জ্যান্ত দেহের মাথা কেটে খুন! বাস্তবের 'খোকা' হার মানাবে সিনেমার চরিত্রকেও!

Pagla Murder Case: পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী যখন খোকা অতুলের মাথা কাটাছিল সেই সময় অতুলের দেহে প্রাণ ছিল!

“মালিককে গিয়ে বল খোকা এসেছে।”

সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত দ্বিতীয় পুরুষের অন্যতম বিখ্যাত সংলাপ এটিই। এই ছবিতে খোকা ছিল একজন নৃশংস সিরিয়াল কিলার। কীভাবে সে খুনি হয়ে উঠল, তার আসল পরিচয় কী- যারা সিনেমা দেখেছেন, তারা জানেন। তবে আজকের গল্প কিন্তু পর্দার খোকাকে নিয়ে নয়, বরং বাস্তবের খোকাকে নিয়ে। বাস্তবের খোকার কাহিনি পর্দার থেকেও বেশি নৃশংস, বেশি ভয়াবহ। ‘খোকা’ শব্দটি সাধারণত কোনও ছোট শিশুকে সম্বোধন করার জন্যই ব্যবহার করা হয়। নামটি শুনতে শান্তশিষ্ট এবং নিরীহ মনে হলেও, এই 'খোকা' কিন্তু মোটেই শান্তশিষ্ট বা নিরীহ ছিল না। কলকাতা পুলিশকে এক প্রকার ঘোল খাইয়ে রেখেছিল সে।

১৯৩০-এর দশকের কলকাতা। কলকাতা, বিশেষত উত্তর কলকাতায় আবির্ভাব হয় খোকার। প্রথমে চুরি, তারপরে ডাকাতি এবং তারপর অপরাধের উপরে উঠতে উঠতে খুন। প্রতিবেশীরা তার ভয়ে তটস্থ থাকত। রেকর্ডে অবশ্য খোকা নামে নয়, ‘খ্যাদা’ নামেই উল্লেখ ছিল তার। পুলিশের কাছে খ্যাদা ছিল ‘বিতাড়িত গুন্ডা’। অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য কলকাতায় তার প্রবেশে নিষেধ ছিল। আসলে খোকার দৌরাত্ম্য কমাতে পুলিশ ঠিক করেছিল তাকে কলকাতার বাইরেই রাখা হবে। কলকাতা পুলিশের মনে হয়েছিল এতে খোকার ক্ষমতা কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা মোটেও হয়নি।

কয়েকদিনের মধ্যে ফের একটি খুনের খবর সামনে আসে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, খুনি খোকা। যাকে খুন করা হয়েছে, সে খোকার প্রেমিকা মলিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল। মৃতদেহের জায়গায় জায়গায় কোপানোর চিহ্ন, মুণ্ডু দেহ থেকে আলাদা! খুনটি করে কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যায় খোকা, তার সঙ্গী ছিল কেষ্ট। তবে পালানোর আগে অত্যন্ত বুদ্ধি করে হাওড়া স্টেশনে একজন ছদ্মবেশীকে বসিয়ে গিয়েছিল সে। সেই ছদ্মবেশী খোকার ছদ্মবেশ ধারণ করে হাওড়া স্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। পুলিশ ধন্দে পড়ে যায়, ভুলবশত তাকে গ্রেফতারও করে। পুলিশ যতক্ষণে ভুল বুঝতে পারে, ততক্ষণে তাদের নাগালের বাইরে বেরিয়ে গেছে আসল খোকা। প্রাথমিকভাবে তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে, তাদের রেকর্ডে থাকা খ্যাদা এবং পলাতক আসামী খোকা আসলে একই মানুষ।

আরও পড়ুন- পডকাস্ট শুনেই খুনের সমাধান! ৪০ বছর পুরনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তোলপাড় বিশ্ব

