স্ট্রিপ ক্লাবের সাফল্য পেতে করিয়েছেন খুনও, এই ব্যক্তির কাহিনি জানলে চমকে উঠবেনই

Steve Banarjee : মার্কিনী মহিলাদের ক্লাবে চালু করেন পুরুষদের স্ট্রিপটিজ

বাহারি আলোর রোশনাই, সঙ্গে হালকা ওয়েস্টার্ন ব্লুজ। তালে তালে নাচছেন পুরুষেরা। যে সে নাচ নয়, নাচছেন স্ট্রিপটিজ। তার সঙ্গে সমান তালে চলছে পানীয়ের ফোয়ারাও। আর তাতেই বুঁদ হয়ে আছেন বাকিরা। অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। ঘোর লাগাটাই দস্তুর!

সময়টা ১৯৭৯ সাল। মার্কিন মুলুকে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করলেন এক বাঙালি। দিনের আলোটুকু পড়ে এলেই তাঁর জাদু শুরু। ভাবা যায়, এ দেশে বাঙালি শুনলে নাক কুঁচকে তাকাতো যে জাতি, তাদেরই কিনা একেবারে নাচিয়ে ছাড়তেন একজন বাঙালি! আসল নাম সোমেন ব্যানার্জি। জন্ম হয় ভারতের মুম্বই শহরে। জন্ম এখানে হলেও জীবন কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই। ১৯৬০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পাড়ি দেন আমেরিকায়। দেশ বদলের পাশাপাশি নামখানাও বদলে ফেলেন তিনি। সম্বল বলতে থেকে যায় শুধু পদবীটিই। নতুন নাম নেন স্টিভ ব্যানার্জি।

ও দেশে পৌঁছে ম্যাটেলে কাজ করার পাশাপাশি গ্যাস স্টেশনের কাজেও যোগ দেন সোমেন স্টিভ ব্যানার্জি। তুখড় ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল স্টিভের। বুঝতে পেরেছিলেন মায়াময় এ শহরের আসল টিকিটা রয়েছে নাচ-গানের উদ্দামতায় হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেই। নিজেও মাঝে মাঝে যেতেন সেসব জায়গায়। একদিন এরকমই একটি ক্লাবে গিয়ে জানতে পারেন সেই ক্লাবের লোকসানে চলার কথাটি। তখনই ঠিক করেন এই লোকসানে চলা ক্লাবটিই কিনবেন তিনি। নিজের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল স্টিভের। তিনি জানতেন কীভাবে চাকা ঘোরাতে হয়! ১৯৭০ সাল থেকে রাউন্ড রবিন নামে লস অ্যাঞ্জেলসের ওই ক্লাবটির হাত ধরেই ১৯৭০ সাল থেকে স্টিভ ব্যানার্জির।

আরও পড়ুন : রক্তাক্ত মুঘল ইতিহাসেও ভালবাসার ছোঁয়া! ‘উড়ন্ত তারাদের ছায়া’ দর্শককে মুড়ে রাখে মায়ায়

আধুনিকতার মোড়কে আমূল বদলে ফেলেন ক্লাবের খোলনলচে। নিত্যদিন নানারকম নয়া মিশেল আনতে শুরু করেন ক্লাবে। এভাবেই আরও নয় বছর চলার পর ১৯৭৯ সালে স্টিভ ব্যানার্জি তৈরি করলেন প্রথম পুরুষ স্ট্রিপ ড্যান্সারদের ট্রুপ। ব্যাস রাতারাতি বদলে গেল সবকিছু। সামান্য এক বাঙালির হাতেই কিনা বদলে গেল লোকসানে চলা একটা বারের ভাগ্য!ব্যবসায়িক সাফল্যও এল চমৎকার।

