পডকাস্ট শুনেই খুনের সমাধান! ৪০ বছর পুরনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তোলপাড় বিশ্ব
Podcast Murder Mystery: ক্রিস্টোফার ডসনের বর্তমান বয়স ৭৪। সুতরাং বলাই বাহুল্য, তার শেষ জীবন কাটবে কারাগারের পেছনেই
ন্যায় পেতে সময় লাগে। ঠিক কতটা সময়? কাল এবং পাত্র ভেদে তা আলাদা। আজকে যে ঘটনাটির কথা বলব সেখানে ন্যায়বিচার পেতে লেগেছিল ৪০ বছর! তা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারত যদি না একটি পডকাস্ট শো চরম ভাইরাল হতো মানুষের মধ্যে। ১৯৮২ সালে খুন হন লিনেট ডসন। খুনটি করেছিলেন তার স্বামী ক্রিস্টোফার ডসন। তখন ছাড়া পেয়ে গেলেও ২০১৮ সালে ফের ধুলো ঝেড়ে খুলে বসা হয় কেসটি। যেভাবে পুনর্তদন্ত শুরু হয় এবং তার পরে যা হয়, তা দৃষ্টান্তমূলক এক ঘটনা।
তবে শুরুটা করা যাক শুরু থেকেই। ১৯৮২ সালের এক জানুয়ারির সকালে তিন কন্যাকে রেখে হঠাৎ করে ‘গায়েব’ হয়ে যান সিডনির বাসিন্দা লিনেট ডসন। তার স্বামী ক্রিস্টোফার ডসন স্থানীয় স্কুলের ফিজিক্যাল এডুকেশন শিক্ষক। ক্রিস্টোফার থানায় অভিযোগ দায়ের করেন, লিনেট নিজের প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছেন। বেশ কয়েক মাস তদন্ত করার পরেও পুলিশ যখন লিনেটের কোনও খোঁজ পায় না, তখন মামলাটিকে কার্যত শীতঘুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লিনেটের পরিবারের তরফে দাবি করা হয়, লিনেটকে খুন করেছে ক্রিস্টোফার এবং দেহ কোথাও লোপাট করে দিয়েছে। কিন্তু সেই ১৯৮২ সালে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় ক্রিস ডসনকে বেকসুর খালাস করে দেয় পুলিশ। অনেকের মতে, পুলিশের তদন্তেও অনেক খামতি ছিল।
The Teacher's Pet
কথায় আছে, পুরনো ‘পাপ’ ফিরে আসে। এক্ষেত্রেও হলো তাই। ২০১৮ সালে রিলিজ করল ‘The Teacher's Pet’ নামক একটি পডকাস্ট সিরিজ। সেই সিরিজে এই লিনেট ডসনের গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে একটি পডকাস্ট প্রচারিত হয়। একটা আস্ত মানুষ এরকম দিনে-দুপুরে গায়েব হয়ে গেল, বিগত ৩৬ বছরে তার কোনও খোঁজ মিলল না! সিডনির ওই এলাকাটি মোটেই ঘন জনবসতিপূর্ণ নয়। ফলত সবাই সবার মুখ চেনে। সুতরাং নতুন কোনও মানুষ এসে লিনেটকে গায়েব করে দেবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তা সত্ত্বেও কেন খুঁজে পাওয়া গেল না লিনেটকে, এই নিয়েই শুরু হয় পডকাস্ট। গ্রেট ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা-সহ অন্যান্য দেশের বিপুল জনপ্রিয়তা পেতে থাকে এই পডকাস্টটি। প্রায় ছয় কোটির বেশি মানুষ ডাউনলোড করে শুনেছিলেন সেটি। ফলত, প্রায় ভুলতে বসা ঘটনাটি আবার মানুষের মনে ফিরে আসে। লিনেটের দাদা আদালতের কাছে আবেদন করেন মামলাটি ফের তদন্তের। একপ্রকার জনগণের চাহিদার চাপে পড়েই পুনর্তদন্তে বাধ্য হয় পুলিশ।
আরও পড়ুন- রেসকোর্স থেকে জ্যোতিষ চেম্বার! কলকাতা পুলিশের রহস্যভেদ হার মানাবে ওয়েব সিরিজকেও!