১৯৩৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। কলকাতা কর্পোরেশনের এক সুপারভাইজার এসে শ্যামপুকুর থানায় খুনের রিপোর্ট লেখান। তিনি জানান, তার একজন কর্মী শোভাবাজারের বলরাম মজুমদার স্ট্রিটে এক নালার ধারে একটি মাথাকাটা লাশ খুঁজে পেয়েছে। খবর শুনেই তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে ছোটেন ইন্সপেক্টর রায় এবং ইন্সপেক্টর ঘোষাল। সেখানকার দৃশ্য দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে যায় এই দুই দুঁদে পুলিশ অফিসারের। সেখানে পড়ে রয়েছে একটি মুণ্ডহীন মৃতদেহ, যার তলপেটে ছুরির দু'টি গভীর ক্ষত এবং দু’ পায়ের বেশ কিছু শিরা কাটা। মৃতদেহের মুণ্ডু আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের অবশ্য দাবি, দেহ থেকে মাথা কেটে খোকা সেটি হুগলি নদীতে ফেলে দিয়েছিল। শরীরের বিভিন্ন চিহ্ন দেখে অবশেষে শনাক্ত করা যায় মৃতদেহকে। মৃতের নাম ছিল অতুল ওরফে ‘পাগলা’। সেহেতুই এই খুনের ঘটনাটিকে পুলিশের রেকর্ডে নাম দেওয়া হয় ‘পাগলা মার্ডার কেস’।

ঘটনাচক্রে অতুলের দেহ শনাক্ত করেছিল খোকার প্রণয়ী, মলিনা। বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে সম্পর্কে ছিল খোকা এবং মলিনা। এমতাবস্তায় তাদের সম্পর্কে কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ মেনে নিতে পারেনি খোকা। সত্যিই মলিনা এবং অতুলের মধ্যে কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা, তা জানা যায় না। তবে বলাই বাহুল্য, খোকা দু'জনকে সন্দেহ করত। খোকা রাগের বশে খুন করেছিল অতুলকে। খোকার রাত এতটাই মারাত্মক ছিল যে, অতুলকে খুন করার আধঘণ্টা পর সে আবার আসে অতুলের শিরচ্ছেদ করতে! পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী যখন অতুলের মাথা কাটা হচ্ছিল সেই সময় দেহে প্রাণ ছিল!

আরও পড়ুন- সূচ ফুটিয়ে খুন, অধরা ভাড়াটে খুনি! কলকাতার সেই হত্যাকাণ্ড সাড়া ফেলেছিল পৃথিবীজুড়ে

এই ভয়ঙ্কর খোকাকে ধরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল কলকাতা পুলিশকে। খোকাকে কীভাবে ধরা হয়েছিল, তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলেন তদন্তকারী অফিসার ইন্সপেক্টর পি এন ঘোষাল। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত ক্যালকাটা পুলিশ জার্নালে এর উল্লেখ রয়েছে। কলকাতা পুলিশ খোকাকে গ্রেপ্তার করে দেওঘর থেকে। খোকাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ যে তথ্য জানতে পারে, তাতে হাড় হিম হয়ে যায়। জেরায় খোকা জানিয়েছিল, অতুল পাগলাকে খুন করে তার মুণ্ডু সে নিজেই কেটেছিল। তারপর সেই কাটা মুণ্ডু নিয়ে মলিনার বাড়ি হাজির হয়েছিল সে। মলিনাকে সে দেখাতে চেয়েছিল, তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে পরিণাম কী হতে পারে।

ইন্সপেক্টর ঘোষালের লেখা থেকে জানা যায়, খোকার বিরুদ্ধে সাক্ষী জোগাড় করতে কীরকম নাজেহাল হতে হয়েছিল তাদের। গোটা এলাকা জুড়ে খোকার ত্রাস ছিল। ইন্সপেক্টর ঘোষালের মতে, খোকা একজন সহজাত অপরাধী। খোকা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল মলিনা স্বয়ং। সব মিলিয়ে মোট ৬২ জন সাক্ষী এবং ১৩২ জন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল এই মামলায়। ৩১ জুলাই ১৯৩৭ সালে ফাঁসি হয় খোকার। শোনা যায়, মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছে হিসেবে একটি সুগন্ধির শিশি আর পছন্দের ফুল আনায় সে। তারপর সেগুলি হাতে নিয়েই গলায় ফাঁস পরে সে। পি এন ঘোষালের ভাষায়, "এভাবেই একটি জীবন্ত সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি পান উত্তর কলকাতার লোকেরা।" তবে নৃশংস খুনি হলেও, যৌনকর্মী এবং সমাজের নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের প্রতি নাকি বরাবরই খোকার মনে নরম স্থান ছিল। মলিনাকে সে সত্যিই ভালোবাসত। পলাতক থাকাকালীনও নিয়মিত মলিনার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছে সে। এমনকী মলিনা তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়া সত্ত্বেও নাকি ভালোবাসার টান এতটুকুও কমেনি! কিন্তু মলিনা কি খোকাকে সত্যিই ভালোবাসত? সম্ভব ভালোবাসা? কিছু প্রশ্ন চিরকাল উত্তরহীন...

More Articles