সূচ ফুটিয়ে খুন, অধরা ভাড়াটে খুনি! কলকাতার সেই হত্যাকাণ্ড সাড়া ফেলেছিল পৃথিবীজুড়ে
Amarendrachandra Pandey: হঠাৎ করেই গায়ে শালমোড়ানো এক ব্যক্তির সঙ্গে ধাক্কা লাগে অমরেন্দ্রর। তৎক্ষণাৎ হাতে সূচ ফোটার মতো একটা অনুভূতি হয় তাঁর।
১৯৩৩। ইংল্যান্ড অ্যাশেজ জিততে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বডি লাইন বোলিং করছে, হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হয়েছেন, চৌধুরী রহমত আলি খান ‘পাকিস্তান’ নামক আরেকটি দেশ বানানোর দাবি প্রথম পেশ করেছেন- এই এতগুলি ঐতিহাসিক ঘটনা সত্ত্বেও সেই সময়ে সারা বিশ্বের তাবড় তাবড় সংবাদপত্রের হেডলাইন দখল করেছিল কলকাতার একটি মার্ডার কেস। কলকাতার এক জমিদারকে হত্যা করা হয়েছে। কত হত্যাই হয়ে থাকে, কিন্তু এই হত্যায় কী এমন ছিল, যা গোটা বিশ্বের নজর কলকাতার দিকে ঘুরিয়ে দেয়? আসলে অভিনব এই খুনে ব্যবহার করা হয়েছিল বায়োলজিক্যাল অস্ত্র। এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে খুন ভারতে এর আগে কক্ষনও দেখা যায়নি। ১৯৩৩, অর্থাৎ দু'টি বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়ে সারা বিশ্বে বায়োলজিক্যাল অস্ত্র নিয়ে মানুষ আলোচনা করছেন। এর ব্যবহার কতটা বিনাশকারী হতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। বলাই বাহুল্য, এহেন সময় এই খুন কেন নজর কেড়েছিল গোটা বিশ্বের।
১৯৩৩ সালের ২৬ নভেম্বর, কনকনে ঠান্ডায় ঘুম ভেঙেছে কলকাতার। ভোরবেলা হাওড়া রেলস্টেশন দিয়ে হেঁটে চলেছে এক বছর কুড়ির যুবক। এই যুবক যে-সে কেউ নয়, পাকুড়ের ভাবী জমিদার অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডে। পাকুড় বর্তমানে ঝাড়খণ্ডে পড়লেও সেই সময়ে তা বাংলা প্রভিন্স-এর অন্তর্গত ছিল। বাড়ি যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠছিলেন অমরেন্দ্র। তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর অন্যান্য ভাই এবং বোনেরা।
হঠাৎ করেই গায়ে শালমোড়ানো এক ব্যক্তির সঙ্গে ধাক্কা লাগে অমরেন্দ্রর। তৎক্ষণাৎ হাতে সূচ ফোটার মতো একটা অনুভূতি হয় তাঁর। তাকিয়ে দেখা যায়, হাতে ফুসকুড়ির সাইজের একটি ফুটো। লেগে রয়েছে দু'-ফোঁটা রক্ত। ওই দেখে অমরেন্দ্রর বোন বনবালা তৎক্ষণাৎ ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেয়। বাদ সাধে সৎ ভাই বিনয়েন্দ্র। সে বলে, এতটা পর্যন্ত যখন চলেই আসা গেছে, তখন নাহয় পাকুড়ে গিয়েই চিকিৎসা করা যাবে।
আরও পড়ুন: নিষিদ্ধপল্লিতে পরের পর হত্যা, কলকাতার ত্রাস হয়ে উঠেছিল এই নারী
কিন্তু ট্রেনে উঠতেই ক্রমশ শরীর খারাপ হতে শুরু করে অমরেন্দ্রর। পাকুড় পৌঁছতে পৌঁছতে অবস্থা আরও কাহিল হয়ে যায়। পাকুড়ে পৌঁছনোর আগেই আবার ফিরে আসতে হয় কলকাতায়। সেই সময়ে কলকাতার সবচেয়ে বড় ডাক্তার ছিলেন নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্ত। ঘা দেখেই নলিনীরঞ্জনের সন্দেহ হয়, তিনি সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দেন রক্ত পরীক্ষা করানোর। ক্রমে হাত ফুলে যেতে থাকে অমরেন্দ্রর, জ্বর পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে, রক্তবমি হওয়া শুরু হয়। ড. নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্ত পরিবারকে জানিয়ে দেন, অমরেন্দ্রকে বাঁচানো মুশকিল হবে।
গোটা জমিদার পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কেননা, অমরেন্দ্র ছিল তাদের ভাবী জমিদার। অমরেন্দ্রর বিয়েও হয়নি তখনও, সুতরাং সন্তানের কোনও সম্ভাবনা নেই। পরবর্তী উত্তরাধিকারী কে হবে, সেই চিন্তা ভাবাচ্ছিল সকলকে। এই সময়ে মুশকিল আসান হয়ে এলো বিনয়েন্দ্র। সে এক ডাক্তারকে ধরে নিয়ে আসে। সেই ডাক্তার আশ্বস্ত করল, সুস্থ হয়ে উঠবে অমরেন্দ্র। ডাক্তারবাবু এই ঘোষণা করার পরের দিনই কোমায় চলে যান অমরেন্দ্র এবং কয়েকদিন পর ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন পাকুড়ের তরুণ জমিদার। সারা পরিবারে কান্নার রোল ওঠে, পরিবারের বড় ছেলে, এস্টেটের জমিদার মারা গেছে। কাঁদছিলেন এস্টেটের বড়কুমার বিনয়েন্দ্রও, তবে একই সঙ্গে ভাইয়ের শেষকৃত্যের ব্যবস্থাও করছিলেন। যেন একটু তাড়াতাড়িই সেসব বন্দোবস্ত করছিলেন তিনি। মারা যাওয়ার মাত্র দু'ঘণ্টার মধ্যেই তিনি অমরেন্দ্রর ডেথ সার্টিফিকেট বের করিয়ে নেন ডাক্তারকে দিয়ে।
