেমে পড়তে শিখিয়েছিলেন আর ডি বর্মণ-ই। শুধু গান লেখা অথবা গানের সুর দেওয়াই নয়, তাঁর গলাও ছিল অনবদ্য। তবলা, ড্রাম, কঙ্গ, পারকাশনে অসাধারণ হাত ছিল তাঁর। অবসর সময়ে আপন মনে মাউথ অর্গ্যানে একের পর এক সুর ভাঁজতেন পঞ্চম। শুধু তাই নয়, হাতের কাছে যা পেতেই তাতেই টুং টাং শব্দের মূর্ছনা তুলতেন তিনি। সোডার ফাঁকা বোতল, খালি গ্লাস ইত্যাদিতে বোল বাজিয়ে অন্যরকম সুর তুলে গানের ভাষায় নিয়ে আসতেন নতুনত্ব। বিভিন্ন ভাষায় সব মিলিয়ে প্রায় ৩৩১টি সিনেমায় সুরকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন পঞ্চম।

ঝুলি ভর্তি অসংখ্য মনিমুক্ত তাঁর। ‘মেরে সামনে বালি খিড়কি মে’, ' দম মারো দম', 'পিয়া তু অব তো আ যা', ‘চুরা লিয়া হ্যায়’, ‘মেহবুবা’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই’ থেকে শুরু করে ‘যেতে যেতে পথে হল দেরি’, ‘আমার মালতীলতা’, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’, ‘ফিরে এলাম দূরে গিয়ে’, ‘ফিরে এসো অনুরাধা’, ‘হায় রে পোড়া বাঁশি’-র মতো একাধিক সুপারহিট গান। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় শেষ হবে! এ হিসেব মেলবার নয়। মেলবার নয় পুরস্কারের হিসাবও।

কিন্তু এমন রূপকথার জীবনে কীসের যেন একটা ঘোর লাগল আকস্মিক। হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন আরডি। ১৯৯৪ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মারা যান তিনি। আজ এত এত আধুনিকতার ভিড়েও অনন্য সেই পঞ্চম দা। সেই সুরে আজও মায়া ধরে। সাউন্ড টেকনোলজির যুগে দাঁড়িয়েও একবাক্যে বলা যায় ইন্ডিয়ান ফিল্ম মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে রাহুল দেব বর্মনের কোনও বিকল্প নেই। তিনি পরবর্তী প্রজন্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তাঁর অমূল্য সব সৃষ্টি। তাই আজ তাঁর মৃত্যুর ২৮ বছর পেরিয়ে এসেও কানে বাজে সেই সুর, এখনও মনে হয় এই বুঝি তিনি এসে দাঁড়াবেন, গাইবেন ‘ফিরে এলাম দূরে গিয়ে’। আর ভারতীয় সঙ্গীত জগৎ মুহূর্তের মধ্যে ফিরে পাবে প্রিয় পঞ্চমদাকে।

More Articles