চোর না পতিতা? 'ছিনাল' শব্দের আসল মানে রয়ে গেছে আড়ালেই
Bengali Vocabulary: অপরের পুরুষধন ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যেও যে ছিনকার, ছিনার বা ছিনাল শব্দের উৎপত্তি হতে পারে, তা কেউ ভেবে দেখেননি।
এবারের শব্দ 'ছিনাল'। অর্থ সকলেরই জানা, ব্যভিচারিণী। বঙ্গীয় শব্দকোষ ব্যুৎপত্তি দিয়েছে, [সং ছিন্না; 'ছিণ্ন, ছিণ্ণাল'– জার, 'ছিণ্ণা, ছিণ্ণালী'– জারস্ত্রী (দেশী); ছিণ্ণাল (অভিধান-রাজেন্দ্র, জৈন প্রাকৃতকোষ); হি ছিনাল; ঠ ছিনাল(পুরুষ, স্ত্রী); গু ছিনাল]। প্রয়োগদৃষ্টান্ত, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর লিখেছেন, 'ডাকাত ছিনার(ছিনাল) চোর'। দ্বিজ বংশীদাস লিখেছেন, 'চুরি ছিনালির দায়, দুই কান চিরা'।জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে ব্যুৎপত্তি আছে,[ সং ছিন্না, প্রাকৃত-ছিন্নাল; ছিনাল(বেশ্যা)। "ছিন্নালিয়া পুত্তো (মৃচ্ছকটিক)। হিন্দি ছিনার]। বি, বেশ্যা, ব্যভিচারিণী স্ত্রী, কুলটা, ভ্রষ্টা। প্রয়োগদৃষ্টান্ত, 'ডাকাত ছিনার চোর হাজার হাজার'। বিশ্বকোষও জানাচ্ছে, ব্যুৎপত্তি সংস্কৃত 'ছিন্না' থেকে। সংসদ বাংলা অভিধান ব্যুৎপত্তি দিচ্ছে, [প্রাকৃত- ছিন্নাল]। অর্থ, ভ্রষ্টা নারী, কুলটা, ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোক। গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত(সহসম্পাদক স্বরোচিষ সরকার) বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানে ছিনাল শব্দটির ব্যুৎপত্তিতে সংস্কৃত ছিন্না শব্দের কথাই বলা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে লেখা আল মাহমুদের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে,
সে কানেট পরে আছে হয়তো বা চোরের ছিনাল।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকার পুরনো একটি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে, 'ছিনাল' শব্দটিকে সেখানে দেশি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঘোড়াও নাকি দেশি 'ঘোড়ো' থেকে এসেছে। পরে সংস্কৃতায়ন হয়ে ঘোটকরূপ ধারণ করেছে।
যে প্রশ্নটি মনে জাগছে, বারবার চোরডাকাতের সঙ্গেই 'ছিনাল' তথা 'ছিনার' শব্দটিকে একাসনে বসানো হচ্ছে কেন? তথাকথিত কুলটা, বেশ্যাদের সঙ্গে চোরডাকাতের এই সহাবস্থান অবাক করে। তাহলে কি কুলটা, গণিকাদের থেকে ছিনার বা ছিনাল একটু আলাদা?
আরও পড়ুন: গ্রিক না সংস্কৃত? ‘কেন্দ্র’ শব্দের উৎস নিয়ে যে ঝগড়া লেগেই আছে
সুশীলকুমার দে-র 'বাংলা প্রবাদ' বইয়ে ছিনাল নিয়ে অনেকগুলি প্রবাদ আছে।
১. চোর, ছিনাল, চোপায় দড়, আগে যায় শীতলার মাড়।
২. চোরের না, ছিনালের মা।
৩. চোরের মন ভাঙা বেড়ায়, ছিনালের মন আড়ায়-পাড়ায়।
এখানেও দেখা যাচ্ছে চোরের সঙ্গে ছিনালের সহাবস্থান। চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীর কমন ফ্যাক্টর ছিনিয়ে নেওয়া। ছিনাল তথা ছিনার-ও কি কিছু ছিনিয়ে নেয়! বেশি ভাবতে হবে না। ঘরের বউয়ের হাত থেকে পতিদেবতাকে ছিনিয়ে নিতে ওস্তাদ ছিনার-নারীরা বাবুকালচারের যুগে বহু-আলোচিত, বহুচর্চিত বিষয়।
অমন যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার তথা জাহাজ-কয়লার ব্যবসায়ী প্রিন্স দ্বারকানাথ, তাঁর হাতেই তো ছিল শহর কলকাতার ছেচল্লিশটি ব্রথেলের মালিকানা। পতিদেবতাদের দিনরাতের মোচ্ছবের নিভৃতনিকেতন। বাড়ির যুবক-প্রৌঢ়দের নিয়েই তো স্বৈরিণীদের স্বর্গরাজ্য রচিত হয়েছিল সেখানে । ছিনিয়ে না নিলে চলবে কী করে তাদের? ছিনিয়ে নেওয়াই তো দস্তুর তাদের কাছে!