অমরেন্দ্র যখন নেই, এবার পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে পড়ে রইল বিনয়েন্দ্র। যথারীতি সেইই হলো পাকুড়ের ভাবী জমিদার।
গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেত, যদি না ড. নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্তর নির্দেশমতো অমরেন্দ্রর রক্ত পরীক্ষা করানো হত। পরীক্ষার রিপোর্ট আসতেই চক্ষু চড়কগাছ প্যাথোলজিস্টের। পরীক্ষায় দেখা গেল, অমরেন্দ্রর রক্তে রয়েছে এসিনিয়া পেস্টিস। এই রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট সম্বন্ধে পান্ডে পরিবারকে জানানোর আগে খবর পৌঁছে গেল ব্রিটিশ সরকারের কাছে। কেন? কেননা, এটিই সেই ব্যাকটেরিয়া, যার কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষভাগে ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল বিউবনিক প্লেগ!
অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডে
১৮৯৫-'৯৬ সাল নাগাদ উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর নরক বানিয়ে দিয়েছিল প্লেগ মহামারী। কলকাতায় সেরকমভাবে প্রভাব ফেলতে না পারলেও সরকার এই রোগকে অতি সংবেদনশীল রোগের তালিকায় রেখেছিল। ফলত, প্লেগের জীবাণু পাওয়া যেতেই সত্বর সরকারকে খবর দেওয়ার নির্দেশ ছিল। খবর পাওয়ার পর অতি দ্রুত একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্রিটিশ সরকার। সারা শহরে খোঁজা শুরু হয়, কারও প্লেগ হয়েছে কিনা। যখন দেখা গেল, শহরে কোথাও প্লেগ হয়নি, তখন সকলেরই সন্দেহ হলো, অমরেন্দ্রর মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, খুন।
পান্ডে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে যখন কলকাতা পুলিশ জানতে পারে সূচ ফোটানোর ব্যাপারটা, তারা মনে করে, সেই সূচের মাধ্যমেই এই ব্যাকটেরিয়া অমরেন্দ্র শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে। সেই সময় শরৎচন্দ্র মিত্রর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বেঙ্গল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। শরৎবাবুর কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, কীভাবে এই ব্যাকটেরিয়া কলকাতায় এলো। প্লেগের ব্যাকটেরিয়া তো শুধুমাত্র রাখা রয়েছে বম্বে-র হ্যাফকিন্স ইনস্টিটিউশনে। তাও অত্যন্ত কড়া পাহারায়। তা সত্ত্বেও এই ব্যাকটেরিয়া কীভাবে কলকাতায় এল, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না তদন্তকারীরা। এমতাবস্থায় অমরেন্দ্রর বোন তাদের জানায়, তার সন্দেহ রয়েছে বিনয়েন্দ্রর ওপর। তার দাবি, সেই-ই প্রথমে দাদার চিকিৎসা করাতে দেয়নি এবং দাদা মরলে সবচেয়ে লাভবান তো বিনয়েন্দ্রই। ফলত বিনয়েন্দ্রর ওপর নজর রাখা শুরু করে কলকাতা পুলিশ। এই খবর কানে যেতেই একটি মারাত্মক ভুল করে বসে সে।
যখন বিনয়েন্দ্র জানতে পারে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হচ্ছে, জমিদারি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে সে। আসানসোল থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। পুলিশ এতটুকু বুঝে যায় যে, অমরেন্দ্র হত্যায় অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী বিনয়েন্দ্র। একই সঙ্গে তারানাথ ভট্টাচার্য নামে তার ঘনিষ্ঠ এক ডাক্তারকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। এই ডাক্তারই এসে বলেছিল, শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে অমরেন্দ্র। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, তারানাথ কয়েকদিন আগে বম্বে গিয়েছিল বিশেষ একটি কাজে। ব্যস! ‘দুধ কা দুধ, পানি কা পানি’ হয়ে যায় তাদের জন্য।