কিন্তু কী এই স্ট্রিপ নাচ? কিই বা হয় স্ট্রিপ ক্লাবে? গানের তালে তালে একটু একটু করে পোশাক খুলে ফেলে যৌন উত্তেজক নাচকেই এক কথায় বলে স্ট্রিপ ড্যান্স। আর যে ক্লাবে স্ট্রিপটিজ বা অন্য কোনও যৌন উত্তেজক নাচ দেখানো হয় সেটাই হল স্ট্রিপ ক্লাব। আদ্যোপান্ত নৈশ ক্লাব এটি। দিনের বেলা দরজা খোলা থাকে না স্ট্রিপ ক্লাবের। অফুরন্ত মাদকের জোগান মেলে এসব জায়গায়। আদপে যাকে বলে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জায়গা। স্বভাবে তাই নাইট ক্লাব এবং ডান্স বার-এর সঙ্গে মিল রয়েছে স্ট্রিপ ক্লাবের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফসল এই স্ট্রিপ ক্লাব। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের চিত্রটার দিকে তাকালে আঁচ করা যায় এর জন্ম বৃত্তান্ত। বিশ্ব জুড়ে তখন দারিদ্রের ছবিটা ভয়ংকর। আর এর জেরেই পথে নামতে হয় মেয়েদের। তখন গণিকাবৃত্তিকেই সম্বল করেন অনেকে। সামান্য অর্থ উপার্জনের আশায় নাইট ক্লাবের নাচিয়ের দলে নাম লেখায় তারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রাথমিকভাবে আমেরিকাতেই শুরু হয় স্ট্রিপ ক্লাবের রমরমা।তারপর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতেই।

মূলত তিন ধরনের স্ট্রিপটিজ নাচের চল ছিল সেসময়ে। এক, নাচের শেষে পুরো পোশাক খুলে ফেলে নাচিয়ে। দুই, শুধুমাত্র তার উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত করে। আর তিন, নাচের শেষে কেবল বিকিনি পরে ধরা দে মঞ্চে। মঞ্চ বলতে একটা বড় স্টেজ। আর তাকে ঘিরেই থাকে বসার জায়গা। ১৯৪০ সালে এশিয়ায় উৎসাহীদের জন্য দরজা খুলে দেয় স্ট্রিপ ক্লাব। এর দশ বছর পর ইওরোপেও শুরু হয় স্ট্রিপের জয়যাত্রা। একটা দুটো করে ক্রমেই সংখ্যাটা বাড়তে থাকে ক্লাবের। শুধু মেয়েরাই নয়, স্ট্রিপ নাচে সামিল হন পুরুষেরাও।

তবে মহিলাদের নগ্ন করে যতটা সোজা, পুরুষদের ক্ষেত্রে তা মোটেই নয়। সমাজ যে চিরকালই পুরুষতান্ত্রিক। সে বাংলাই হোক অথবা মার্কিন মুলুক। কিন্তু এই অসাধ্য সাধনটিই করে দেখিয়েছিলেন স্টিভ ব্যানার্জি। তাও আবার আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগে। মার্কিন পুরুষদের প্রায় নগ্ন নাচিয়েছিলেন তিনিই। যৌন বিনোদনের সুযোগ যে মহিলাদেরও রয়েছে সেটাই করে দেখালেন স্টিভ। পল স্নাইডার নামে এক প্রোমোটারের পরামর্শে মার্কিনী মহিলাদের ক্লাবে চালু করলেন পুরুষদের স্ট্রিপটিজ। ক্লাবের নাম বদলে রাখলেন চিপেনডেলস। ভাবা যায়, একজন স্বল্পাবৃত পুরুষ স্ট্রিপ ড্যান্সার নাকি সুরা ঢেলে দিচ্ছেন মহিলা দর্শকদের গ্লাসে, ধরিয়ে দিচ্ছেন সিগারেটও! এমনটাই রোজনামচা সে দেশে। আর একে কেন্দ্র করেই ১৯৮০ সাল নাগাদ প্রতি মাসে প্রায় ১৫ হাজার খদ্দেরের ভিড়, যার সবটাই সামলাচ্ছেন একজন বাঙালি। আর এদিকে কিনা এখনও গণিকা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় বাঙালি! কেবল মেয়ে বলেই কয়েক ধাপ পিছিয়ে দেয় তাদের, দোষও জোটে তাদের বরাতেই।