কাদম্বরী দেবীর সুযোগ্য স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পাঞ্জাবির পকেট থেকে কোন বারাঙ্গনার চিঠি-চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল যেন? রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ির নৃত্যগীতে কারা যেন নাচাগানা করত? দেশি-বিদেশি কোন বাইজিরা? হৃদয় ছিনিয়ে, অর্থ ছিনিয়ে কারা নিজেদের বিত্তশালী করে তুলত?
ছিনিয়ে নেওয়াই যেন ছিনার তথা ছিনালের অভ্যাস তথা পেশা। এই 'ছিনানো' ক্রিয়াপদটির মূলেও বঙ্গীয় শব্দকোষ 'ছিন্ন'-কে টেনে এনেছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনও তাই। সংসদ বাংলা অভিধান একটু ভিন্ন পথে হেঁটেছেন, ছিনানো-র ব্যুৎপত্তি দেওয়া হয়েছে, [ বাং √ছিনা–তু হি. ছীন]।
তাহলে সংসদ অভিধান ছিনানো-কে দেশি (দ্রাবিড়-অস্ট্রিক গোত্রের) শব্দই ভেবেছেন।
আমার মতে এই 'ছিনানো' ক্রিয়াপদটিই ছিনাল শব্দের মূলে আছে। চোর-ডাকাত যেমন গৃহস্থের বা পথিকের কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়, ছিনার তথা ছিনালও অন্য নারীর প্রাণাধিক ধনকে ছিনিয়ে নেয়। এই ছিনিয়ে নেওয়া বা পরস্বাপহরণ অতিশয় নিন্দনীয় ব্যাপার। তাই সমাজরক্ষকরা চোরেদের যে চোখে দেখেন, ছিনালদেরও সেই চোখেই দেখেন, হেয়জ্ঞান করেন।
মনোজ বসুর 'নিশিকুটুম্ব' উপন্যাসে চোর-বাবাজীবন রাতে গৃহস্থের বাড়িতে এন্ট্রি নিয়ে ঘরণীর সঙ্গে সোয়ামীর ভূমিকায় অভিনয় করে তার সব কিছু হাতিয়ে নিয়েছিল। এই ধরনের চোরের দেখা পাওয়া আজকাল অতীব দুষ্কর। কালেভদ্রে এ-জাতীয় পুণ্যবান চোরের দেখা মেলে।
'সংসার সীমান্তে' সিনেমায় ( মূল কাহিনী: প্রেমেন্দ্র মিত্র) সিঁধে।ল চোর অঘোরের কীর্তিকাহিনীর কথাও আমরা জানি। তার প্রেমিকাও ছিল তথাকথিত ছিনাল। তারা দু'জন শেষমেশ ঘর বাঁধতে পেরেছিল কি না, জানা যায়নি। তবে সমাজ তাদের সেই পরিসরটুকু দেয়নি বলেই মনে হয়।
রবীন্দ্রনাথ সমগ্র সাহিত্যকর্মে একবারও 'ছিনাল' শব্দটি ব্যবহার করেননি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন টেগোর ভেরিওরাম সেটাই দেখাচ্ছে। আসলে রাবীন্দ্রিক পিউরিটান রুচিতে ছিনাল 'ভদ্রলোক'-এর ভাষা হিসেবে পরিগণিত হয়নি। দ্বারকানাথের গণিকাগৃহের ব্যবসা তিনি যে ভালোচোখে দেখতেন না, তা এই অনুল্লেখেই পরিষ্কার। বস্তুত কবিগুরু তাঁর সমস্ত লেখাপত্রে মাত্র একবার দ্বারকানাথের নাম লিখেছেন। এতই তীব্র ছিল তাঁর দ্বারকানাথবিদ্বেষ। দ্বারকানাথের সমস্ত দলিলদস্তাবেজ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। দেবেন্দ্রনাথ একাই এই কম্মো যে করেননি, রবীন্দ্রনাথেরও মদত ছিল তাতে, সেটা পণ্ডিতরাই বলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বারটান নিয়ে অনেক গল্প আছে। বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি, ছাড়াও চন্দননগরের মোরান সাহেবের বাংলোতেও তিনি সময় কাটাতে যেতেন। সেখানে গঙ্গার বুকে বজরায়, বাংলোর ছাদে রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর, কোনও রকম ছিনালিপনা ছিল না, নিন্দুকরা যাই রটাক না কেন!