বছরদুয়েক আগে, ১৮ বছরের জন্মদিনে যখন অমরেন্দ্রকে ভাবী জমিদার ঘোষণা করা হয়, তখন থেকেই সৎ ভাইকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটতে থাকে বিনয়েন্দ্র। আসলে পাকুড় এস্টেটের বড়কুমার বিনয়েন্দ্রচন্দ্র পান্ডে ছিল মহালম্পট। সুরা, নারী, মাদক, জুয়া- কীসে আসক্ত ছিল না সে! এই কারণে অনেক অর্থদণ্ড-ও গিয়েছিল পাকুড় এস্টেটের। ফলত, এস্টেটের ছোটকুমার অমরেন্দ্রকে এই পরবর্তী জমিদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরিবারের তরফে। জেরায় বিনয়েন্দ্র জানিয়েছিল, সে অমরেন্দ্রকে এর আগেও একবার টিটেনাসের জীবাণু দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিফল হওয়ায় এবার সে ঠিক করে, প্লেগের জীবাণু দিয়ে তাকে হত্যা করবে। এর জন্যই সে বম্বে পাঠায় তারানাথকে। হ্যাফকিন্স ইনস্টিটিউশনের কয়েকজন ডাক্তারকে পয়সা খাইয়ে হাত করে তারানাথ। তাদের থেকেই প্লেগের জীবাণু পায় সে। তারাই তারানাথকে সুযোগ করে দেয় ল্যাবে ইঁদুরের ওপর এই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করার। ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা সফল হলে ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কলকাতা চলে আসে তারানাথ। বিনয়েন্দ্রর হাতে অস্ত্র চলে আসে, এবং সে অমরেন্দ্রকে খুন করার প্ল্যান বানায়। তারানাথের সাহায্যেই এক কন্ট্রাক্ট কিলার খুঁজে বের করে সে এবং ২৬ নভেম্বর, ১৯৩৩ নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সফল হয় তারা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই কন্ট্রাক্ট কিলার কে ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর বহু চেষ্টার পরেও খুঁজে পায়নি কলকাতা পুলিশ বা বেঙ্গল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস-এর কেউই। বিচারে ফাঁসির সাজা হয় বিনয়েন্দ্র এবং তারানাথ ভট্টাচার্যর। অবশ্য পরবর্তীকালে সেই সাজা পরিবর্তিত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায়। আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাদের, তবে ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাড়া পেয়ে যায় তারা। ততদিনে অবশ্য বিনয়েন্দ্র একজন বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছে। জানা যায় বাড়ি ফেরার কয়েক মাস পর নিজের মাথায় নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করে সে। তারানাথ ভট্টাচার্যের খবর এর পরে আর পাওয়া যায়নি। যেহেতু এটি একটি বায়োক্রাইম ছিল, তাই এই মামলা শোরগোল ফেলেছিল সারা বিশ্বে। এর প্রভাব এতটাই ছিল যে এই খুনের ডিটেল রিপোর্ট করতে সেই বছরই ডিসেম্বরে টাইমস ম্যাগাজিন থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন কলকাতায়। এরপর ১৯৩৪ সালে টাইমস ম্যাগাজিনে ‘Murder With Germs’ এই শীর্ষক-সহ এই মার্ডার কেসের বিস্তারিত বিবরণ বেরোয়। সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয় সংবাদপত্র, 'স্টেটস টাইমস' এই ঘটনাকে আখ্যা দেয় ‘Punctured Arm Mystery’ বলে। তবে এতসব সত্ত্বেও অধরা থেকে গিয়েছিল আসল কন্ট্রাক্ট কিলার। শোনা যায়, এই কন্ট্রাক্ট কিলারের থেকেই প্রভাবিত হয়ে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন ব্যোমকেশ সিরিজের জনপ্রিয় গল্প ‘শজারুর কাঁটা’।
এবার চলে আসা যাক পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। বেশ কিছু দশক পরের ঘটনা। ১৯৭৮ সাল, লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বুলগেরিয়ার এক সাংবাদিক। কমিউনিস্ট-বিরোধী এই সাংবাদিক সেই সময়ে দেশত্যাগী। হঠাৎ এক পথচারীর ছাতার খোঁচা লাগল তাঁর পায়ে। খানিক পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অবশেষে তিনদিন পরে তিনি মারা যান। চিকিৎসকরা জানান, শরীরে রাইজিন প্রবেশ করায় এই লেখকের মৃত্যু হয়েছে। কমিউনিস্ট-বিরোধিতার মাশুল তাকে নিজের প্রাণ দিয়ে দিতে হল। মনে করা হয়, এই হত্যার পিছনে হাত ছিল কেজিবি-র। কিন্তু পদ্ধতিটা? সেই বিনয়েন্দ্র-তারানাথের অবলম্বন করা পন্থা। তাহলে কি কেজিবির এই গুপ্ত এজেন্টদের পথ দেখিয়েছিলেন পাকুড়ের ওই দুই লম্পট?