তদন্ত করতে গিয়ে উঠে এল এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। লিনেটের সঙ্গে বিবাহিত থাকাকালীনই পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন ক্রিস্টোফার। সিডনি জেটস রাগবি দলের প্রাক্তন খেলোয়াড় ক্রিস্টোফার স্থানীয় এক স্কুলের পিটি টিচার ছিলেন, আগেই বলেছি। সেই সুবাদেই তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক ছাত্রীর সঙ্গে। তদন্তের খাতিরে নাম পালটে, ছাত্রীটির নাম বলা হয়েছে জেসি। বছর চল্লিশের ক্রিস্টোফার যখন বছর ষোলোর তরুণী জেসির সঙ্গে সম্পর্ক জড়ান, তারা জানতেন না সম্পর্কের পরিণতি কী হবে। ১৯৮০-৮১ সাল নাগাদ থেকেই লিনেট লক্ষ্য করতে শুরু করেন, পরিবারে আর্থিক অসঙ্গতি দেখা দিচ্ছে। টাকা রোজগার হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোথায় খরচা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। ফলত নিজেই তদন্ত করতে নেমে পড়েন লিনেট এবং ধরে ফেলেন স্বামীর পরকীয়ার কেচ্ছা। এরপরই ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে গায়েব হয়ে যান লিনেট। এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে পুলিশি জেরায় ক্রিস্টোফার জানিয়েছিলেন, সেই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তার কাছে লিনেটের একটি ফোন আসে। ফোনে লিনেট তাকে জানিয়েছিলেন, তিনি তার প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে এসেছেন। তিনি যেন এবার জেসির সঙ্গে নতুন করে জীবন শুরু করেন।
আরও পড়ুন- কলকাতা ভোলেনি বন্দরের ‘গ্যাংযুদ্ধ’! সেকালের হত্যাকাণ্ডের সমাধানে ঘুম উড়েছিল পুলিশের
কিন্তু এই দাবির প্রেক্ষিতে পাকাপোক্ত প্রমাণ দিতে পারেননি ক্রিস ডসন। কিন্তু এরপর তিনি যা করেন, তা এক প্রকার নিজের পায়েই কুড়ুল মারার মতো। একের পর এক পরস্পর বিরোধী বয়ান দিতে শুরু করেন তিনি। একবার তিনি বলেন, লিনেট স্বেচ্ছায় প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেছেন, আরেকবার তিনি বলেন, লিনেটের বাড়ির লোকজনই তাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। ক্রিস্টোফারের সেই সময়কার প্রতিবেশীরা জানান, ক্রিস্টোফার তাদের বলেছেন লিনেট বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৮২ সালের পুলিশের নথিতে দেখা যায়, ক্রিস্টোফার লিখিয়েছেন তার স্ত্রীকে কয়েকজন আততায়ী তুলে নিয়ে গিয়েছে। অবাক করার বিষয়, কেন সেই সময়কার তদন্তকারীরা এই দিকগুলি খতিয়ে দেখেননি! এইসব তথ্যের ভিত্তিতে এতটুকু তো পরিষ্কার হয়েই যায় যে লিনেটকে হয় নিজের হাতে খুন করেছেন ক্রিস, নয় ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে খুন করিয়েছেন।
তবে পাবলিক প্রসিকিউটারের এই যুক্তির বিরুদ্ধে ক্রিস্টোফারের আইনজীবী জানিয়েছেন, বয়সজনিত কারণে তিনি কোনও ঘটনাই সঠিকভাবে মনে রাখতে পারেন না। এই কারণেই তার বয়ানে অসঙ্গতি ধরা পড়ছে। তিনি কোনওভাবেই খুনের সঙ্গে যুক্ত নন। যদিও ডিফেন্স কাউন্সিলের এই যুক্তি ধোপে টেকেনি। এই বছর ৩০ অগাস্ট, জাস্টিস ইয়ান হ্যারিসন এই মামলায় রায় ঘোষণা করেন। রায় দান করতে গিয়ে তিনি বলেন, “এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ১৯৮২ সালের ৮ জানুয়ারি লিনেট জনসন খুন হন। লিনেটের স্বামী ক্রিস্টোফার যা দাবি করছেন তো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মনগড়া।” যেহেতু এই মামলায় দোষী হওয়া সত্ত্বেও ক্রিস্টোফার দোষ স্বীকার (not pleaded guilty) করেননি, তাই তার ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। তবে তিনি ১৮ বছরের আগে প্যারোলের জন্য আবেদনও করতে পারবেন না। ক্রিস্টোফার ডসনের বর্তমান বয়স ৭৪। সুতরাং বলাই বাহুল্য, তার শেষ জীবন কাটবে কারাগারের পেছনেই।