অনেক লেখকের লেখাতেই 'ছিনাল' শব্দটি জ্বলজ্বল করছে। তবে কে কোথায় লিখে গেছেন, এই মুহূর্তে সব মনে পড়ছে না। রবীন্দ্রনাথ না লিখলেও তাঁর পূর্ববর্তী সাহিত্যকরা ছিনাল লিখেছেন। দীনবন্ধু মিত্র 'নবীন তপস্বিনী'-তে লিখেছেন, 'আমি আর ছেনালের কথা ভুলিনে'। মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো' প্রহসনে লিখেছেন, 'ছুঁড়ীর কি চমৎকার রূপ গা, আর একটু ছেনালীও আছে।'
রবীন্দ্রোত্তর পর্বে শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, মানিক লিখতে পারেন। জীবনানন্দ দাশও। কবিতায় নয়, উপন্যাসে, গল্পে। নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছেন হয়তো। মনে পড়ছে না।।
সমরেশ বসু তাঁর 'অভয়ের বিয়ে' উপন্যাসে সদ্যবিবাহিতা বধূ নিমি-র মুখে বসিয়েছেন ছিনাল শব্দটি।
...পশুশক্তি নিষ্পিষ্ট করতে চাইছে এই শরীর।
নিমির ভয়, তবু বিদ্রূপ হেসেই বলল, একে থেটারি ঢং বলে না তো আর কী বলে?
অভয় বলল, তাই বুঝি, তবে বলো, শুনি আর কী বলবে?
নিমিও যেন শক্ত হতে চাইল। আবার কি? ওই ছিনাল খুড়ির বাড়িতে–
কী?
–হ্যাঁ, ওখেনে আর ভাসুর-পো-গিরি করতে যাওয়া চলবে না।
যা হোক, ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে লাভ নেই, 'ছিনাল' শব্দটির ব্যুৎপত্তিতেই ফিরে আসা যাক।
ছিন্ন (ছিন্না) থেকে হোক বা প্রাকৃত ছিন্নাল থেকেই হোক, এটাই পাঠকের মাথায় গাঁট্টা মেরে অভিধানগুলিতে বোঝানো হয়েছে যে, সমাজ-সংসার থেকে ছিন্ন বা পতিত হয়েই এদের নিচ পেশায় গমন। তাই এরা ছিনাল, পতিতা, কুলটা। কিন্তু অপরের পুরুষধন ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যেও যে ছিনকার, ছিনার বা ছিনাল শব্দের উৎপত্তি হতে পারে, তা কেউ ভেবে দেখেননি।
'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ'-এর পত্রিকায় অনেক আগেই যা লেখা হয়েছে, তা মানতে বাধা কেন অভিধানকারদের? ছিনাল-কে দেশি শব্দ হিসেবে ঘোষণা করে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার নামী লেখক ঠিক করেছিলেন কি না, তা বিদ্বজ্জনসমাজের ও ভাষাবিদদের ভেবে দেখা উচিত।