অবশ্য বাঙালির এই নাচানোর গল্প যে গর্বের, তা বলা যায় না। সাফল্যের শুরুতেই হয় ছন্দপতন। ১৯৭৯ সালেই 'অশালীন' কাজের দায়ে ৩ জন নাচিয়ে এবং ৩ জন খদ্দেরকে গ্রেফতার করা হয় ক্লাব থেকে। এছাড়াও এই ক্লাবের গন্ধে গন্ধে বাজারে গজিয়ে উঠতে থাকে এহেন আরও কিছু নৈশ ক্লাব।তবে স্টিভ ব্যানার্জি ছিলেন মরিয়া। সাফল্য পেতে তাই লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ থেকে খুন, কোনওকিছুই বাকি রাখেননি তিনি। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, টানা দশ বছর একের পর এক প্রতিযোগী ক্লাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যান স্টিভ। বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভাড়া করেন লোক। এমনকী খুন করতে হিটম্যানদেরও নিযুক্ত করেন তিনি।

আরও পড়ুন : চোর না পতিতা? ‘ছিনাল’ শব্দের আসল মানে রয়ে গেছে আড়ালেই

এখানেই শেষ নয়, এরপরই ঘটে হাড়হিম করা চিপেনডেলস খুনের ঘটনাটি। বাজারে তখন জনপ্রিয় কোরিওগ্রাফার নিক ডে নোইয়া। স্টিভ তার বারের ড্যান্সারদের প্রশিক্ষণ দিতে চুক্তি করলেন তাঁর সঙ্গেই। কিন্তু স্টিভের ওই ঈর্ষা নামক রোগটা তো কিছুতেই পিছু ছাড়ার নয়। নিকের জনপ্রিয়তা দেখে তাই তাকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষলেন তিনি। ভাড়া করলেন কুখ্যাত শ্যুটার 'স্ট্রবেরি'কে। তাঁর আসল নাম অবশ্য কোলন গিলবার্তো রিভেরা লোপেজ।

নিউ ইয়র্ক শহরের ১৫ তলা অফিসে গুলি করে নিক ডে নোইয়াকে খুন করে 'স্ট্রবেরি'। শুধু তাই নয় এরপর আরও বেশ কয়েকটি খুনের হুকুম দেয় স্টিভ। সেই হুকুম তামিল করতে সায়ানাইড দিয়ে বেশ কয়েকজন প্রতিযোগী বারের ড্যান্সারকে খুন করে স্ট্রবেরি। তবে এ খুনের নেশা যে স্টিভের পিছু ছাড়বে না তা বোধ করি আঁচ করতে পারেন স্ট্রবেরি নিজেও। তাই ভিতরে ভিতরে মীরজাফরের কাজটি করেন নিজেই। FBI-এর এক এজেন্টকে স্টিভের কুকর্ম সম্পর্কে খবর দিয়ে দেয় সে। অতঃপর ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিক ডে নোইয়াকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন স্টিভ ব্যানার্জি। কিন্তু জীবনে ‘হার’ শব্দটাকে একেবারেই যে মেনে নিতে পারতেন না সোমেন স্টিভ ব্যানার্জি, তাই ধরা পড়ে যাওয়া অথবা শাস্তিকেও পরিণতি মেনে নিতে পারেননি তিনি। আত্মহত্যাকেই তাই শেষ অস্ত্র করেছিলেন স্ট্রিপটিজের নায়ক স্টিভ। অবশ্য ‘নায়ক’ না বলে ‘খলনায়ক’ বললেই যথাযথ হবে।

More Articles